মানুষ কী নিয়ে বাঁচে – লিও টলস্টয়

আট

 

আরও একবছর কেটে গেল। এখন সাইমনের বাড়িতে দুবছর পূর্ণ হল মিখাইলের। সে ঠিক আগের মতোই আছে। কখনও কোথাও যায় না, একটা বাজে কথা বলে না। এতদিনের মধ্যে মাত্র দুবার হেসেছে : একবার, যখন স্ত্রীলোকটি তার জন্য রাতের খাবার তৈরি করেছিল, দ্বিতীয়বার সেই ভদ্রলোককে দেখে। লোকটিকে নিয়ে সাইমনেরও খুশির সীমা নেই। কোথা থেকে সে এসেছে, সে আর জিজ্ঞেস করে না। তার একমাত্র ভয়, পাছে মিখাইল চলে যায়।

একদিন, দুজনই বাড়িতে। মুচির বউ উনুনে পাত্র চাপাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা বেঞ্চির পাশে। দৌড়োদৌড়ি করছে আর জানালা দিয়ে দেখছে মাঝেমাঝে। একটা জানালার পাশে বসে সাইমন সেলাই করছে। আরেকটা জানালার পাশে বসে মিখাইল জুতোর গোড়ালিতে কাঁটা মারছে।

সাইমনের ছোটছেলে দৌড়ে এসে মিখাইলের ঘাড়ের উপর ঝুঁকে পড়ে জানালা দিয়ে তাকাল।

“মিখাইলকাকা, দেখ, ছোট-ছোট মেয়েদের নিয়ে একজন বণিকের স্ত্রী এই দিকেই আসছে। একটি ছোটমেয়ে আবার খোড়া।”

সঙ্গে সঙ্গে মিখাইল হাতের কাজ রেখে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাল।

সাইমন অবাক হয়ে গেল। এর আগে মিখাইল তো কখনও রাস্তার দিকে তাকায়নি! অথচ এখন সে কী যেন দেখবার জন্য জানালার একেবারে ধার ঘেঁষে বসেছে। সাইমনও জানালা দিয়ে তাকাল। দেখল, পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা একটি স্ত্রীলোক তার বাড়ির দিকেই আসছে। দুটি মেয়েকে সে হাত ধরে নিয়ে আসছে। দুটি মেয়ে দেখতে একেবারে একরকম। দুজনেরই ফারকোট আর গরম স্কার্ফ গায়ে। দুজনকে আলাদা করাই মুশকিল, শুধু একজনের পা একটু বাকা, সে খুঁড়িয়ে হাঁটে।

স্ত্রীলোকটি সিড়ি বেয়ে উঠে হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলল এবং মেয়েদুটিকে সামনে রেখে ঘরের ভিতরে পা দিল।

“নমস্কার।”

“আসুন। কী চাই আপনার?”

স্ত্রীলোকটি বসল টেবিলের পাশে। মেয়েদুটি তার হাঁটু ঘেঁষে দাড়াল।

স্ত্রীলোকটি বলল, “এই মেয়েদের বসন্তকালে পরার মতো চামড়ার জুতো চাই।”

“ভালো কথা, করে দেব। এত ছোট জুতো এর আগে আমরা করিনি, কিন্তু সবরকমই আমরা করতে পারি। আগাগোড়া চামড়ার জুতোও করাতে পারেন, আবার কাপড়ের লাইনিং দেওয়াও করাতে পারেন। এই আমার বড় কারিকর মিখাইল।”

সাইমন মিখাইলের দিকে তাকাল। সে তখন হাতের কাজ রেখে মেয়েটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে।

সাইমন খুই বিস্মিত হল। এ কথা ঠিক যে মেয়েদুটি দেখতে খুব সুন্দর। কালো চোখ, গোলগাল লাল টুকটুকে শরীর। গায়ের কোট আর স্কার্ফও সুন্দর। কিন্তু মিখাইল কেন যে একান্ত পরিচিতের মতো তাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে কিছুতেই বুঝতে পারল না।

যাহোক সাইমন স্ত্রীলোকটির সঙ্গে দরদাম করতে লাগল। খোঁড়া মেয়েটাকে কোলের উপর তুলে স্ত্রীলোকটি বলল: “এর দুপায়ের মাপ নাও; একপাটি জুতো করো খোঁড়া পায়ের মাপে, আর তিন-পাটি করো ভালো পায়ের মাপে। তাহলেই হবে। এদের দুজনের পা ঠিক এক মাপের। এরা যমজ।”

মাপ নেবার পর সাইমন বলল, “আহা, এমন সুন্দর মেয়েটি, এরকম কেমন করে হল? জন্মের থেকেই কি এই রকম?”

“না, ওর মা-ই পা-টা ভেঙে ফেলেছিল।”

এই সময় মাত্রোনা ঘরে ঢুকে বলল, “আপনি তাহলে ওদের মা নন?”

“না গো ভালোমানুষের মেয়ে, আমি ওদের মা নই, কোনোরকম আত্মীয়ও নই। এদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কই নেই। আমি ওদের লালন-পালন করেছি মাত্র।”

“আপনার মেয়ে নয়, অথচ আপনি ওদের এত ভালোবাসেন!”

“ভালো না বেসে কী করি? এদের দুজনকেই যে আমার বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেছি। আমার নিজের একটি সন্তান ছিল, ঈশ্বর তাকে নিয়ে নিলেন। এদের যত ভালোবাসি তত ভালো বুঝি সেটাকেও বাসতাম না।”

“এরা তাহলে কার মেয়ে?”

স্ত্রীলোকটি বলতে আরম্ভ করল।

“ছ-বছর আগেকার কথা। একসপ্তাহের মধ্যে এরা বাবা-মাকে হারাল; বাপকে কবর দেওয়া হল মঙ্গলবার, মা মারা গেল শুক্রবার। জন্মের তিনদিন আগে বাপকে হারাল, মা মারা গেল জন্মের দিন। তখন আমার স্বামী আর আমি চাষবাসের কাজ করি। আমরা ছিলাম তাদের প্রতিবেশী ; পাশের বাড়িই ছিল আমাদের ! ওদের বাবাও একজন চাষী, জঙ্গলে কাজ করত। কেমন করে যেন একটা গাছ তার উপরে পড়ে; শরীরের একেবারে আড়াআড়ি। ফলে ভিতরটা একেবারে গুঁড়ো হয়ে যায়। তাকে যখন বাড়ি নিয়ে এল, তখন সব শেষ। সেই সপ্তাহেই তার স্ত্রীর দুটি যমজ মেয়ে হল, এই দুটি মেয়ে। দুঃখে-দুর্দশায় সে ছিল একেবারে একা-যুবতী বা বৃদ্ধা কোনো আত্মীয়াই ছিল না। একাই সে শিশুদের জন্ম দিল, একাই মারা গেল।

“পরদিন সকালে আমি তাকে দেখতে গেলাম। ওর বাড়ি পৌঁছে দেখি বেচারি তখন মরে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মরবার ঠিক আগে সে পাশ ফিরে একটা মেয়ের উপর গড়িয়ে পড়ে। তাতেই ওর বাঁ-পা গুঁড়িয়ে বেঁকে যায়। লোকজন জড়ো হয়ে তাকে ধোঁয়াপোঁছা করে, পোশাক পরিয়ে কফিন তৈরি করে কবর দেবার ব্যবস্থা করল। মেয়েদুটি একা পড়ে গেল। কোথায় তাদের রাখা হবে? তখন একমাত্র আমার কোলেই সন্তান ছিল আমার সেই ছেলের বয়স তখন আট সপ্তাহ। কাজেই তখনকার মতো আমিই তাদের ভার নিলাম। সুস্থ মেয়েটাকে বুকের দুধ খাওয়াতে লাগলাম। প্রথমটা পা-ভাঙা মেয়েটাকে দুধ দিইনি, ও যে বাচবে তা ভাবিনি। পরে ভাবলাম: এমন পরীর মতো মেয়েটা কেন মারা যাবে? আমার মনে দয়া হল। তাকেও দুধ দিতে লাগলাম। আমার তখন বয়স অল্প, স্বাস্থ্য ভালো, ভালো খাওয়াদাওয়া করতাম। ঈশ্বরও বুকে এত দুধ দিতেন যে অনেক সময় উপচে পড়ত। একসঙ্গে দুজনকে খাওয়াতাম, তৃতীয়জন অপেক্ষা করত। একজন থামলে তখন তৃতীয়টিকে খাওয়াতাম। ঈশ্বরের বুঝি ইচ্ছা যে আমি এই দুটোকেই মানুষ করি, তাই দ্বিতীয় বছরেই আমরা নিজেরটিকে কবরে শুইয়ে দিলাম। ঈশ্বর আমাকে আর সস্তান দিলেন না, কিন্তু আমাদের অবস্থা ফিরতে লাগল। এখন আমরা মিলের মালিক হয়েছি। আমাদের আয় যথেষ্ট, থাকিও ভালোভাবে। নিজেদের ছেলেপিলে নেই, এই দুটিকে না পেলে কী নিয়ে আমি বাঁচতাম ! ওদের ভালো না বেসে কি আমি পারি ! ওরাই তো আমার প্রদীপের সলতে।”

মাত্রোনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল :“এইজন্যই বুঝি লোকে বলে :বাপ-মা ছাড়া তুমি বাঁচতে পারো, কিন্তু ঈশ্বরকে ছেড়ে বাঁচতে পারো না।”

কথাবার্তা শেষ করে স্ত্রীলোকটি যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। মুচি আর তার বউ দরজা পর্যন্ত গেল তাদের সঙ্গে। তারপর মিখাইলের দিকে তাকাল। হাঁটুর উপরে দুই হাত ভাজ করে সে বসে আছে। চেয়ে আছে উপরের দিকে। হাসছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন