পল্লী সমাজ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৫
এ পাড়ায় একমাত্র মধু পালের মুদির দোকান নদীর পথে হাটের একধারে। দশ বার দিন হইয়া গেল, অথচ সে বাকী দশ টাকা লইয়া যায় নাই বলিয়া, রমেশ কি মনে করিয়া নিজেই একদিন সকালবেলা দোকানের উদ্দেশে বাহির হইয়া পড়িল। মধু পাল মহাসমাদর করিয়া ছোটবাবুকে বারান্দার উপর মোড়া পাতিয়া বসাইল এবং ছোট বাবুর আসিবার হেতু শুনিয়া গভীর আশ্চর্য্যে অবাক হইয়া গেল। যে ধারে, সে উপযাচক হইয়া ঘর বহিয়া ঋণশোধ করিতে আসে, তাহা মধু পাল এতটা বয়সে কখন চোখে ত দেখেই নাই, কানেও শোনে নাই। কথায় কথায় অনেক কথা হইল। মধু কহিল, “দোকান কেমন ক’রে চল্বে, বাবু? দু’ আনা চার আনা একটাকা পাঁচসিকে ক’রে প্রায় পঞ্চাশ ষাট টাকা বাকী পড়ে গেছে। এই দিয়ে যাচ্চি ব’লে দু মাসেও আদায় হবার যো’ নেই। এ কি-বাঁডুয্যে মশাই যে! কবে এলেন? প্রাতঃ পেন্নাম হই।”
বাঁডুয্যে মশায়ের বা হাতে একটা গাড়ু, পায়ের নখে, গোড়ালিতে কাদার দাগ, কানে পৈতা জড়ানো, ডানহাতে কচুপাতায় মোড়া চারিটি কুচোচিংড়ি। তিনি ফোঁস করিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “কাল রাত্তিরে এলুম; তামাক থা’ দিকি মধু!” বলিয়া গাড়ু রাখিয়া হাতের চিংড়ি মেলিয়া ধরিয়া বলিলেন, “সৈরুবি জেলেনীর আক্কেল দেখলি, মধু—খপ্ ক’রে হাতটা আমার ধ’রে ফেল্লে? কালেকালে কি হ’ল বল্ দেখি রে, এই কি এক পয়সার চিংড়ি? বামুনকে ঠকিয়ে ক’কাল খাবি মাগী, উচ্ছন্ন যেতে হবে না?” মধু বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল’ “হাত ধরে ফেল্লে আপনার?” ক্রুদ্ধ বাঁডুয্যে মশাই একবার চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া উত্তেজিত হইয়া কহিলেন—“আড়াইটি পয়সা শুধু বাকী, তাই ব’লে খামকা হাটশুদ্ধ লোকের সাম্নে হাত ধর্বে আমার? কে না দেখ্লে বল্। মাঠ থেকে ব’সে এসে, গাড়ুটি মেজে নদীতে হাত-পা ধুয়ে মনে কর্লুম, হাটটা একবার ঘুরে যাই, মাগী এক চুবড়ি মাছ নিয়ে ব’সে,—আমাকে স্বছন্দে বল্লে কি না, কিছুই নেই ঠাকুর, যা’ ছিল, সব উঠে গেছে। আরে, আমার চোখে ধুলো দিতে পারিস্? ডালাটা ফস্ ক’রে তুলে ফেলতেই হাতটা চেপে ধ’রে ফেল্লে! তোর এই আড়াইটা—আর আজকার একটা—এই সাড়ে তিনটে পয়সা নিয়ে আমি গাঁ ছেড়ে পালাব? কি বলিস, মধু?” মধু সায় দিয়া কহিল, “তাও কি হয়!” “তবে, তাই বল্ না! গাঁয়ে কি শাসন আছে? নইলে ষষ্ঠে জেলের খোপা-নাপ্তে বন্ধ ক’রে, চাল কেটে তুলে দেওয়া যায় না!” হঠাৎ রমেশের প্রতি চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, “বাবুটি কে, মধু?” মধু সগর্ব্বে কহিল, “আমাদের ছোটবাবুর ছেলে যে! সেদিনের দশ টাকা বাকী ছিল ব’লে, নিজে বাড়ী বয়ে দিতে এসেচেন।” বাঁডুয্যে মশাই কুচোচিংড়ির অভিযোগ ভুলিয়া, দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন,—“হ্যাঁ, রমেশ বাবাজী? বেঁচে থাক, বাবা—হাঁ, এসে শুনলুম, একটা কাজের মত কাজ করেচ বটে! এমন খাওয়া-দাওয়া এ অঞ্চলে কখনও হয় নি। কিন্তু বড় দুঃখ রইল, চোখে দেখ্তে পেলুম না। পাঁচ শালার ধাপ্পায় প’ড়ে কল্কাতায় চাকুরি কর্তে গিয়ে হাড়ীর হাল। আরে ছি, সেখানে মানুষ থাক্তে পারে!” রমেশ এই লোকটার মুখের দিকে চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল। কিন্তু দোকান-শুদ্ধ সকলে তাঁহার কলিকাতা প্রবাসের ইতিহাস শুনিবার জন্য মহাকৌতূহলী হইয়া উঠিল। তামাক সাজিয়া মধু-দোকানি বাঁড়ুয্যের হাতে হুঁকাটা তুলিয়া দিয়া, প্রশ্ন করিল, “তার পরে? একটু চাক্রি-বাক্রি হয়েছিল ত?” “হবে না? এ কি ধান দিয়ে লেখাপড়া শেখা আমার?—হ’লে হবে কি,—সেখানে কে থাক্তে পারে বল! যেমন ধুঁয়া—তেমনি কাদা। বাইরে বেরিয়ে গাড়ীঘোড়া চাপা না প’ড়ে যদি ঘরে ফির্তে পারিস্, ত জান্বি, তোর বাপের পুণ্যি!” মধু কখনও কলিকাতায় যায় নাই। মেদিনীপুর সহরটা, একবার সাক্ষ্য দিতে গিয়া, দেখিয়া আসিয়াছিল মাত্র। সে ভারি আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, “বলেন কি!” বাঁড়ুয্যে ঈষৎ হাসিয়া কহিল-“তোর রমেশ বাবুকে জিজ্ঞাসা কর না, সত্যি না মিথ্যে। না মধু, খেতে না পাই, বুকে হাত দিয়ে ঘরে প’ড়ে ম’রে থাকব, সে ভাল, কিন্তু বিদেশ যাবার নামটি যেন কেউ আমার কাছে আর না করে। বল্লে বিশ্বেস করবিনে, সেখানে শুষ্ণি-কলমি শাক, চালতা, আমড়া, খোড়-মোচা পর্য্যন্ত কিনে খেতে হয়! পার্বি খেতে? এই একটি মাস না খেয়ে-খেয়ে যেন রোগা ইঁদুরটি হয়ে গেচি! দিবারাত্রি পেট ফুট-ফাট করে, বুকজ্বালা করে, প্রাণ আইঢাই করে, পালিয়ে এসে তবে হাঁফ-ছেড়ে বাঁচি। না বাবা, নিজের গাঁয়ে ব’সে জোটে একবেলা, একসন্ধ্যে খাবো; না জোটে, ছেলেমেয়ের হাত ধ’রে ভিক্ষে করব; বামুনের ছেলের তাতে কিছু আর লজ্জার কথা নেই, কিন্তু, মা লক্ষী মাথায় থাকুন—বিদেশ কেউ যেন না যায়!” তাঁহার কাহিনী শুনিয়া সকলে যখন সভয়ে নির্ব্বাক হইয়া গেছে, তখন বাঁড়ুয্যে উঠিয়া আসিয়া মধুর তেলের ভাঁড়ের ভিতর উখড়ি ডুবাইয়া একছটাকে তেল বাঁ হাতের তেলোয় লইয়া অর্দ্ধেকটা দুই নাক ও দুই কানের গর্ত্তে ঢালিয়া দিয়া, বাকীটা মাথায় মাখিয়া ফেলিলেন ও কহিলেন, “বেলা হয়ে গেল, অম্নি ডুবটা দিয়ে একেবারে ঘরে যাই! এক পরসার নুন দে দেখি, মধু, পয়সাটা বিকেলবেলা দিয়ে যাবো।” “আবার বিকেলবেলা!”বলিয়া মধু অপ্রসন্নমুখে নুণ দিতে তাঁহার দোকানে উঠিল। বাঁড়ুয্যে গলা বাড়াইয়া দেখিয়া, বিস্ময়-বিরক্তির স্বরে কহিয়া উঠিল, “তোরা সব হলি কি, মধু? এ যে গালে চড় মেরে পয়সা নিস্, দেখি?” বলিয়া আগাইয়া আসিয়া নিজেই এক খামচা নুন তুলিয়া ঠোঙায় দিয়া সেটা টানিয়া লইলেন। গাড়ু হাতে করিয়া রমেশের প্রতি চাহিয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন,—“ঐ ত একই পথ—চল না বাবাজী, গল্প ক’রতে ক’রতে যাই।” “চলুন”—বলিয়া রমেশ উঠিয়া দাঁড়াইল। মধু-দোকানি অনতিদূরে দাঁড়াইয়া করুণ-কন্ঠে কহিল, “বাড়ুয্যে মশাই, সেই ময়দার পয়সা পাঁচ আনা কি অমনি—”
বাঁড়ুয্যে রাগিয়া উঠিল—“হাঁ রে, মধু, দুবেলা চোখো-চোখি হবে-তোদের কি চোখের চামড়া পর্য্যন্ত নেই? পাঁচ ব্যাটাবেটীর মতলবে কল্কাতায় যাওয়া আসা ক’রতে পাঁচপাঁচটা টাকা আমার জলে গেল—আর এই তোদের তাগাদা করবার সময় হ’ল! কারো সর্ব্বনাশ, কারো পোষ মাস—দেখ্লে বাবা রমেশ, এদের ব্যাভারটা একবার দেখ্লে?” মধু এতটুকু হইয়া গিয়া অস্ফুট বলিতে গেল, “অনেক দিনের—” “হলই বা অনেক দিনের? এমন ক’রে সবাই মিলে পিছনে লাগ্লে ত আর গাঁয়ে বাস করা যায় না।” বলিয়া বাঁড়ুয্যে একরকম রাগ করিয়াই নিজের জিনিসপত্র লইয়া চলিয়া গেলেন।
রমেশ ফিরিয়া আসিয়া বাড়ী ঢুকিতেই এক ভদ্রলোক শশব্যস্তে হাতের হুঁকাটা একপাশে রাখিয়া দিয়া, একবারে পায়ের কাছে আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিল। উঠিয়া কহিল, “আমি বনমালী পাড়ুই—আপনাদের ইস্কুলের হেডমাষ্টার। দুদিন এসে সাক্ষাৎ পাইনি; তাই বলি—” রমেশ সমাদর করিয়া পাড়ুইমহাশয়কে চেয়ারে বসাইতে গেল; কিন্তু সে সসম্ভ্রমে দাঁড়াইয়া রহিল। কহিল, “আজ্ঞে, আমি যে আপনার ভৃত্য।” লোকটা বয়সে প্রাচীন এবং আর-যেই-হোক একটা বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাহার এই অতি বিনীত কুণ্ঠিত ব্যবহারে রমেশের মনের মধ্যে একটা অশ্রদ্ধার ভাব জাগিয়া উঠিল। সে কিছুতেই আসন-গ্রহণে স্বীকৃত হইল না, খাড়া দাঁড়াইয়া নিজের বক্তব্য কহিতে লাগিল। এদিকের মধ্যে এই একটা অতি ছোট রকমের ইস্কুল, মুখুয্যে ও ঘোষালদের যত্নে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। প্রায় ৩০।৪০ জন ছাত্র পড়ে। দুই তিন ক্রোশ দূর হইতেও কেহ কেহ আসে। যৎকিঞ্চিৎ গভর্ণমেন্ট-সাহায্যও আছে। তথাপি ইস্কুল আর চলিতে চাহিতেছে না। ছেলেবয়সে এই বিদ্যালয়ে রমেশও কিছুদিন পড়িয়াছিল, তাহার স্মরণ হইল। পাড়ুই মহাশয় জানাইল যে, চাল ছাওয়া না হইলে আগামী বর্ষায় বিদ্যালয়ের ভিতর আর কেহ বসিতে পারিবে না। কিন্তু সে না হয় পরে চিন্তা করিলে চলিবে, উপস্থিত প্রধান দুর্ভাবনা হইতেছে যে, তিনমাস হইতে শিক্ষকেরা কেহ মাহিনা পায় নাই—সুতরাং, ঘরের খাইয়া বন্যমহিষ তাড়াইয়া বেড়াইতে আর কেহ পারিতেছে না।
ইস্কুলের কথায় রমেশ একেবারে সজাগ হইয়া উঠিল। হেডমাষ্টার মহাশয়কে বৈঠকখানায় লইয়া গিয়া একটি একটি করিয়া সমস্ত সংবাদ গ্রহণ করিতে লাগিল। মাষ্টারপণ্ডিত চারিজন; এবং তাঁহাদের হাড় ভাঙা খাটুনির ফলে গড়ে দুই জন করিয়া ছাত্র প্রতিবৎসর মাইনার পরীক্ষায় পাস করিয়াছে। তাহাদের নাম-ধাম বিবরণ পাড়ুই মহাশয় মুখস্থর মত আবৃত্তি করিয়া দিল। ছেলেদের নিকট হইতে যাহা আদায় হয়, তাহাতে নীচের দুজন শিক্ষকের কোন মতে, ও গভর্ণমেন্টের সাহায্যে আর একজনের সঙ্কুলান হয়; শুধু একজনের মাহিনাটাই গ্রামের ভিতরে এবং বাহিরে চাঁদা তুলিয়া সংগ্রহ করিতে হয়। এই চাঁদা সাধিবার ভারও মাষ্টারদের উপরেই—তাঁহারা গত তিন চারি মাস কাল ক্রমাগত ঘুরিয়া ঘুরিয়া প্রত্যেক বাটীতে আট-দশবার করিয়া হাঁটা-হাঁটি করিয়াও সাতটাকা চারি আনার বেশী আদায় করিতে পারেন নাই!
কথা শুনিয়া রমেশ স্তম্ভিত হইয়া রহিল। পাঁচছয়টা গ্রামের মধ্যে এই একটা বিদ্যালয়—এবং এই পাঁচছয়টা গ্রামময় তিনমাসকাল ক্রমাগত ঘুরিয়া মাত্র ৭।০ আদায় হইয়াছে! রমেশ প্রশ্ন করিল, “আপনার মাহিনা কত?” মাষ্টার কহিল, “রসিদ দিতে হয় ছাব্বিশ টাকার, পাই তের টাকা পোনর আনা।” কথাটা রমেশ ঠিক বুঝিতে পারিল না—তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল। মাষ্টার তাহা বুঝাইয়া বলিল, “আজ্ঞে গভর্ণমেন্টের হুকুম কি না, তাই ছাব্বিশ টাকার রসিদ লিখে দিয়ে সবইন্স্পেক্টার বাবুকে দেখাতে হয়—নইলে—সরকারী সাহায্য বন্ধ হ’য়ে যায়। সবাই জানে, আপনি কোন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা কর্লেই জানতে পার্বেন—আমি মিথ্যে বল্চিনে।” রমেশ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এতে ছাত্রদের কাছে আপনার সম্মানহানি হয় না?” মাষ্টার লজ্জিত হইল। কহিল, কি কর্ব, রমেশবাবু! বেণীবাবু এ কয়টি টাকাও দিতে নারাজ।”
“তিনিই কর্ত্তা বুঝি?”
মাষ্টার একবার একটুখানি দ্বিধা করিল; কিন্তু তাহার না বলিলেই নয়। তাই সে ধীরে ধীরে জানাইল যে, “তিনিই সেক্রেটারি বটে; তিনি একটি পয়সাও কখনো খরচ করেন না। যদু মুখুয্যে মহাশয়ের কন্যা—সতীলক্ষ্মী তিনি—তাঁর দয়া না থাকিলে ইস্কুল অনেকদিন উঠিয়া যাইত। এ বৎসর নিজের খরচে চাল ছাইয়া দিবেন, আশা দিয়াও হঠাৎ কেন যে সমস্ত সাহায্য বন্ধ করিয়া দিয়াছেন, তাহার কারণ কেহই বলিতে পারে না।” রমেশ কৌতূহলী হইয়া রমার সম্বন্ধে আরও কয়েকটি প্রশ্ন করিয়া, শেষে জিজ্ঞাসা করিল, “তাঁর একটি ভাই এ ইস্কুলে পড়ে না?” মাষ্টার কহিল, “যতীন ত? পড়ে বৈকি।” রমেশ বলিল, “আপনার ইস্কুলের বেলা হয়ে যাচ্ছে, আজ আপনি যান, কা’ল আমি আপনাদের ওখানে যাব।” “যে আজ্ঞে” বলিয়া হেডমাষ্টার আর একবার রমেশকে প্রণাম করিয়া, জোর করিয়া তাহার পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া, বিদায় হইল।