অপূর্ব ক্ষমা – মীর মশাররফ হোসেন

অনুজের হত ধরিয়া নিকটে বসাইয়া হাসান বলিতে লাগিলেন, ভাই, স্থির হও। আমি আমার বিষদাতাকে চিনি। সে আমার সহিত যেরূপ ব্যবহার করিল, আমি সমুদয়ই জানিতে পারিয়াছি। ঈশ্বরই তাহার বিচার করিবেন। আমার কেবল এইমাত্র আক্ষেপ যে, অকারণে আমাকে নির্যাতন করিল। আমার ন্যায় অনুগত স্নেহশীল বন্ধকে বধ করিয়া সে যে কী সুখ মনে করিল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। যে কারণেই হউক, যে লাভেই হউক, যে আশায়ই হউক, নিরপরাধে যে আমাকে। নির্যাতন করিয়া চিরবন্ধর প্রাণবধ করিল, দয়াময় পরমেশ্বর তাহার আশা কখনই পূর্ণ করিবেন না। দুঃখের বিষয় এই যে, সে আমাকে চিনিতে পারিল না। যাহা হউক, ভাই, তাহার নাম আমি কখনই মুখে আনিব না। তাহার প্রতি আমার রাগ হিংসাদ্বেষ কিছুই নাই। ঈশ্বরের নামে শপথ করিয়া বলিতেছি, আমার বিষদাতার মুক্তির জন্য ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিব। যে পর্যন্ত ঈশ্বরের নিকট হইতে তাহাকে মুক্ত করাইতে না পারি, সে পর্যন্ত স্বর্গের সোপানে পা রাখিব না। ভাই! ক্রমেই আমার বাকশক্তি রোধ হইতেছে। কত কথা মনে ছিল কিছুই বলিতে পারিলাম না। চতুর্দিক যেন অন্ধকারময় দেখিতেছি।

আবুল কাসেমের হত ধরিয়া হোসেনের হতে সমর্পণ করিয়া স্নেহা চিত্তে হাসান কাতরস্বরে পুনরায় কহিতে লাগিলেন, ভাই, ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ মানিয়া আজ আমি তোমার হতে কাসেমকে দিলাম। কাসেমের বিবাহ দেখিতে বড় সাধ ছিল, পাত্রীও স্থির করিয়াছিলাম, সময় পাইলাম না। হোসেনের হত ধরিয়া আবার কহিলেন, ভাই ঈশ্বরের দোহাই, আমার অনুরোধ, তোমার কন্যা সখিনার সহিত কাসেমের বিবাহ দিও। আর ভাই আমার বিষদাতার যদি সন্ধান পাও কিংবা কোনো সূত্রে যদি ধরা পড়ে, তবে তাহাকে কিছু বলিও না। ঈশ্বরের দোহাই, তাহাকে ক্ষমা করিও। যন্ত্রণাকুল ইমাম ব্যাকলভাবে অনুজকে এই পর্যন্ত বলিয়া সস্নেহ বচনে কাসেমকে বলিলেন, কাসেম, বত্স আর্শীবাদ করি তুমি চিরজীবী হও। আর বাপ। এই কবচটি সর্বদা হতে বাঁধিয়া রাখিও। যদি কখনও বিপদগ্রস্ত হও সে বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার উপায় যদি নিজ বুদ্ধিতে কিছুতেই স্থির করিতে না পার তবে এই কবচের অপর পৃষ্ঠে লক্ষ করিও; যাহা লেখা দেখিবে সেইরূপে কার্য করিবে। সাবধান তাহার অন্যথা করিও না।

কিয়ৎক্ষণ পর নিতন্ধ থাকিয়া উপর্যুপরি তিন চারিটি নিঃশ্বাস ফেলিয়া হোসেনকে সম্বোধনপূর্বক মুমূষু হাসান পুনরায় কহিলেন, ভাই, ক্ষণকালের জন্য তোমরা সকলে একবার বাহিরে যাও। কেবল জাএদা একাকিনী এখানে উপস্থিত থাকুন। জাএদার সহিত নির্জনে আমার একটি বিশেষ কথা আছে।

সকলেই আজ্ঞা পালন করিলেন। শয্যার নিকটে জাএদাকে ডাকিয়া হাসান চুপি চুপি বলিতে লাগিলেন, জাএদা, তোমার চক্ষ হইতে হাসান এখন বিদায় হইতেছে, আর্শীবাদ করি, সুখে থাক। তুমি যে কার্য করিলে সমতই আমি জানিতে পারিয়াছি। তোমাকে বড়ই বিশ্বাস করিতাম। বড়ই ভালোবাসিতাম, তাহার উপযুক্ত কার্যই তুমি করিয়াছ। ভালো, সুখে থাক, আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম। হোসেনকেও ক্ষমা করিতে বলিয়াছি; তাহাও তুমি স্বকর্ণে শ্রবণ করিয়াছ। ভিতরের নিগূঢ় কথা যদি আমি হোসেনকে বলিতাম, তাহা হইলে যে কী অনর্থ সংঘটিত হইত, তাহা তুমি বুঝিতেই পারিতেছ। যাহা হউক আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম। কিন্তু যিনি সর্বসাক্ষী, সর্বময়, সর্বক্ষমার অধিকারী, তিনি তোমাকে ক্ষমা করিবেন কিনা বলিতে পারি না; তথাপি তোমার মুক্তির জন্য সর্বপ্রযত্নে সেই মুক্তিদাতার নিকট পুনঃপুন প্রার্থনা করিব। যে পর্যন্ত তোমাকে মুক্ত করাইতে না পারিব সেই পর্যন্ত আমি স্বর্গের সোপানে পা রাখিব না।

জাএদা অধোমুখে অশু বিসর্জন করিলেন, একটিও কথা কহিলেন না। সময়োচিত সংকেতধ্বনি শ্রবণে হোসেনের সহিত আর আর সকলেই গৃহমধ্যে পুনঃপ্রবেশ করিলেন। হাসান একে একে সকলের নিকট বিদায় লইলেন। হাসনেবানু ও জয়নাবের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া নিজকৃত অপরাধের মার্জনা চাহিলেন। শেষে হোসেনকে কহিলেন, হোসেন, এসো ভাই, জন্মের মতোন তোমার সহিত আলিঙ্গন করি। এই বলিয়া অনুজের গলা ধরিয়া সাশুনয়নে আবার বলিতে লাগিলেন, ভাই সময় হইয়াছে, ঐ মাতামহ স্বর্গের দ্বারে দাঁড়াইয়া ডাকিতেছেন। চলিলাম। এই শেষ কথা বলিয়াই ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে দয়াময় ইমাম হাসান সর্বসমক্ষে প্রাণত্যাগ করিলেন। হাসনেবানু, জয়নাব, কাসেম ও আর সকলে হাসানের পদলুণ্ঠিত হইয়া মাথা ভাঙিয়া কাঁদিতে লাগিলেন, জাএদা কাঁদিয়াছিলেন কিনা, তাহা কেহ লক্ষ করেন নাই। 


পোস্টটি শেয়ার করুন