পল্লী সমাজ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বিশ্বেশ্বরীর সেদিনের কথাটা সেইদিনেই দশখানা গ্রামে পরিব্যাপ্ত হইয়া গিয়াছিল। বেণী লোকটা নিজে কাহারও মুখের উপর রূঢ় কথা বলিতে পারিত না; তাই সে গিয়া রমার মাসীকে ডাকিয়া আনিয়াছিল। সেকালে নাকি তক্ষক দাঁত ফুটাইয়া এক বিরাট অশ্বত্থ গাছ জ্বালাইয়া ছাই করিয়া দিয়াছিল। এই মাসীটিও সেদিন সকালবেলায় ঘরে চড়িয়া যে বিষ উদ্গীর্ণ করিয়া গেলেন, তাহাতে বিশ্বেশ্বরীর রক্তমাংসের দেহটা, কাঠের নয় বলিয়াই হৌক, কিংবা একাল সেকাল নয় বলিয়াই হৌক, জ্বলিয়া ভস্মস্তূপে পরিণত হইয়া গেল না। সমস্ত অপমান বিশ্বেশ্বরী নীরবে সহ্য করিলেন। কারণ, ইহা যে তাঁহার পুত্রের দ্বারাই সংঘটিত হইয়াছিল, সে কথা তাঁহার অগোচর ছিল না। পাছে রাগ করিয়া একটা কথার জবাব দিতে গেলেও এই স্ত্রীকোটার মুখ দিয়া সর্ব্বাগ্রে তাঁহার নিজের ছেলের কথাই বাহিরে প্রকাশ হইয়া পড়ে এবং তাহা রমেশের কর্ণগোচর হয়, এই নিদারুণ লজ্জার ভয়েই সমস্ত সময়টা তিনি কাঠ হইয়া বসিয়াছিলেন।

তবে, পাড়াগাঁয়ে কিছুই ত চাপা থাকিবার জো নাই। রমেশ শুনিতে পাইল। জ্যাঠাইমার জন্য তাহার প্রথম হইতেই বরাবর মনের ভিতরে উৎকণ্ঠা ছিল, এবং এই লইয়া মাতা-পুত্রে যে একটা কলহ হইবে, সে আশঙ্কাও করিয়াছিল। কিন্তু বেণী যে বাহিরের লোককে ঘরে ডাকিয়া আনিয়া নিজের মাকে এমন করিয়া অপমান ও নির্য্যাতন করিবে এই কথাটা সহসা তাহার কাছে একটা সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড বলিয়া মনে হইল এবং পরমুহূর্ত্তেই তাহার ক্রোধের বহ্নি যেন ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। ভাবিল, ও বাড়ীতে ছুটিয়া গিয়া যা’ মুখে আসে, তাই বলিয়া বেণীকে গালাগালি করিয়া আসে; কারণ, যে লোক মাকে এমন করিয়া অপমান করিতে পারে, তাহাকেও অপমান করা সম্বন্ধে কোনরূপ বাচ-বিচার করিবার আবশ্যকতা নাই। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, তাহা হয় না। কারণ, জ্যাঠাইমার অপমানের মাত্রা তাহাতে বাড়িবে বই কমিবে না। সে দিন দীনুর কাছে এবং কা’ল মাষ্টারের মুখে শুনিয়া রমার প্রতি তাহার ভারি একটা শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়াছিল। চতুর্দ্দিকে পরিপূর্ণ মূঢ়তা ও সহস্র প্রকার কদর্য্য ক্ষুদ্রতার ভিতরে এক জ্যাঠাইমার হৃদয়টুকু ছাড়া সমস্ত গ্রামটাই আঁধারে ডুবিয়া গিয়াছে বলিয়া, যখন তাহার নিশ্চয় বিশ্বাস হইয়াছিল, তখন এই মুখুয্যেবাটীর পানে চাহিয়া একটুখানি আলোর আভাস—তাহা যত তুচ্ছ এবং ক্ষুদ্র হৌক্‌—তাহার মনের মধ্যে বড় আনন্দ দিয়াছিল। কিন্তু আজ আবার এই ঘটনায় রমার বিরুদ্ধে তাহার সমস্ত মন ঘৃণায় ও বিতৃষ্ণায় ভরিয়া গেল। বেণীর সঙ্গে যোগ দিয়া এই দুই মাসী ও বোন্‌ঝিতে মিলিয়া, যে এই অন্যায় করিয়াছে, তাহাতে তাহার বিন্দুমাত্র সংশয় রহিল না। কিন্তু, এই দুইটা স্ত্রীলোকের বিরুদ্ধেই বা সে কি করিবে, এবং বেণীকেই বা কি করিয়া শাস্তি দিবে, তাহাও কোনমতে ভাবিয়া পাইল না।

এমন সময়ে একটা কাণ্ড ঘটিল। মুখুয্যে ও ঘোষালদের কয়েকটা বিষয় এখন পর্য্যন্ত ভাগ হয় নাই। আচার্য্যদের বাটীর পিছনে ‘গড়’ বলিয়া পুষ্করিণীটাও এইরূপ উভয়ের সাধারণ সম্পত্তি। একসময়ে ইহা বেশ বড়ই ছিল; ক্রমশঃ সংস্কার-অভাবে বুজিয়া গিয়া এখন সামান্য একটা ডোবায় পরিণত হইয়াছিল। ভাল মাছ ইহাতে ছাড়া হইত না। কই, মাগুর প্রভৃতি যে সকল মাছ আপনি জন্মায়, তাহাই কিছু ছিল। ভৈরব হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া উপস্থিত হইল। বাহিরে চণ্ডীমণ্ডপের পাশের ঘরে গোমস্তা গোপাল সরকার খাতা লিখিতেছিল, ভৈরব ব্যস্ত হইয়া কহিল, “সরকার মশাই, লোক পাঠাননি? গড় থেকে মাছ ধরানো হচ্চে যে!” সরকার কলম কাণে গুঁজিয়া মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, “কে ধরাচ্ছে?” “আবার কে? বেণীবাবুর চাকর দাঁড়িয়ে আছে, মুখুয্যেদের খোট্টা দরওয়ানটাও আছে—দেখলুম; নেই কেবল আপনাদের লোক। শীগ্‌গির পাঠান।” গোপাল কিছুমাত্র চাঞ্চল্য প্রকাশ করিল না; কহিল, “আমাদের বাবু মাছমাংস খান্‌ না।” ভৈরব কহিল, “নাই খেলেন, কিন্তু ভাগের ভাগ নেওয়া চাই ত!” গোপাল বলিল, “আমরা পাঁচজন ত চাই, বাবু বেঁচে থাক্‌লে তিনিও তাই চাইতেন। কিন্তু রমেশ বাবু একটু আলাদা ধরণের।” বলিয়া ভৈরবের মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন দেখিয়া সহাস্যে একটুখানি শ্লেষ করিয়া কহিল, “এ ত তুচ্ছ দুটো সিঙি মাগুর মাছ, আচায্যি মশায়! সেদিন হাটের উত্তরদিকে সেই প্রকাণ্ড তেঁতুলগাছটা কাটিয়ে ওঁরা দুঘরে ভাগ ক’রে নিলেন, আমাদের কাঠের একটা কুঁচোও দিলেন না। আমি ছুটে এসে বাবুকে জানাতে, তিনি বই থেকে একবার একটু মুখ তুলে হেসে আবার পড়্‌তে লাগলেন। জিজ্ঞেস কর্‌লুম, ‘কি করব বাবু?’ আমার রমেশ বাবু আর মুখটা একবার তোলবারও ফুরসৎ পেলেন না। তার পর পীড়াপীড়ি করতে বইখানা মুড়ে রেখে একটা হাই তুলে বল্‌লেন, “কাঠ? তা’ আর কি তেঁতুল গাছ নেই?” শোন কথা! বললুম, ‘থাকবে না কেন! কিন্তু ন্যায্য-অংশ ছেড়ে দেবই বা কেন, আর কে কোথায় এমন দেয়?’ রমেশ বাবু বইখানা আবার মেলে ধ’রে মিনিট পাঁচেক চুপ ক’রে থেকে বললেন, “সে ঠিক। কিন্তু দুখানা তুচ্ছ কাঠের জন্য ত আর ঝগড়া করা যায় না!” ভৈরব অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল—“বলেন কি!”

গোপাল সরকার মৃদু হাসিয়া বারদুই মাথা নাড়িয়া কহিল, “বলি ভাল, আচায্যিমশাই, বলি ভাল! আমি সেই দিন থেকে বুঝেচি আর মিছে কেন! ছোট তরফের মা-লক্ষ্মী তারিণী ঘোষালের সঙ্গেই অন্তর্ধান হয়েচেন!” ভৈরব খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, “কিন্তু পুকুরটা যে আমার বাড়ীর পিছনেই—আমায় একবার জানান চাই।”—গোপাল কহিল, “বেশ ত ঠাকুর, একবার জানিয়েই এসো না। দিবারাত্রি বই নিয়ে থাক্‌লে, আর সরিকদের এত ভয় কর্‌লে, কি বিষয়-সম্পত্তি রক্ষে হয়? যদু মুখুয্যের কন্যা—স্ত্রীলোক, সে পর্য্যন্ত শুনে হেসে কুটিপাটি! গোবিন্দ গাঙুলীকে ডেকে নাকি সেদিন তামাশা ক’রে বলেছিল, ‘রমেশবাবুকে বোলো একটা মাসহারা নিয়ে বিষয়টা আমার হাতে দিতে।’ এর চেয়ে লজ্জা আর আছে?” বলিয়া গোপাল রাগে-দুঃখে মুখখানা বিকৃত করিয়া নিজের কাজে মন দিল।

বাটীতে স্ত্রীলোক নাই। সর্ব্বত্রই অবারিতদ্বার। ভৈরব ভিতরে আসিয়া দেখিল, রমেশ সামনের বারান্দায় একখানা ভাঙা ইজিচেয়ারের উপর পড়িয়া আছে। রমেশকে তাহার কর্ত্তব্যকর্ম্মে উত্তেজিত করিবার জন্য, সে সম্পত্তি-রক্ষা-সম্বন্ধে সামান্য একটু ভূমিকা করিয়া কথাটা পাড়িবামাত্র রমেশ বন্দুকের গুলি খাইয়া ঘুমন্ত বাঘের মত গর্জ্জিয়া উঠিয়া বলিল—“কি, রোজ রোজ চালাকি না কি! ভজুয়া?” তাহার এই অভাবনীয় এবং সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত উগ্রতায় ভৈরব ত্রস্ত হইয়া উঠিল; এই চালাকিটা যে কাহার, তাহা সে ঠাহর করিতেই পারিল না। ভজুয়া রমেশের গোরখপুর জেলার চাকর। অত্যন্ত বলবান্‌ এবং বিশ্বাসী। লাঠালাঠি করিতে সে রমেশেরই শিষ্য, নিজের হাত পাকাইবার জন্য রমেশ নিজে শিখিয়া ইহাকে শিখাইয়াছিল। ভজুয়া উপস্থিত হইবামাত্র রমেশ তাহাকে খাড়া হুকুম করিয়া দিল—সমস্ত মাছ কাড়িয়া আনিতে এবং যদি কেউ বাধা দেয়, তাহার চুল ধরিয়া টানিয়া আনিতে, যদি না আনা সম্ভব হয়, অন্ততঃ তাহার একপাটি দাঁত যেন ভাঙ্গিয়া দিয়া সে আসে। ভজুয়াত এই চায়। সে তাহার তেলেপাকানো লাঠি আনিতে নিঃশব্দে ঘরে গিয়া ঢুকিল। ব্যাপার দেখিয়া ভৈরব ভয়ে কাঁপিয়া উঠিল। সে বাঙ্‌লাদেশের তেলেজলে মানুষ। হাঁকাহাঁকি, চেঁচাচেঁচিকে মোটে ভয় করে না। কিন্তু ঐ যে অতি দৃঢ়কায়, বেঁটে হিন্দুস্থানীটা কথাটি কহিল না, শুধু ঘাড়টা একবার হেলাইয়া চলিয়া গেল, ইহাতে ভৈরবের তালু পর্য্যন্ত দুশ্চিন্তায় শুকাইয়া উঠিল। তাহার মনে পড়িল, যে কুকুর ডাকে না, সে ঠিক কামড়ায়। ভৈরব বাস্তবিক শুভানুধ্যায়ী, তাই সে জানাইতে আসিয়াছিল, যদি সময়মত অকুস্থানে উপস্থিত হইয়া স’কার ব’কার চীৎকার করিয়া দুটা কৈ-মাগুর ঘরে আনিতে পারা যায়। ভৈরব নিজেও ইহাতে সাহায্য করিবে মনে করিয়া আসিয়াছিল। কিন্তু কৈ, কিছুই ত তাহার হইল না। গালিগালাজের ধার দিয়া কেহ গেল না। মনিব যদি বা একটা হুঙ্কার দিলেন, ভৃত্যটা তাহার ঠোঁটটুকু পর্যন্ত নাড়িল না, লাঠি আনিতে গেল। ভৈরব গরীব লোক; ফৌজদারীতে জড়াইবার মত তাহার সাহসও নাই, সঙ্কল্পও ছিল না! মুহূর্ত্তকাল পরেই সুদীর্ঘ বংশদণ্ড হাতে ভজুয়া ঘরের বাহির হইল এবং সেই লাঠি মাথায় ঠেকাইয়া দূর হইতে রমেশকে নমস্কার করিয়া প্রস্থানের উপক্রম করিতেই, ভৈরব অকস্মাৎ কাঁদিয়া উঠিয়া, রমেশের দুই হাত চাপিয়া ধরিল—“ওরে ভোজো, যাস্‌নে! বাবা রমেশ, রক্ষে কর বাবা, আমি গরীব মানুষ, একদণ্ডও বাঁচ্‌ব না।” রমেশ বিরক্ত হইয়া ছাড়াইয়া লইল। তাহার বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা নাই। ভজুয়া অবাক হইয়া ফিরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। ভৈরব কাঁদকাঁদ স্বরে বলিতে লাগিল, “এ কথা ঢাকা থাকবে না, বাবা! বেণী বাবুর কোপে পড়ে তা’হলে একটা দিনও বাঁচব না। আমার ঘরদোর পর্য্যন্ত জ্বলে যাবে বাবা, ব্রহ্মা-বিষ্ণু এলেও রক্ষা করতে পার্‌বে না।” রমেশ ঘাড় হেঁট করিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। গোলমাল শুনিয়া গোপাল সরকার খাতা ফেলিয়া ভিতরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সে আস্তে আস্তে বলিল, “কথাটা ঠিক বাবু।” রমেশ তাহারও কোন জবাব দিল না, শুধু হাত নাড়িয়া ভজুয়াকে তাহার নিজের কাজে যাইতে আদেশ করিয়া নিজেও নিঃশব্দে ঘরে চলিয়া গেল। তাহার হৃদয়ের মধ্যে যে কি ভীষণ ঝঞ্ঝার আকারেই এই ভৈরব আচার্য্যের অপরিসীম ভীতি ও কাতরোক্তি প্রবাহিত হইতে লাগিল, তাহা শুধু অন্তর্য্যামীই দেখিলেন।

পোস্টটি শেয়ার করুন