লালসালু – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

লালসালু
– সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

শ্রাবণের শেষাশেষি একদিন। হাওয়া-শূন্য শুদ্ধতায় বিস্তৃত ধানখেত নিথর। কোথাও একটু কম্পন নেই। আকাশে মেঘ নেই।

এমন দিনে লোকেরা ধানখেতে নৌকা নিয়ে বেরোয়। ডিঙিতে দুজন করে, সঙ্গে কোচ-জুতি। ধানখেতে নিঃশব্দতা, কোথাও একটা কাক আর্তনাদ করে উঠলে মনে হয় আকাশটা বুঝি চটের মতো চিরে গেল। অতি সন্তর্পণে ধানের ফাকে ফাকে তারা নৌকা চালায়। ঢেউ হয় না, শব্দ হয় না। গলুইয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে এক জন, চোখে ধারালো। দৃষ্টি। ধানের ফাকে ফাকে সে দৃষ্টি এঁকেবেঁকে চলে।

বিস্তৃত ধানখেতের একপ্রান্তে তাহের, কাদেরও আছে। তাহের দাঁড়িয়ে সামনে, চোখে তার যেন শিকারীর একাগ্রতা । পেছনে মূর্তির মতো বসে কাদের ভাইয়ের ইশারার অপেক্ষায় থাকে । দাড় বাইছে কিন্তু এমন কৌশলে যে, মনে হয় নিচে পানি নয়, তুলো।

হঠাৎ তাহের ঈষৎ কেঁপে উঠে মুহূর্তে শক্ত হয়ে যায়। সামনের পানে চেয়ে থেকেই আঙুল দিয়ে ইশারা করে। সামনে, বায়ে আরও বাঁয়ে। সাবধান, আতে। তাহেরের আঙুল অত ক্ষিপ্রতায় এসব নির্দেশই দেয়।

ততক্ষণে সে পাশ থেকে আলগোছে কোঁচটা তুলে নিয়েছে। নিতে একটু শব্দ হয়নি। হয়নি তার প্রমাণ, ধানের শীষ এখনও ওখানে নড়ছে। তারপর কয়েকটি নিঃশ্বাসরুদ্ধ করা মুহূর্ত। দূরে যে-কটা নৌকা ধানখেতের ফাকে ফাকে এমনি নিঃশব্দে ভাসছিল সেগুলো থেমে যায়। লোকেরা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ধনুকের মতো টান হয়ে ওঠা তাহেরের কালো দেহটির পানে। তারপর দেখে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো সে কালো দেহটির উর্বাংশ কেঁপে উঠল, তীরের মতো বেরিয়ে গেল একটা কোচ। সা-ঝাক।

একটু পরে বৃহৎ একটা রুই মুখ হাঁ করে ভেসে ওঠে। আবার নৌকা চলে। ধীরে ধীরে, সন্তর্পণে। এক সময় ঘুরতে ঘুরতে তাহেরদে নৌকা মতিগঞ্জের সড়কটার কাছে এসে পড়ে। কাদের পিছনে বসে তেমনি নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তাহেরের পানে তার আঙুলের ইশারার জন্য। হঠাৎ এক সময় দেখে, তাহের সড়কপানে চেয়ে কী দেখছে। সেও সেদিক তাকায়। দেখে মতিগঞ্জের সড়কের ওপরেই একটি অপরিচিত লোক আকাশের পানে হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, শীর্ণ মুখে ক-গাছি দাড়ি, চোখ নিমীলিত, মুহূর্তের পর মুহূর্ত কাটে, লোকটির চেতনা নেই। নিরাক-পরা আকাশ যেন তাকে পথিকমূর্তিতে রূপান্তরিত করেছে।

কাদের আর তাহের অবাক হয়ে চেয়ে দেখে। মাছকে সতর্ক করে দেবার ভয়ে কথা কয় না। কিন্তু পাশেই একবার ধানের শিষ স্পষ্টভাবে নড়ে ওঠে, ঈষৎ আওয়াজ হয়, সেদিকে দৃষ্টি নেই। 

এক সময়ে লোকটি মোনাজাত শেষ করে কিছুক্ষণ কী ভেবে ঝট করে পাশে নামিয়ে রাখা পুঁটলিটা তুলে নেয়। তারপর বড় বড় পা ফেলে উত্তর দিকে হাঁটতে থাকে। উত্তর দিকে খানিকটা এগিয়ে মহব্বতনগর গ্রাম। তাহের ও কাদেরের বাড়ি সেখানে।

অপরাহ্নের দিকে মাছ নিয়ে দু ভাই বাড়ি ফিরে দেখে খালেক ব্যাপারীর ঘরে কেমন একটা জটলা। সেখানে গ্রামের লোকেরা আছে, তাহেরের বাপও আছে। সকলের কেমন গভীর ভাব, সবার মুখ চিন্তায় নত। ভেতরে উঁকি মেরে দেখে, একটু আলগা হয়ে বসে আছে সেই লোকটা। নৌকা থেকে মতিগঞ্জের সড়কের ওপর তখন তাকে মোনাজাত করতে দেখেছিল। রোগা লেকি, বয়সের ভারে যেন চোয়াল দুটো উজ্জ্বল, চোখ বুজে আছে। কোটরাগত সে চোখে একটু কম্পন নেই। 

এভাবেই মজিদের প্রবেশ হল মহব্বতনগর গ্রামে। শীর্ণ এ লোকটি চিৎকার করে গালাগালি করে লোকদের। খালেক ব্যাপারী ও মাতব্বর রেহান আলী ছিল। জোয়ানমতি, কালুমতি তারাও ছিল। কিন্তু লজ্জায় তাদের মাথা হেঁট ! নবাগত লোকটির চোখে আগুন। 

আপনারা জাহেল, বে এলেম, আনপড়াহ। মোদাচ্ছের পীরের মাজারকে আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন? গ্রাম থেকে একটু বাইরে একটা বাঁশঝাড়। সে বাঁশঝাড়ের ক-গজ ওধারে একটা পরিত্যক্ত পুকুরের পাশে ঘন হয়ে আছে গাছপালা। তারই একধারে ভাঙা এক প্রাচীন কবর। ওরা কী করে জানবে যে, ওটা মোদাচ্ছের পীরের মাজার। সভায় অশীতিপর বৃদ্ধ সুলেমানের বাপও ছিল। হাঁপানি রোগী। সে দম খিচে লজ্জায় মাথা নত করে রাখে।

‘আমি ছিলাম গারো পাহাড়ে। মধুপুর গড় থেকে তিন দিনের পথ। মজিদ বলে যে, সেখানে সে সুখে শান্তিতেই ছিল। গোলাভরা ধান, গরুছাগল। তবে সেখানকার মানুষেরা কিন্তু অশিক্ষিত, বর্বর। তাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ খোদার আলো ছড়াবার জন্যই অমন বিদেশ বিভুঁইয়ে সে বসবাস করছিল। তারা বর্বর হলে কী হবে, দিল তাদের সাচ্চা, খাঁটি সোনার মতো। খোদা রসুলের ডাক একবার দিলে পৌঁছে দিতে পারলে তারা বেচইন হয়ে যায়। তা ছাড়া তাদের খাতির মমতার মধ্যে বেশ দিন কাটছিল। কিন্তু সে একদিন স্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্নই তাকে নিয়ে এসেছে এত দূরে।

লোকেরা ইতোমধ্যে বারকয়েক শুনেছে সে কথা। তবু আবার উৎকর্ণ হয়ে ওঠে।

উনি একদিন স্বপ্নে ডেকে বললেন… বলতে বলতে মজিদের চোখ দুটো পানিতে ছাপিয়ে ওঠে।

জঙ্গল সাফ হয়ে গেল। ইট সুরকি নিয়ে সেই প্রাচীন কবর নতুন দেহ ধারণ করল। ঝালরওয়ালা লালসালু দ্বারা আবৃত হল সে কবর। আগরবাতি গন্ধ ছড়াতে লাগল, মোমবাতি জ্বলতে লাগল রাতদিন।

এ গ্রাম সে গ্রাম থেকে লোকেরা আসতে লাগল। ক্রমে ক্রমে ঘরবাড়ি উঠল। বাহির ঘর, অন্দর ঘর, গোয়ালঘর, আওলাঘর। জমি হল, গৃহস্থালি হল। গ্রামের লোকেরা যেন চেনে জমি আর ধান। খোদার কথা নেই। মরণ করিয়ে দিলে আছে নচেৎ ভুল মেনে থাকে। জমিতে খরার দিনে ফাটল ধরলে তখন কেবল স্মরণ হয় খোদাকে।

কিন্তু জমি একাধারে উর্বর, চারা ছড়িয়েছে কি সোনা ফলবে। মানুষরাও পরিশ্রম করে, জমিও সে শ্রমের সম্মান দেয় বুক উজাড় করে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেই তারা খাটে। হয়তো কাঠফাটা রোদ, হয়তো মুষলধারে বৃষ্টি -তারা পরিশ্রম করে চলে। এত শ্রম এত কষ্ট তবু ভাগ্যের ঠিক-ঠিকানা নেই। মাঠের এক প্রান্তে একাকী দাঁড়িয়ে মজিদ দাঁত খেলল। করে আর সে কথাই ভাবে। কাতারে কাতারে সারবন্দি হয়ে মজুররা ধান কাটে আর বুক ফাটিয়ে গীত গায় ; তখন মজিদ দূরে দাঁড়িয়ে দেখে আর ভাবে, কিসের এত গান, এত আনন্দ? ওদের খোদার ভয় নেই? মজিদও চায় তার গোলা ভরে উঠক ধানে। কিন্তু সে তো জমিকে ধন মনে করে না, আপন রক্তমাংসের সামিল খেয়াল করে না। জমায়েতকে মজিদ বলে, খোদাই রিজিক দেনেওয়ালা। শুনে সালু কাপড়ে ঢাকা কবরের পাশে তারা তন্ধ হয়ে যায়।

মজিদ বলে, মাঠভরা ধান দেখে যাদের মনে মাটির প্রতি পূজার ভাব জাগে, তারা ভূতপূজারী। তারা গুনাহ্গার। জমায়েত মাথা হেঁট করে থাকে। 


পোস্টটি শেয়ার করুন