আম আঁটির ভেঁপু – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

দুর্গা বিপন্নমুখে বলিল- ওকে জিজ্ঞেস করো না? আমি- এই তো এখন কাঁঠালতলায় দাঁড়িয়ে- তুমি যখন ডাক্লে তখন তো –

স্বর্ণ গোয়ালিনী গাই দুহিতে আসায় কথাটা চাপা পড়িয়া গেল। তাহার মা বলিল- যা, বাছুরটা ধরগে যা-ডেকে সারা হোলো- কমলে বাছুর, ও সন্ন, এত বেলা করে এলে কি বাঁচে? একটু সকাল করে না এলে এই তেতপ্পর পজ্জন্ত বাছুর বাঁধা-

দিদির পিছনে পিছনে অপুও দুধ দোয়া দেখিতে গেল। সে বাহির উঠানে পা দিতেই দুর্গা হাতার পিঠে দুম্ করিয়া নির্ঘাত এক কিল বসাইয়া দিয়া কহিল- লক্ষ্মীছাড়া বাঁদর! পরে মুখ ভ্যাঙাইয়া কহিল- আম খেয়ে দাঁত টকে গিয়েছে- আবার কোনোদিন আম দেবো খেও-ছাই দেবো- এই ওবেলাই পটলিদের কাঁকুড়তলির আম কুড়িয়ে এনে জারাবো, এত বড় বড় গুটি হয়েচে, মিষ্টি যেন গুড়- দেবো তোমায়? খেও এখন? হাবা একটা কোথাকার- যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকে!

দুপুরের কিছু পরে হরিহর কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিল। সে আজকাল গ্রামের অন্নদা রায়ের বাটীতে গোমস্তার কাজ করে। জিজ্ঞাসা করিল- অপুকে দেখচি নে?

সর্বজয়া বলিল- অপু তো ঘরে ঘুমুচ্ছে।

-দুগ্গা বুঝি-

সে সেই খেয়ে বেরিয়েছি- সে বাড়ি থাকে কখন? দুটো খাওয়ার সঙ্গে যা সম্পর্ক! আবার সেই খিদে পেলে তবে আসবে- কোথায় কার বাগানে কার আমতলায় জামতলায় ঘুরছে- এই চত্তির মাসের রোদ্দুরে, পের দ্যাখো না এই জ্বরে পড়লো বলে- অত বড় মেয়ে, বলে বোঝাবো কত? কথা শোনে, না কানে নেয়?

একটু পরে হরিহর খাইতে বসিয়া বলিল- আজ দশঘরায় তাগাদার জন্যে গেছলাম, বুঝলে? একজন লোক, খুব মাতবর, পাঁচটা- ছয়টা গোলা বাড়িতে, বেশ পয়সাওয়ালা লোক- আমায় দেখে দণ্ডবৎ করে বল্লে- দাদাঠাকুর, আমায় চিনতে পাচ্ছেন?

আমি বল্লাম- না বাপু, আমি তো কৈ?- বল্লে- আপনার কর্তা থাকতে তখন তখন পূজা-আচ্চায় সবসময়ই তিনি আসতেন, পায়ের ধুলো দিতেন। আপনারা আমাদের গুরুতুল্য লোক, এবার আমরা বাড়িসুদ্ধ মন্তর নেবো ভাবচি- তা আপনি যদি আজ্ঞে করেন, তবে ভরসা করে বলি- আপনিই কেন মন্তরটা দেন না? তা আমি তাদের বলেচি আজ আর কোনো কথা বলবো না, ঘুরে এসে দু-এক-দিনে- বুঝলে?

সর্বজয়া ডালের বাটি হাতে দাঁড়াইয়া ছিল, বাটি মেজেতে নামাইয়া সামনে বসিয়া পড়িল। বলিল- হ্যাঁগো, তা মন্দ কী? দাও না ওদের মন্তর? কী জাত? হরিহর সুর নামাইয়া বলিল-বলো না কাউকে!- সদ্‌গোপ।

তোমার তো আবার গল্প করে বেড়ানো স্বভাব-

-আমি আবার কাকে বলতে যাবো, তা হোক গে সদ্গাপ, দাও গিয়ে দিয়ে, এই কষ্ট যাচ্ছ- ঐ রায়বাড়ির আটটা টাকা ভরসা, তাও দু’তিন মাস অন্তর তবে দ্যায়- আর এদিকে রাজ্যের দেনা। কাল ঘাটের পথে সেজ ঠাক্‌রুন বল্লে- বৌমা, আমি বন্দক ছাড়া টাকা ধার দিই নে- তবে তুমি অনেক করে বল্লে বলে দিলাম- আজ পাঁচ পাঁচ মাস হয়ে গেল, টাকা আর রাখতে পারবো না। এদিকে রাধা বোষ্টমের বৌ তো ছিঁড়ে খাচ্ছে, দু’বেলা তাগাদা আরম্ভ করেচে। ছেলেটার কাপড় নেই- দু’তিন জায়গায় সেলাই, বাছা আমার তাই পরে হাসিমুখে নেচে নেচে বেড়ায়- আমার এমন হয়েচে যে ইচ্ছে করে একদিকে বেরিয়ে যাই-

-আর একটা কথা ওরা বলছিল, বুঝলে? বলছিল গাঁয়ে তো বামুন নেই, আপনি যদি এই গাঁয়ে উঠে আসেন, তবে জায়গা- জমি দিয়ে বাস করাই- গাঁয়ে একঘর বামুন বাস করানো আমাদের বড্ড ইচ্ছে। তা কিছু ধানের জমিটমি দিতেও রাজি- পয়সার তো অভাব নেই! আজকাল চাষাদের ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা- ভদ্দর লোকেরই হয়ে পড়েচে হা ভাত যো ভাত-

আগ্রহে সর্বজয়ার কথা বন্ধ হইবার উপক্রম হই-এখ্খুনি। তা তুমি রাজি হলে না কেন? বল্লেই হতো যে আচ্ছা আমরা আসবো! ও রকম একটা বড় মানুষের আশ্রয়- এ গাঁয়ে তোমার আছে কী? শুধু ভিটে কামড়ে পড়ে থাকা-

হরিহর হাসিয়া বলিল- পাগল! তখুনি কী রাজি হতে আছে? ছোটলোক, ভাববে ঠাকুরের হাঁড়ি দেখচি শিকেয় উঠেচে- উঁহু, ওতে খেলো হয়ে যেতে হয়- তা নয়, দেখি একবার চুপি চুপি মজুমদার মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে- আর এখন ওঠ বল্লেই কী ওঠা চলে? সব ব্যাটা এসে বলবে টাকা দাও, নৈলে যেতে দেবো না। দেখি পরামর্শ করে কি রকম দাঁড়ায়।

এই সময়ে মেয়ে দুর্গা কোথা হইতে পা টিপিয়া টিপিয়া আসিয়া বাহিরের দুয়ারের আড়াল হইতে সতর্কতার সহিত একবার উঁকি মারিল এবং অপর পক্ষ সম্পূর্ণ সজাগ দেখিয়া ওধারে পাঁচিলের পাশ বাহিয়া বাহির বাটীর রোয়াকে উঠিল। দালানের দুয়ার আস্তে আস্তে ঠেলিয়া দেখিল উহা বন্ধ আছে। এদিকে রোয়াকে দাঁড়ানো অসম্ভব, রৌদ্রের তাপে পা পুড়িয়া যায়, কাজেই সে স্থান হইতে নামিয়া গিয়া উঠানের কাঁঠালতলায় দাঁড়াইল। রৌদ্রে বেড়াইয়া তাহার মুখ রাঙা হইয়া উঠিয়াছে, আঁচলের খুঁটে কী কতকগুলো যত্ন করিয়া বাঁধা। সে আসিয়াছিল এইজন্য যে, যদি বাহিরের দুয়ার খোলা পায় এবং মা ঘুমাইয়া থাকে, তবে ঘরের মধ্যে চুপি চুপি ঢুকিয়া একটু শুইয়া লইবে। কিন্তু বাবার, বিশেষত মার সামনে সম্মুখ দুয়ার দিয়া বাড়ি ঢুকিতে তাহার সাহস হইল না।

উঠানে নামিয়া সে কাঁঠালতলায় দাঁড়াইয়া কী করিবে ঠিক করিতে না পারিয়া নিরুৎসাহভাবে এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। পরে সেখানেই বসিয়া পড়িয়া আঁচলের খুঁট খুলিয়া কতকগুলি শুকনো রড়া ফলের বিচি বাহির করিল।

খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া সে আপন মনে সেগুলি গুনিতে আরম্ভ করিল, এক-দুই-তিন-চার …. ছাব্বিশটা হইল।

পরে সে দুই তিনটা করিয়া বিচি হাতের উল্টা পিঠে বসাইয়া উঁচু করিয়া ছুঁড়িয়া দিয়া পরে হাতের সোজা পিট পাতিয়া ধরিতে লাগিল। মনে মনে বলিতে লাগিল- অপুকে এইগুলো দেবো- আর এইগুলো পুতুলের বাক্সে রেখে দেবো-

কেমন বিচিগুলি তেল চুকচুক কচ্ছে- আজই গাছ থেকে পড়েচে, ভাগ্যিস আগে গেলাম, নৈলে সব গোরুতে খেয়ে ফেলে দিতো, ওদের রাঙি গাইটা একেবারে রাক্কস, সব জায়গায় যাবে, সেবার কতকগুলো এনেছিলাম আর এইগুলো নিয়ে অনেকগুলো হলো।

সে খেলা বন্ধ করিয়া সমস্ত বিচি আবার সযন্তে আঁচলের খুঁটে বাঁধিল। পরে হঠাৎ কী ভাবিয়া রুক্ষ চুলগুলি বাতাসে উড়াইতে উড়াইতে মহা খুশির সহিত পুনরায় সোজা বাটীর বাহির হইয়া গেল।


পোস্টটি শেয়ার করুন