অপূর্ব ক্ষমা – মীর মশাররফ হোসেন
অপূর্ব ক্ষমা
– মীর মশাররফ হোসেন
অনুজের হস্ত ধরিয়া হাসান নিজ শয্যার উপরে বসাইয়া মুখে বারবার চুম্বন দিয়া বলিতে লাগিলেন, ভাই, আমি যে কষ্ট পাইতেছি তাহা মুখে বলিবার শক্তি নাই। পূর্ব আঘাত, পূর্ব পীড়া এই উপস্থিত যন্ত্রণায় সকলি ভুলিয়া গিয়াছি। দেখত, আমার মুখের বর্ণ কি পরিবর্তিত হইয়াছে?
ভ্রাতার মুখপানে দৃষ্টিপাত করিয়া হোসেন কাঁদিতে লাগিলেন। আর আর সকলে বলিতে লাগিল, আহা ! জ্যোতির্ময় চন্দ্রবদনে বিষাদনীলিমার রেখা পড়িয়াছে।
এই কথা শুনিয়া হাসান অনুজকে বলিলেন, ভাই, বৃথা কাঁদিয়া লাভ কী? আমার আর বেশি বিলম্ব নাই; চিরবিদায়ের সময় অতি নিকট। মাতামহ যাহা বলিয়াছিলেন, সকলি প্রত্যক্ষ করিতেছি। ভাই, মাতামহ সশরীরে ঈশ্বরের আদেশে একবার ঈশ্বরের স্থানে নীত হইয়াছিলেন। সেখানে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে অতি রমণীয় দুইটি ঘর সুসজ্জিত দেখিলেন। একটি সবুজ বর্ণ, আর একটি লোহিত বর্ণ। কাহার ঘর, প্রহরীকে এই কথা জিজ্ঞাসা করাতে প্রহরী উত্তর করিল, আপনার অন্তরের নিধি হৃদয়ের ধন এবং নয়নের পুত্তলি হাসান-হোসেনের জন্য দুইটি ঘর প্রতুত হইয়াছে। ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের কারণ জিজ্ঞাসা করাতে প্রহরী কঁপিয়া নতশির হইল, কোনো উত্তর করিল না। জিব্রাইল সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন। তিনিই মাতামহকে বলিলেন, হায় মুহম্মদ! দ্বারবান কারণ প্রকাশে লজ্জিত হইতেছে, আমি আপনি যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহাই বলিতে আজ্ঞাপ্রাপ্ত হইয়াছি। নিদারুণ গুপ্ত কথা হইলেও আজ আমি আপনার নিকটে ব্যক্ত করিব। ঐ দুইটি ঘর ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের হইবার কারণ কী উহার সবিশেষ বৃত্তান্ত বলিতেছি শ্রবণ করুন। সবুজ বর্ণ গৃহ আপনার জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র হাসানের জন্য; লোহিতবর্ণ কনিষ্ঠ হোসেনের জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। আপনার অভাবে একদল পিশাচ শত্রুতা করিয়া হাসানকে বিষ পান করাইবে এবং মৃত্যুসময়ে হাসানের মুখ সবুজ বর্ণ হইবে। তন্নিমিত্ত ঐ গৃহটি সবুজ বর্ণ। ঐ শত্রুগণ অস্ত্রদ্বারা আপনার কনিষ্ঠ দৌহিত্র হোসেনের মস্তকছেদন করিবে। ঐ রক্তমাখা মুখের চিহ্নই লোহিতবর্ণের কারণ। মাতামহের বাক্য আজ সফল হইল । আমার মুখের বর্ণ যখন বিবর্ণ হইয়াছে, তখন পরমায়ুও আজ শেষ হইয়াছে। মাতামহের বাক্য অলঙ্ঘনীয় ভাই, ঈশ্বরের কার্যও অখণ্ডনীয়।
সবিষাদে এবং সরোষে হোসেন বলিতে লাগিলেন, আমি আপনার চির আজ্ঞাবহ দাস, বিশেষ স্নেহের পাত্র এবং চিরআশীর্বাদের আকাক্ষী, মিনতি করিয়া বলিতেছি, বলুন তো, আপনাকে এ বিষ কে দিয়াছে?
ভাই! তুমি কী জন্য বিষদাতার নাম জিজ্ঞাসা করিতেছ? তুমি কি তাহার প্রতিশোধ নিবে?
হোসেন শয্যা হইতে উঠিয়া অতিশয় রোষভাবে দুঃখিত স্বরে বলিতে লাগিলেন, আমার প্রাণের পূজনীয় ভ্রাতাকে- এক মাতার উদরে যে ভ্রাতা অগ্রে জন্মিয়াছেন, সেই ভ্রাতাকে, আমি বাঁচিয়া থাকিতে যে নরাধম বিষ পান করাইয়াছে সে কি অমনিই বাঁচিয়া যাইবে? আমি কি এমনই দুর্বল, আমি কি এমনই নিঃসাহসী, আমি কি এমনই ক্ষীণকায়, আমি কি এমনই কাপুরুষ, আমার হৃদয়ে কি রক্ত নাই, ভ্রাতৃস্নেহ নাই যে, ভ্রাতার প্রাণনাশক বিষম্প্রদায়কের প্রতিশোধ লইতে পারিব না? যে আজ আমার একটি বাহু ভগ্ন করিল, অমূল্যধন সহোদর রত্ন হইতে যেআজ আমাকে বঞ্চিত করিল, আমি কি তাহার কিছুই করিব না? যদি সে নরাধমের কোনো সন্ধান জানিয়া থাকেন, যদি তাহাকে চিনিয়া থাকেন, যদি অনুমানে কিছু অনুভব করিয়া থাকেন, এ আজ্ঞাবহ চিরকিঙ্করকে বলুন, আমি এখনই আপনার সম্মুখে তাহার প্রতিবিধান করিতেছি। সেই পাপাত্মা বিজনবনে, পর্বতগুহায়, অতল জলে, সপ্ততল মৃত্তিকা মধ্যে যেখানে হউক, হোসেনের হস্ত হইতে তাহার পরিত্রাণ নাই। হয় আমার প্রাণ তাহাকে দিব, নয় তাহার প্রাণ আমি লইব।