মানুষ কী নিয়ে বাঁচে – লিও টলস্টয়

চার

 

মাত্রোনা থামল। বলল :“লোকটা যদি ভালোই হবে তাহলে সে এমন ন্যাংটো কেন, কেন গায়ে দেবার একটা শার্টও জোটেনি। আর তুমি যদি ভালোভাবেই ছিলে সারাদিন তাহলে এই স্যাঙাকে কোথেকে জুটিয়েছ সেকথা এতক্ষণ খুলে বলোনি কেন?”

সাইমন বলল, “বেশ তো, এখুনি সব বলছি। আমি হেঁটে আসছিলাম; দেখি প্রার্থনাঘরের পাশে লোকটি বসে আছে; গায়ে কিছু নেই, শীতে জমে গেছে। ভেবে দেখ, লোকটি একেবারে উলঙ্গ, আর এটা গরমকাল নয়। ঈশ্বরই আমাকে ওর কাছে পাঠিয়েছিলেন, নইলে সে নির্ঘাত মারা যেত। বলো, তখন আমি কী করি? আমি তাকে হাত ধরে তুললাম, জামা-জুতো পরালাম, নিয়ে এলাম এখানে। মনটাকে একটু নরম কর মাত্রোনা; এরকম করা পাপ। মনে রেখোঁ, আমরাও একদিন মরব।”

মাত্রোনা আবার বকুনি দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় আগন্তুকের দিকে তার চোখ পড়ল।

আগন্তুক তখনও বেঞ্চির এককোণে চুপ করে বসে আছে। দুখানি হাত রেখেছে হাঁটুর উপর, মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে বুকের উপর। চোখ-ভুরু কুঁচকে আছে, যেন ভিতর থেকে কোনোকিছু আঘাত করছে তাকে।

মাত্রোনা চুপ করে গেল।

সাইমন বলল, “মাত্রোনা, তোমার মধ্যে কি ঈশ্বরের ভয় নেই?”

এই কথা শুনে মাত্রোনা আবার আগন্তুকের দিকে চাইল। সহসা তার মনটা গলে গেল। স্টোভের কাছে গিয়ে সে খাবার তৈরি করল। টেবিলের উপর একটি ছোট বাটি রেখে তাতে কাস ঢালল, রুটির শেষ টুকরোটা এনে দুজনের দিকে এগিয়ে দিল দুটো কাঁটা-চামচ।

“এবার খাও”, মাত্রোনা বলল।

সাইমন আগন্তুককে ডেকে নিল টেবিলে।

“বসো হে ভালো মানুষ।”

সাইমন রুটি কেটে খেতে শুরু করল। মাত্রোনা টেবিলের একপাশে দাড়িয়ে দেখতে লাগল আগন্তুককে। বেচারির জন্য এবার দুঃখ হল তার।

সহসা আগন্তুক যেন খুশি হয়ে উঠল। থেমে গেল তার ভুরুর কোঁচকানি। মাত্রোনার দিকে দুচোখ তুলে তাকিয়ে সে হেসে ফেলল।

খাওয়া শেষে টেবিল পরিষ্কার করে মাত্রোনা আগন্তুককে জিজ্ঞেস করল :“তুমি কোখেকে আসছ?”

“এ-অঞ্চল থেকে নয়।”

“রাস্তার ধারে এলে কেমন করে?”

“বলতে পারি না।”

“তোমার সবকিছু কি কেউ চুরি করেছিল ?”

“ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দিয়েছেন।”

“তাই কি তুমি ন্যাংটো হয়ে সেখানে পড়েছিলে?”

“তাই আমি সেখানে পড়ে ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলাম। সাইমন আমাকে দেখতে পেল; দয়া হল তার, কোট খুলে আমাকে পরিয়ে দিল। আসতে বলল এখানে। এখানে এলে তুমি আমাকে খাদ্য দিলে, পানীয় দিলে, আমাকে দয়া করলে। ঈশ্বর তোমাদের রক্ষা করুন।”

মাত্রোনা উঠে দাড়াল। সাইমনের যে শার্টটা সে সেলাই করছিল সেটা জানালার তাক থেকে তুলে নিয়ে আগন্তুককে দিল। খুঁজে পেতে এনে দিল একটা ট্রাউজারও।

“তোমার তো শার্ট নেই। এইগুলো পরে ঐ তাকের উপরে বা স্টোভের উপরে যেখানে খুশি শুয়ে পড়ো।”

আগন্তুক গায়ের কোটটা খুলে শার্ট ও ট্রাউজার পরে তাকের উপরে শুয়ে পড়ল। মাত্রোনা বাতি নিভিয়ে দিয়ে কোর্টটা নিয়ে স্বামীর পাশে শুল।

তার মনে পড়ল, রুটির শেষ টুকরোটাও তারা খেয়ে ফেলেছে। কালকের জন্য কিছুই নেই। মনে পড়ল, শার্ট আর ট্রাউজার দুটোই সে দান করেছে। অমনি তার মন খারাপ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ল আগন্তুকের হাসিটি; অমনি মন খুশি হয়ে উঠল আবার।

মাত্রোনা অনেকক্ষণ জেগে রইল। একসময় তার খেয়াল হল সাইমনও ঘুমোয়নি।

“সাইমন!”

“উ ?”

“রুটির শেষ টুকরোটাও আমরা খেয়ে ফেলেছি। কালকের জন্য কিছু বানিয়েও রাখিনি। কাল কী হবে আমি জানি না। প্রতিবেশীর কাছে কিছু ধার চাইতে হবে।”

“আমরা বেঁচে থাকব; খেতেও পাব।”

বউটি চুপ করে রইল। “যাই হোক, লোকটি নিশ্চয়ই ভালো; তবে, নিজের সম্বন্ধে কিছুই বলে না এই যা।”

“কথা বলার তার দরকার নেই।”

“সাইমন!”

“উ।”

“আমরা তো দিলাম, কিন্তু আমাদের কেউ কিছু দেয় না কেন?”

কী জবাব দেবে সাইমন জানে না। সে বলল, “পরে কথা হবে।”

সে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল।

পোস্টটি শেয়ার করুন