মানুষ কী নিয়ে বাঁচে – লিও টলস্টয়
নয়
সাইমন তার কাছে গিয়ে বলল :“এইবার সব কথা খুলে বলো তো মিখাইল।”
হাতের কাজ সরিয়ে রেখে মিখাইল বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল। অ্যাপ্রনটা খুলে মুচি আর তার বউকে নমস্কার করে বলল : “তোমরা দুজনে আমাকে ক্ষমা করো। ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করেছেন। তোমরাও ক্ষমা করো।”
উভয়ে দেখতে পেল, মিখাইলকে ঘিরে একটা আলো ঝলমল করছে। সাইমন দাড়িয়ে মিখাইলকে নমস্কার জানিয়ে বলল : “বুঝলাম মিখাইল, তুমি সাধারণ মানুষ নও, তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করাও চলে না। শুধু একটা কথা বলো : প্রথম সাক্ষাতের পরে তোমাকে যখন বাড়ি নিয়ে আসি তখনই বা তুমি বিষন্ন ছিলে কেন, আবার আমার স্ত্রী যখন তোমাকে রাতের। খাবার পরিবেশন করল তখনই বা তুমি হাসলে কেন? তারপর, সেই ভদ্রলোক যখন বুটের অর্ডার দিলেন, তখনই ভূমি দ্বিতীয়বার হাসলে কেন? এবং এইমাত্র স্ত্রীলোকটি যখন মেয়েদুটিকে নিয়ে এল তখনই বা তুমি তৃতীয়বার হাসলে কেন? বলো মিখাইল, তোমার চারদিকে এমন আলো কেন, আর কেনই বা তুমি তিনবার হেসেছ?”
মিখাইল বলল :“আমার শাস্তি হয়েছিল, কিন্তু এখন ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করেছেন, তাই এই আলো। আমি তিনবার হেসেছি, কারণ তিনটি ঐশ্বরিক সত্য আমার জানবার ছিল। ঈশ্বরের সেই সত্য আমি জেনেছি। প্রথম সত্য জানলাম যখন তোমার স্ত্রী আমার প্রতি করুণা করল; তাই আমি প্রথমবার হাসলাম। আরেকটি সত্য জানলাম যখন ধনীলোকটি বুটের অর্ডার দিল, তাই দ্বিতীয়বার হাসলাম। এখন এই মেয়েটিকে দেখে আমি তৃতীয় এবং শেষ সত্যটি জানলাম। তাই তৃতীয়বার হাসলাম।”
সাইমন বলল :“বলো মিখাইল, কেন ঈশ্বর তোমাকে শাস্তি দিয়েছিলেন, আর ঈশ্বরের সত্য তিনটিই বা কী? সব আমি জানতে চাই।”
মিখাইল বলল : “ঈশ্বরের আদেশ আমি অমান্য করেছিলাম, তাই তিনি আমাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। আমি ছিলাম স্বর্গের দেবদূত। ঈশ্বরকে আমি অমান্য করেছিলাম।”
“আমি স্বর্গের দেবদূত ছিলাম। ঈশ্বর আমাকে পাঠিয়েছিলেন একটি স্ত্রীলোকের আত্মা নিয়ে যেতে। পৃথিবীতে উড়ে গিয়ে দেখলাম একটি স্ত্রীলোক অসুস্থ হয়ে একাকী শুয়ে আছে। সবেমাত্র তার দুটি যমজ সন্তান জন্মেছে—দুটি মেয়ে! মেয়েদুটি মায়ের পাশে পড়ে আছে, ওদের যে দুধ খাওয়াবে সেই শক্তিও প্রসূতির নেই। শ্রীলোকটি আমাকে দেখতে পেল, বুঝতে পারল তার আত্মা নিতেই আমি এসেছি। চোখের জল ফেলে সে বলল: ঈশ্বরের দূত! আমার স্বামী গাছচাপা পড়ে মারা গেছে সবাই মিলে সবে তাকে কবর দিয়েছে। আমার বোন নেই, খালা-চাচি নেই, দাদি-নানি নেই বাপ-মা-মরা মেয়েদুটোকে দেখার কেউ নেই। আমার আত্মা নিয়ো না। মেয়েদুটোকে খাইয়ে পরিয়ে তাদের পায়ে দাড়াবার মতো করে তুলতে দাও। বাপ মা ছাড়া তো সন্তান বাচতে পারে না ” প্রসূতির কথা শুনে আমি একটি মেয়েকে তার বুকে তুলে দিলাম, আরেকটিকে তুলে দিলাম তার কোলে, তারপর স্বর্গে ঈশ্বরের কাছে চললাম। ঈশ্বরের কাছে উড়ে গিয়ে বললাম : সদ্যপ্রসূতির আত্মা আনতে আমি পারিনি। গাছ চাপা পড়ে বাপ মরেছে মায়ের দুটি যমজ সন্তান জন্মেছে সে আমাকে অনুরোধ করল তার আত্মা না নিতে। সে বলল : ‘আমার মেয়েদের লালন পালন করতে দাও, তাদের পায়ে দাঁড়াবার মতো সময় দাও। বাপ-মা ছাড়া শিশুসন্তান বাচতে পারে না। …সে মায়ের আত্মা আমি আনি নি।” তখন ঈশ্বর বললেন : “যাও মায়ের আত্মা নিয়ে এসো, আর তিনটি সত্য জেনে এসো; জেনে এসো; মানুষের কী আছে, মানুষের কী নেই, আর মানুষ কী নিয়ে বাঁচে। এই তিন সত্য জেনে তবে স্বর্গে ফিরে আসবে। আমি আবার পৃথিবীতে উড়ে গেলাম, মায়ের আত্মা নিয়ে এলাম।”
“শিশুদুটি মায়ের বুক থেকে গড়িয়ে পড়ল। তার মৃতদেহ শয্যার উপরে ঘুরে পড়তেই একটি মেয়েকে চাপা দিল; তার পা গেল বেঁকে। আত্মা নিয়ে ঈশ্বরের কাছে উড়ে চলেছি এমন সময় আমি ঝড়ে পড়লাম, আমার পাখদুটো খসে পড়ল। আত্মা একাই ঈশ্বরের দিকে চলে গেল। আমি পৃথিবীতে একটি পথের ধারে পড়ে গেলাম।”
সাইমন ও মাত্রোনা বুঝতে পারল কাকে তারা খাইয়েছে, পরিয়েছে ; কে তাদের সঙ্গে এতদিন ছিল। তখন ভয়ে ও আনন্দে তারা কাঁদতে লাগল।
দেবদূত বলল :“মাঠের মধ্যে উলঙ্গ অবস্থায় আমি একা পড়ে রইলাম। মানুষের কী দরকার আমি জানতাম না। শীত বা ক্ষুধা কাকে বলে তাও জানতাম না। কিন্তু তখন আমি মানুষ হয়ে গিয়েছি। আমি তখন ক্ষুধায় কাতর, ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি; কিন্তু কী যে করব কিছুই জানি না। তখন মাঠের মধ্যে তৈরি একটি ঈশ্বরের প্রার্থনাঘর দেখতে পেয়ে আশ্রয়ের আশায় সেখানেই গেলাম। প্রার্থনাগৃহ তালাবন্ধ। ভিতরে ঢুকতে পারলাম না। ঠাণ্ডা বাতাস থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রার্থনাগৃহের পিছনে বসে রইলাম। সন্ধ্যা নেমে এল। আমি অভুক্ত, ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি, সারা শরীর কাঁপছে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনলাম : একটা লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে, হাতে একজোড়া বুট; নিজের মনেই কী যেন বলছে। মানুষের মরণশীল মুখ আমি দেখলাম। সেমুখ দেখে আমার ভয় হল। চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আমি শুনতে পেলাম লোকটি বলছে, এই বরফের মতো ঠাণ্ডায় কী করে সে নিজের শরীরকে বাচাবে, কেমন করে তার স্ত্রী-পুত্রকে খাওয়াবে। আমি ভাবলাম : ‘ঠাণ্ডায় ও ক্ষুধায় আমি মরে যাচ্ছি, আর এই লোকটা শুধু নিজের কথাই ভাবছে ; কেমন করে নিজেকে আর বউকে ফারকোট দিয়ে ঢাকবে, কেমন করে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে খাওয়াবে। এ কখনও আমাকে সাহায্য করবে না।’ লোকটি আমাকে দেখল, ভুরু কোচকাল, যেন আরও ভয় পেয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমি হতাশায় ভেঙে পড়লাম। হঠাৎ শব্দ শুনে বুঝলাম লোকটা ফিরে আসছে। আমি চোখ তুললাম, কিন্তু দেখলাম এ যেন সে-লোক নয়। তখন তার মুখে ছিল মৃত্যুর ছায়া, এখন সহসা সে যেন বেঁচে উঠেছে, তার মুখে আমি ঈশ্বরকে দেখতে পেলাম। সে আমার কাছে এল, আমাকে জামা-জুতো পরাল, সঙ্গে করে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। লোকটির বাড়িতে ঢুকতেই তার বউ এগিয়ে এসে বকবক করতে লাগল। বউটি যেন লোকটির চাইতেও ভয়ংকরী— তার মুখ দিয়ে যেন একটি মৃত আত্মা কথা বলছে, মৃত্যুর দুর্গন্ধে আমার যেন দম আটকে আসছিল। সেই ঠাণ্ডায় সে আমাকে বাইরে তাড়িয়ে দিতে চাইল। আমি জানতাম, আমাকে তাড়িয়ে দিলেই সে মারা যাবে। তখন তার স্বামী তাকে ঈশ্বরের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকটির মনে পরিবর্তন এল। তারপর সে যখন খাবার দিয়ে আমার দিকে তাকাল, আমি দেখলাম তার মুখে মৃত্যুর ছায়া আর নেই সে যেন বেঁচে উঠেছে; তার মুখেও আমি ঈশ্বরকে দেখতে পেলাম।
“তখনই আমার মনে পড়ে গেল ঈশ্বরের প্রথম কথা : ‘জেনে এসো, মানুষের কী আছে।’ আমি জানলাম, মানুষের প্রেম আছে। আমি খুশি হলাম, কারণ ঈশ্বর আমাকে যা বলেছিলেন সেই সত্য আমার কাছে প্রকাশ করতে আরম্ভ করেছেন। সেই আমি প্রথমবার হাসলাম। কিন্তু সবকিছু তখনও শেখা হয়নি। তখনও জানিনি, মানুষের কী নেই, বা মানুষ কী নিয়ে বেঁচে থাকে।
“তোমাদের সঙ্গে একটি বছর কাটালাম। তারপর একদিন একজন লোক এসে এমন বুটের অর্ডার দিল যা একবছরের মধ্যে ছিড়বে না বা ফাটবে না। তার দিকে তাকাতেই তার পিছনে আমার সঙ্গী মৃত্যুদূতকে দেখতে পেলাম। বুঝলাম, সূর্যাস্তের আগেই সে এই ধনীলোকটির আত্ম নিয়ে যাবে। তখন ভাবলাম :‘মানুষ একবছরের কথা ভাবে, অথচ সে জানে না যে সন্ধ্যা পর্যন্তও তার আয়ু নেই।” তখনই মনে পড়ল ঈশ্বরের দ্বিতীয় কথা: ‘জেনে এসো, মানুষের কী নেই।’
“মানুষের কী আছে আমি আগেই জেনেছি। এখন জানলাম, মানুষের কী নেই। তখনই আমি দ্বিতীয়বার হাসলাম। আমার সঙ্গী দেবদূতকে দেখে এবং ঈশ্বর আর একটি সত্য আমার কাছে প্রকাশ করেছেন জেনে আমার ভারি আনন্দ হল।
“কিন্তু তখনও আমার সব জানা হয়নি। আমি তখনও জানি নি, মানুষ কী নিয়ে বাঁচে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম, কবে ঈশ্বর বাকি সত্যটা আমার কাছে প্রকাশ করবেন। ষষ্ঠ বছরে দুটি যমজ মেয়ে নিয়ে স্ত্রীলোকটি এল। আমি তাদের চিনতে পারলাম ; তারা কী করে বেঁচে আছে তাও শুনলাম। সব শুনে ভাবলাম : ‘মেয়েদের জন্য মা আমার কাছে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল, মায়ের কথা আমি বিশ্বাস করেছিলাম—ভেবেছিলাম বাব-মা ছাড়া শিশুসন্তান। বাচতে পারে না, অথচ একজন অপরিচিতা তাদের বড় করে তুলেছে!’ অন্যের মেয়ের প্রতি স্নেহে স্ত্রীলোকটি যখন কাদল, তখন তার মধ্যে আমি জীবন্ত সৃষ্টিকর্তাকে দেখতে পেলাম, আমি জানলাম মানুষ কী নিয়ে বাচে। তখন আমি বুঝলাম, ঈশ্বর আমার কাছে তৃতীয় সত্য প্রকাশ করেছেন, আমাকে ক্ষমা করেছেন। তাই আমি তৃতীয়বার হাসলাম।”