মানুষ কী নিয়ে বাঁচে – লিও টলস্টয়

তিন

 

সাইমনের বউ সকাল-সকাল সব কাজকর্ম শেষ করে ফেলেছে। জ্বালানির কাঠ কেটেছে, জল এনেছে, ছেলেকে খাইয়েছে, নিজেও কিছু একটু মুখে দিয়েছে, তারপর বসে বসে ভাবছে, কখন রুটি বানাবে : আজ না কাল? সে ভাবল, “সাইমন যদি দুপুরের খাবারটা খেয়ে থাকে, রাতে আর বেশি কিছু খাবে না। তাহলে যে-রুটি আছে তা দিয়ে কাল চলে যাবে।”

রুটির টুকরোটা ঘোরাতে ঘোরাতে মাত্রোনা ঠিক করল : “আজ আর রুটি বানাচ্ছি না। যা ময়দা আছে তাতে আর-একখানি মাত্র পাউরুটি হবে। সেটা দিয়ে শুক্রবার চালিয়ে দেব।”

কটিটা একপাশে সরিয়ে রেখে মাত্রোনা টেবিলে বসে স্বামীর শার্টের ফুটো সেলাই করতে লাগল। সেলাই করতে করতে সে স্বামীর কথাই ভাবছিল; ভাবছিল তার চামড়া কেনার কথা।

“চামড়ার দোকানি তাকে না ঠকালে বাচি! লোকটা আবার যা সোজা-সরল ! নিজে সে কাউকে ঠকাবে না, কিন্তু একটা ছোটছেলেও তাকে বোকা বানাতে পারে। আট রুবল তো চাট্টিখানি কথা নয়। একটা কোটের অভাবে গত শীতে বড়ই কষ্ট গেছে। নদীতে যেতে পারি না, বেরোতে পারি না কোথাও। লোকটা যখন সবকিছু গায়ে চড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত, আমার তো গায়ে দেবার কিছুই থাকত না। আজ যদিও খুব সকালে বেরোয়নি, তবু এতক্ষণ তো তার ফিরে আসা উচিত। জানি না আবার কোথাও মজা লুটতে বসেছেন কি না।”

মাত্রোনা যখন এইসব ভাবছে তখন সিড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। সেলাইয়ের ভিতর সুঁচটা আটকে রেখে মাত্রোনা বাইরে মুখ বাড়াল। আরে! এ যে দুজন বাড়িতে ঢুকছে—সাইমন, আর তার সঙ্গে একটি অপরিচিত মানুষ! মাথায় টুপি নেই, পায়ে ভারী বুট।

সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর মুখে ভদকার গন্ধ পেল সে। তাহলে তো মজা লুটেই এসেছেন! তার উপর এতক্ষণে নজরে পড়ল তার গায়ে কোর্টটাও নেই, আছে শুধু তারই জ্যাকেটটা। হাতেও কিছু নেই।

মাত্রোনার বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল। সে ভাবল, এ তো মদ খেয়ে সব টাকা উড়িয়ে এসেছে। এই বাজে লোকটার সঙ্গে ফুর্তিফার্তা করে বাড়ি অবধি নিয়ে এসেছে ওকে।”

মাত্রোনার সামনে দিয়েই তারা ঘরে ঢুকল। ভালো করে সে দেখতে পেল আগন্তুক লোকটিকে। একটি হ্যাংলা চেহারার যুবক, গায়ে তাদেরই কোট, মাথায় টুপি নেই। কোটের নিচে শার্টও নেই। ভিতরে ঢুকে লোকটি সেখানেই দাড়িয়ে রইল, নড়ল না একটুও, চোখ তুলে তাকালও না। মাত্রোনার মনে হল লোকটা নিশ্চয় খারাপ, তাই ভয় পেয়েছে।

মাত্রোনা ভুরু কুঁচকে স্টোভের দিকে এগিয়ে গেল। দেখতে লাগল ওরা কী করে।

সাইমন টুপি খুলে বেঞ্চিটার উপর বসল, যেন কিছুই হয়নি। বলল, “আরে মাত্রোনা, রাতের খাবারটা বানাও।”

মাত্রোনা অস্ফুটভাবে কী যেন বলে সেখানেই দাড়িয়ে রইল। সাইমন বুঝল বউয়ের মেজাজ বিগড়েছে, কিন্তু কিছু তো করবার নেই। আগন্তুকের হাত ধরে সে বলল, “এসো ভাই, এইখানে বস, কিছু খাওয়া যাক।”

আগন্তুক সাইমনের পাশের বেঞ্চিটাতে বসল। সাইমন উঠে গিয়ে বউকে বলল, “কী রান্না করেছ বলো দেখি।”

মাত্রোনা রাগে ফেটে পড়ল : “রান্না করেছি, কিন্তু তোমার জন্যে নয়। মদ খেয়ে তো বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। গেলে কোট কিনতে; ফিরে এলে নিজের কোটটাও খুইয়ে। আবার একটা ন্যাংটো রাস্তার লোককে ধরে এনেছ সঙ্গে করে। তোমাদের মতো মাতালদের জন্য আমি রান্না করিনি।”

“দেখ মাত্রোনা, অকারণে বকবক কোরো না। আগে শোনো লোকটা কেমনশুশুশুশু”

“আগে বলো, টাকা কী করেছ।”

সাইমন কোটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে নোট বের করে দেখাল।

“এই দেখ টাকা। ত্রিফোন্ফ টাকা দেয়নি, কাল দেবে বলেছে।”

মাত্রোনার রাগ আরও চড়ে গেল। কোট তো আনেইনি, আবার তাদের একটিমাত্র কোট খয়রাত করেছে একটা ন্যাংটো লোককে। তাকে বাড়ি অবধি নিয়ে এসেছে।

টেবিলের উপর থেকে টাকাটা ছোঁ মেরে নিয়ে লুকিয়ে রাখতে রাখতে সে বলল, “কিছু নেই; যত রাজ্যের ন্যাংটো মাতালদের আমি খাওয়াতে পারব না।”

“আহ্ মাত্রোনা, চুপ করো! আগে শোনো লোকটা কে…”

“একটা বোকা মাতালের কথা আবার কী শুনব। গেলে চামড়া কিনতে, তাও মদ খেয়ে উড়িয়ে দিলে।”

সাইমন বউকে বোঝাতে চাইল যে সে মাত্র কুড়ি কোপেকের মদ খেয়েছে, আর এই লোকটাকে কী অবস্থায় পেয়েছে কিন্তু এক কথা বলবার আগে বউ তাকে দশ-কথা শুনিয়ে দিল।

বকবক করতে করতে একসময় মাত্রোনা সাইমনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে জামার আস্তিন চেপে ধরে বলে উঠল, “শিগগির আমার জ্যাকেট দাও! ওটাই তো আমার একমাত্র সম্বল, তাও তুমি নিয়ে নিয়েছ নিজে গায় দেবে বলে। এক্ষুনি ফিরিয়ে দাও, মাতাল, কুকুকোথাকার! তারপর জাহান্নামে যাও!”

সাইমন জ্যাকেটটা খুলতে চেষ্টা করতেই মাত্রোনা সেটা ধরে দিল টান। ফলে তার সেলাই গেল ছিড়ে। সেটাকেই টেনে নিয়ে নিজের মাথায় জড়িয়ে মাত্রোনা দরজার দিকে পা বাড়াল।

হঠাৎ সে দাড়িয়ে পড়ল। বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল তার। মাত্রোনার মনে হল, রাগ দমন করা দরকার; এ লোকটা কে তাও জানা দরকার।

পোস্টটি শেয়ার করুন