আদুভাই – আবুল মনসুর আহমদ

দুই

ডিসেম্বর মাস। 

সব ক্লাসের পরীক্ষা ও প্রমোশন হয়ে গিয়েছ। প্রথম বিবেচনা, দ্বিতীয় বিবেচনা, তৃতীয় বিবেচনা ও বিশেষ বিবেচনা ইত্যাদি সকল প্রকারের বিবেচনা হয়ে গিয়েছে। বিবেচিত প্রমোশন-প্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য বারের ন্যায় সেবারও পাস-করা প্রমোশন-প্রান্তের সংখ্যার দ্বিগুণেরও ঊর্ধ্বে উঠেছে।

কিন্তু আদুভাই এসব বিবেচনার বাইরে। কাজেই তার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে আমরা টিউটরিয়েল ক্লাস করছিলাম। ছাত্ররা শুধু শুধু কুলপ্রাঙ্গণে জটলা করছিল-প্রমোশন পাওয়া ছেলেরা নিজেদের কীর্তি-উজ্জ্বল চেহারা দেখাবার জন্য, আর না-পাওয়া ছেলেরা প্রমোশনের কোনো প্রকার অতিরিক্ত বিশেষ বিবেচনার দাবি জানাবার জন্য।

এমন দিনে একটু নিরালা জায়গায় পেয়ে হঠাৎ আদুভাই আমার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। আমি চমকে উঠলাম। আদুভাইকে আমরা সবাই মুরুব্বি মানতাম। তাই তাকে ক্ষিপ্রহতে টেনে তুলে প্রতিদানে তার পা ছুঁয়ে বললাম : কী হয়েছে আদুভাই, অমন পাগলামি করলেন কেন?

আদুভাই কম্পিত কণ্ঠে বললেন : প্রমোশন।

আমি বিস্মিত হলাম; বললাম ; প্রমোশন? প্রমোশন কী? আপনি প্রমোশন পেয়েছেন? 

: না, আমি প্রমোশন পেতে চাই।। 

: ও, পেতে চান? সে তো সবাই চায়।

আদুভাই অপরাধীর ন্যায় উদ্বেগ-কম্পিত ও সংকোচ-জড়িত প্যাঁচ-মোচড় দিয়ে যা বললেন, তার মর্ম এই যে : প্রমোশনের জন্য এতদিন তিনি কারো কাছে কিছু বলেননি; কারণ, প্রমোশন জিনিসটাকে যথাসময়ের পূর্বে এগিয়ে আনাটা তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে এবার তাঁকে প্রমোশন পেতেই হবে। সে নির্জনতায়ও তিনি আমার কানের কাছে মুখ এনে সেই কারণটি বললেন। তা এই যে, আদুভাইর ছেলে সেবার ক্লাস সেভেনে প্রমোশন পেয়েছে। নিজের ছেলের প্রতি আদুভাইয়ের কোনো ঈর্ষা নেই। কাজেই ছেলের সঙ্গে এক শ্রেণীতে পড়ার তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু আদুভাইয়ের স্ত্রীর তাতে ঘোরতর আপত্তি আছে। ফলে, হয় আদুভাইকে এবার প্রমোশন পেতে হবে, নয়তো পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হবে। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে আদুভাই। বাঁচবেন কী নিয়ে?

আমি আদুভাইয়ের বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারলাম। তার অনুরোধে আমি শিক্ষকদের কাছে সুপারিশ করতে যেতে রাজি হলাম। 

প্রথমে ফারসি-শিক্ষকের কাছে যাওয়া স্থির করলাম। কারণ, তিনি একদা আমাকে মোট একশত নম্বরের মধ্যে একশত পাঁচ নম্বর দিয়েছিলেন। বিস্মিত হেডমাস্টার তার কারণ জিজ্ঞেস করায় মৌলবি সাব বলেছিলেন : ‘ছেলে সমস্ত প্রশ্নের শুদ্ধ উত্তর দেওয়ায় সে পূর্ণ নম্বর পেয়েছে। পূর্ণ নম্বর পাওয়ার পুরস্কার স্বরূপ আমি খুশি হয়ে তাকে পাঁচ নম্বর বখশিশ দিয়েছি। অনেক তর্ক করেও হেডমাস্টার মৌলবি সাবকে এই কাজের অসঙ্গতি বুঝতে পারেননি।

মৌলবি সাব আদুভাইয়ের নাম শুনে জ্বলে উঠলেন। অমন বেতমিজ ও খোদার না-ফরমান বান্দা তিনি কখনো দেখেননি বলে আস্ফালন করলেন এবং অবশেষে টিনের বাক্স থেকে অনেক খুঁজে আদুভাইয়ের খাতা বের করে আমার সামনে ফেলে দিয়ে বললেন : দেখ। 

আমি দেখলাম, আদুভাই মোটে তিন নম্বর পেয়েছে। তবু হতাশ হলাম না। পাসের নম্বর দেওয়ার জন্য তাকে চেপে ধরলাম। 

বড় দেরি হয়ে গিয়েছে, নম্বর সাবমিট করে ফেলেছেন, বিবেচনার তর পার হয়ে গিয়েছে ইত্যাদি সমস্ত যুক্তির আমি সন্তোষজনক জবাব দিলাম। তিনি বললেন : তুমি কার জন্য, কী অন্যায় অনুরোধ করছ; খাতাটা খুলেই একবার দেখ না ।

আমি মৌলবি সাবকে খুশি করবার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও এবং অনাবশ্যক বোধেও খাতাটা খুললাম। দেখলাম : ফারসি পরীক্ষা বটে, কিন্তু খাতার কোথাও একটি ফারসি হরফ নেই। তার বদলে ঠাস-বুনানো বাংলা হরফে অনেক কিছু লেখা আছে। কৌতূহলবশে পড়ে দেখলাম : এই বঙ্গদেশে ফারসিভাষা আমদানির অনাবশ্যকতা ও ছেলেদের তা শিখবার চেষ্টার মূখতা সম্বন্ধে আদুভাই যুক্তিপূর্ণ একটি থিসিস’ লিখে ফেলেছেন।

পড়া শেষ করে মৌলবি সাবের মুখের দিকে চাইতেই বিজয়ের ভঙ্গিতে বললেন : দেখেছ বাবা বেতমিজের কাজ? আমি নিতান্ত ভালো মানুষ বলেই তিনটে নম্বর দিয়েছি, অন্য কেউ হলে রাসটিকেটের সুপারিশ করত।

যাহোক, শেষ পর্যন্ত মৌলবি সাব আমার অনুরোধ এড়াতে পারলেন না। খাতার উপর ৩-এর পৃষ্ঠে ৩ বসিয়ে ৩৩ করে দিলেন।

আমি বিপুল আনন্দে অঙ্কের পরীক্ষকের বাড়ি ছুটলাম।

সেখানে আদুভাইয়ের খাতার উপর লাল পেন্সিলের একটি প্রকাণ্ড ভূমণ্ডল আঁকা রয়েছে। ব্যাপারের গুরুত্ব বুঝেও আমার উদ্দেশ্য বললাম। অঙ্কের মাস্টার তো হেসেই খুন। হাসতে-হাসতে তিনি আদুভাইয়ের খাতা বের করে আমাকে অংশবিশেষ পড়ে শোনালেন। তাতে আদুভাই লিখেছেন যে, প্রশ্নকর্তা ভালো-ভালো অঙ্কের প্রশ্ন ফেলে কতকগুলো বাজে ও অনাবশ্যক প্রশ্ন করেছেন। সেজন্য এবং প্রশ্নকর্তার ত্রুটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে আদুভাই নিজেই কতিপয় উৎকৃষ্ট প্রশ্ন লিখে তার বিশুদ্ধ উত্তর দিচ্ছে-এইরূপ ভূমিকা করে আদুভাই যে-সমত অঙ্ক করেছেন, শিক্ষক মহাশয় প্রশ্নপত্র ও খাতা মিলিয়ে আমাকে দেখালেন যে, প্রশ্নের সঙ্গে আদুভাইর উত্তরের সত্যিই কোনো সংস্রব নেই।

প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিল থাক, খাতায় লেখা অঙ্ক শুদ্ধ হলেই নম্বর পাওয়া উচিত বলে আমি শিক্ষকের সঙ্গে অনেক ধস্তাধস্তি করলাম। শিক্ষক মশায়, যাহোক, প্রমাণ করে দিলেন যে, তাও শুদ্ধ হয়নি।

সুতরাং পাসের নম্বর দিতে তিনি রাজি হলেন না। তবে তিনি আমাকে এই আশ্বাস দিলেন যে, অন্য সব সাবজেক্টের শিক্ষকদের রাজি করাতে পারলে তিনি আদুভাইয়ের প্রমোশনে সুপারিশ করতে প্রস্তুত আছেন।

নিতান্ত বিষপ্নমনে অন্যান্য পরীক্ষকদের নিকটে গেলাম। সর্বত্র অবস্থা প্রায় একরুপ। ভূগোলের খাতায় তিনি লিখেছেন যে, পৃথিবী গোলাকার এবং সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে, এমন গাঁজাখুরি গল্প তিনি বিশ্বাস করেন না। ইতিহাসের খাতায় লিখেছেন যে, কোন রাজা কোন সম্রাটের পুত্র এসব কথার কোনো প্রমাণ নেই। ইংরেজির খাতায় তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের ছবি পাশাপাশি আঁকবার চেষ্টা করেছেন – অবশ্য কে যে সিরাজ, কে যে ক্লাইভ, নিচে লেখা না থাকলে তা বোঝা যেত না।

হতাশ হয়ে হোস্টেলে ফিরে এলাম। আদুভাই আগ্রহ-ব্যাকুল চোখে আমার পথপানে চেয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

আমি ফিরে এসে নিষ্ফলতার খবর দিতেই তার মুখটি ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

তবে আমার কী হবে ভাই? বলে তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

কিছু একটা করবার জন্য আমার প্রাণও ব্যাকুল হয়ে উঠল। বললাম : তবে কি আদুভাই, আমি হেডমাস্টারের কাছে যাব?

আদুভাই ক্ষণিক আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বললেন : তুমি আমার জন্য যা করেছ, সেজন্য ধন্যবাদ। হেডমাস্টারের কাছে তোমার গিয়ে কাজ নেই। সেখানে যেতে হয় আমিই যাব। হেডমাস্টারের কাছে। জীবনে আমি কিছু চাইনি। এই প্রার্থনা তিনি আমার ফেলতে পারবেন না।

বলেই তিনি হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।

আমি একদৃষ্টে দ্রুতগমনশীল আদুভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম। তিনি দৃষ্টির আড়াল হলে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলাম। 

পোস্টটি শেয়ার করুন