পল্লী সমাজ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

১৩

আজ দুই মাস হইতে চলিল, কয়েকজন ডাকাতির আসামীর সঙ্গে ভজুয়া হাজতে। সেদিন খানাতল্লাসিতে রমেশের বাড়ীতে সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায় নাই, এবং ভৈরব আচার্য্য সাক্ষ্য দিয়াছিল, সে রাত্রে ভজুয়া তাঁহার সঙ্গে তাঁহার মেয়ের পাত্র দেখিতে গিয়াছিল। তথাপি তাহাকে জামিনে খালাস দেওয়া হয় নাই। বেণী আসিয়া কহিল,—“রমা, অনেক চা’ল ভেবে তবে কাজ কর্‌তে হয় দিদি, নইলে কি শত্রুকে সহজে জব্দ করা যায়! সে দিন মনিবের হুকুমে যে ভজুয়া লাঠি হাতে ক’রে বাড়ী চড়াও হয়ে, মাছ আদায় কর্‌তে এসেছিল, সে কথা যদি না তুমি থানায় লিখিয়ে রাখ্‌তে, আজ কি তা হ’লে ঐ ব্যাটাকে এমন কায়দায় পাওয়া যেত! অমনি ঐ সঙ্গে রমেশের নামটাও যদি আরও দু’কথা বাড়িয়ে গুছিয়ে লিখিয়ে দিতিস্‌ বোন! আমার কথাটায় তখন তোরা ত কেউ কাণ দিলিনে!” রমা এম্‌নি ম্লান হইয়া উঠিল যে, বেণী দেখিতে পাইয়া কহিল,—“না না, তোমাকে সাক্ষী দিতে যেতে হবে না। আর তাই যদি হয়, তাতেই বা কি! জমিদারী কর্‌তে গেলে কিছুতেই হট‌্‌লে ত চলে না।” রমা কোন কথা কহিল না। বেণী কহিতে লাগিল,—“কিন্তু, তাকে ত অত সহজে ধরা চলে না! তবে সেও এবার কম চা’ল চাল্‌চে না দিদি! এই যে নূতন একটা ইস্কুল করেচে, এ নিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট পেতে হবে। এম্‌নিই তো মোচলমান প্রজারা জমিদার ব’লে মান্‌তে চায় না, তার ওপর যদি লেখাপড়া শেখে, তা হ’লে জমিদারী থাকা না থাকা সমান হবে, তা’ এখন থেকে ব’লে রাখ্‌চি।” জমিদারীর ভাল-মন্দ সম্বন্ধে রমা বরাবর বেণীর পরামর্শ মতই চলে; ইহাতে দুজনের কোন মতভেদ পর্য্যন্ত হয় না। আজ প্রথম রমা তর্ক করিল। কহিল,—“রমেশদা’র নিজের ক্ষতিও ত এতে কম নয়?” বেণীর নিজেরও এ সম্বন্ধে খট্‌কা অল্প ছিল না। সে ভাবিয়া চিন্তিয়া যাহা স্থির করিয়াছিল, তাহাই কহিল,—“কি জান রমা, এতে নিজের ক্ষতি ভাব্‌বার বিষয়ই নয়—আমরা দুজনে জব্দ হলেই ও খুসি। দেখ্‌চ না, এসে পর্য্যন্ত কি রকম টাকা ছড়াচ্ছে? চারিদিকে ছোটলোকদের মধ্যে ‘ছোটবাবু’ ‘ছোটবাবু’ একটা রব উঠে গেছে। যেন ওই একটা মানুষ, আর আমরা দুঘর কিছু নয়। কিন্তু, বেশিদিন এ চল্‌বে না। এই যে পুলিশের নজরে তাকে খাড়া ক’রে দিয়েচ বোন্‌, এতেই তাকে শেষ পর্য্যন্ত শেষ হ’তে হবে; তা’ বলে দিচ্চি।” বলিয়া বেণী মনে মনে একটু আশ্চর্য্য হইয়াই লক্ষ্য করিল, সংবাদটা শোনাইয়া তাহার কাছে যেরূপ উৎসাহ ও উত্তেজনা আশা করা গিয়াছিল, তাহার কিছুই পাওয়া গেল না। বরঞ্চ মনে হইল, সে হঠাৎ যেন একেবারে বিবর্ণ হইয়া গিয়া প্রশ্ন করিল,—“আমি লিখিয়ে দিয়েছিলাম, রমেশদা’ জান্‌তে পেরেছেন?” বেণী কহিল,—“ঠিক জানিনে। কিন্তু, জান্‌তে পার্‌বেই। ভজুয়ার মকদ্দমায় সব কথাই উঠবে।” রমা আর কোন কথা কহিল না। চুপ করিয়া ভিতরে-ভিতরে সে যেন একটা বড় আঘাত সামলাইতে লাগিল—তাহার কেবলই মনে উঠিতে লাগিল, রমেশকে বিপদে ফেলিতে সেই যে সকলের অগ্রণী, এই সংবাদটা আর রমেশের অগোচর রহিবে না। খানিক পরে মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—“আজকাল ওঁর নাম বুঝি সকলের মুখেই বড়দা?” বেণী কহিল,—“শুধু আমাদের গ্রামেই নয়, শুনচি, ওর দেখাদেখি আরও পাঁচছ’টা গ্রামে স্কুল কর্‌বার, রাস্তা তৈরি কর্‌বার আয়োজন হচ্চে। আজকাল ছোটলোকেরা সবাই বলাবলি কর্‌চে, সাহেবদের দেশে গ্রামে গ্রামে একটা দুটো ইস্কুল আছে বলেই ওদের এত উন্নতি। রমেশ প্রচার ক’রে দিয়েচে, যেখানেই নূতন ইস্কুল হবে, সেইখানেই ও দু’শ ক’রে টাকা দেবে।” ওর দাদামশায়ের যত টাকা পেয়েচে, সমস্তই ও এইতে ব্যয় কর্‌বে। মোচলমানেরা ত ওকে একটা পীর পয়গম্বর ব’লে ঠিক ক’রে ব’সে আছে।” রমার নিজের বুকের ভিতরের এই কথাটা একবার বিদ্যুতের মত আলো করিয়া, খেলিয়া গেল, যদি তাহার নিজের নামটাও এই সঙ্গে যুক্ত হইয়া থাকিতে পারিত! কিন্তু, মুহূর্ত্তের জন্য। পরক্ষণেই দ্বিগুণ আঁধারে তাহার সমস্ত অন্তরটা আচ্ছন্ন হইয়া গেল। বেণী কহিতে লাগিল,“কিন্তু, আমিও অল্পে ছাড়্‌ব না। সে যে আমাদের সমস্ত প্রজা এম্‌নি ক’রে বিগ্‌ড়ে তুল্‌বে, আর জমিদার হয়ে আমরা চোখ মেলে, মুখ বুজে দেখ্‌ব, সে যেন কেউ স্বপ্নেও না ভাবে। এই ব্যাটা ভৈরব আচার্য্য এবার ভজুয়ার হ’য়ে সাক্ষী দিয়ে কি ক’রে তার মেয়ের বিয়ে দেয়, সে আমি একবার ভাল ক’রে দেখ্‌ব! আরও একটা ফন্দি আছে—দেখি গোবিন্দখুড়ো কি বলে! তার পর দেশে ডাকাতি লেগেই আছে। এবার চাকরকে যদি জেলে পূরতে পারি, ত তার মনিবকে পূরতেও আমাদের বেশি বেগ পেতে হবে না। সেই যে প্রথম দিনটিতেই তুমি বলেছিলে রমা, শত্রুতা কর্‌তে ইনিও কম কর্‌বেন না, সে যে এমন সত্যি হয়ে দাঁড়াবে তা’ আমিও মনে করিনি।” রমা কোন কথাই কহিল না। নিজের প্রতিজ্ঞা ও ভবিষ্যদ্বাণী এমন বর্ণে-বর্ণে সত্য হওয়ার বার্ত্তা পাইয়াও যে নারীর মুখ অহঙ্কারে উজ্জ্বল হইয়া উঠে না, বরঞ্চ নিবিড় কালিমায় আচ্ছন্ন হইয়া যায়, সে যে তাহার কি অবস্থা, সে কথা বুঝিবার শক্তি বেণীর নাই। তা’ না থাকুক, কিন্তু, জিনিসটা এতই স্পষ্ট যে, কাহারই দৃষ্টি এড়াইবার সম্ভাবনা ছিল না—তাহারও এড়াইল না। মনে মনে একটু বিস্ময়াপন্ন হইয়াই বেণী রান্নাঘরে যাইয়া মাসীর সহিত দুই একটা কথা কহিয়া বাড়ী ফিরিতেছিল, রমা হাত নাড়িয়া তাহাকে কাছে ডাকিয়া মৃদুস্বরে কহিল,—“আচ্ছা বড়দা’, রমেশদা’ যদি জেলেই যান, সে কি আমাদের নিজেদের ভারি কলঙ্কের কথা নয়?” বেণী অধিকতর আশ্চর্য্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,—“কেন?” রমা কহিল,—“আমাদের আত্মীয়, আমরা যদি না বাঁচাই, সমস্ত লোক আমাদেরই ত ছি ছি ক’র্‌বে!” বেণী জবাব দিল,—“যে যেমন কাজ কর্‌বে, সে তার ফল ভুগ্‌বে, আমাদের কি?” রমা তেম্‌নি মৃদুকন্ঠে কহিল,—“কিন্তু, রমেশদা’ সত্যিই ত আর চুরি-ডাকাতি ক’রে বেড়ান না। বরং, পরের ভালর জন্যই নিজের সর্ব্বস্ব দিচ্চেন, সে কথা ত কারো কাছে চাপা থাক্‌বে না। তার পর আমাদের নিজেদেরও ত গাঁয়ের মধ্যে মুখ বার করতে হবে!” বেণী হি-হি করিয়া খুব খানিকটা হাসিয়া লইয়া কহিল,—“তোর হ’ল কি, বল্‌ত বোন্‌?” রমা এই লোকটার মুখের সঙ্গে রমেশের মুখখানা মনে মনে একবার দেখিয়া লইয়া আর যেন সোজা করিয়া মাথা তুলিতেই পারিল না। কহিল,—“গাঁয়ের লোক ভয়ে মুখের সাম্‌নে কিছু না বলুক, আড়ালে বল্‌বেই; তুমি বল্‌বে, আড়ালে রাজার মাকেও ডা’ন বলে, কিন্তু, ভগবান্‌ ত আছেন! নিরপরাধীকে মিছে করে শাস্তি দেওয়ালে তিনি ত রেহাই দেবেন না।” বেণী কৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া কহিল,—“হা রে আমার কপাল! সে ছোঁড়া বুঝি ঠাকুরদেবতা কিছু মানে! শীতলাঠাকুরের ঘরটা প’ড়ে যাচ্চে—মেরামত কর্‌বার জন্যে তার কাছে লোক পাঠাতে সে হাঁকিয়ে দিয়ে বলেছিল,—‘যারা তোমাদের পাঠিয়েছে, তাদের বল গে বাজে খরচ কর্‌বার টাকা আমার নেই। শোন কথা! এটা তার কাছে বাজে খরচ? আর কাজের খরচ হচ্চে, মোচলমানদের ইস্কুল ক’রে দেওয়া। তা’ ছাড়া বামুনের ছেলে,—সন্ধ্যে-আহ্নিক কিছুই করে না! শুনি, মোচলমানের হাতে জল পর্য্যন্ত খায়। দু’পাতা ইংরিজী প’ড়ে আর কি তার জাতজন্ম আছে দিদি, কিছুই নেই। শাস্তি তার গেছে কোথা, সমস্তই তোলা আছে; সে একদিন সবাই দেখ্‌তে পাবে।” রমা আর বাদানুবাদ না করিয়া মৌন হইয়া রহিল বটে, কিন্তু, রমেশের অনাচার এবং ঠাকুরদেবতার প্রতি অশ্রদ্ধার কথা স্মরণ করিয়া, মনটা তাহার আবার তাহার প্রতি বিমুখ হইয়া উঠিল। বেণী নিজের মনে কথা কহিতে কহিতে চলিয়া গেল। রমা অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত একভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া নিজের ঘরে গিয়া, মেঝের উপর ধপ্‌ করিয়া বসিয়া পড়িল। সে দিন তাহার একাদশী। খাবার হাঙ্গামা নাই মনে করিয়া আজ সে যেন স্বস্তিবোধ করিল।

পোস্টটি শেয়ার করুন