মানুষ কী নিয়ে বাঁচে – লিও টলস্টয়

দুই

 

কাছে গিয়ে খুব ভালো করে তাকাল সাইমন। লোকটি যুবক, দেখতে স্বাস্থ্যবান, শরীরের কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই, কিন্তু শীতে যেন জমে যাচ্ছে, যেন খুব ভয় পেয়েছে। কোনোরকমে হেলান দিয়ে বসে আছে, এমনকি সাইমনের দিকেও তাকাচ্ছে না, যেন দুটো চোখ তুলে তাকাবার ক্ষমতাও তার নেই।

সাইমন কাছে যেতেই, লোকটা সহসা মাথা ঘুরিয়ে দুইচোখ মেলে সাইমনের দিকে তাকাল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সাইমনেরও যেন লোকটিকে বড় ভালো লাগল। বুটজোড়া মাটিতে রেখে খুলে ফেলল গায়ের কোট।

বলল, “কথা পরে বলবে। আগে জামাটা পরে নাও। এক্ষুনি। এই নাও।”

লোকটার কনুই ধরে সাইমন তাকে উঠে দাড়াতে সাহায্য করল। সাইমন দেখল, একটি একহারা পরিচ্ছন্ন দেহ, সুডৌল হাত-পা, মিষ্টি একখানি মুখ। মুচি তার কোর্টটা লোকটির গলায় জড়িয়ে দিল, কিন্তু সে ঠিক হাতার মধ্যে তার হাত দুখানি ঢোকাতে পারল না। সাইমন ঠিকমতো হাত ঢুকিয়ে তাকে কোর্টটা পরিয়ে দিয়ে বেল্ট এঁটে দিল। তারপর মাথার টুপিটা খুলে লোকটার মাথায় পরিয়ে দেবার উপক্রম করতেই তার নিজের মাথাটাই বেশ ঠাণ্ডা লাগতে লাগল। সাইমন ভাবল, “আমার মাথাটা তো টাকে ভরা, আর ওর মাথ–ভরা কোঁকড়া চুল।” তাই সাইমন টুপিটা আবার নিজের মাথায় বসিয়ে দিল।

‘ওকে বরং বুটজোড়া দিই।” সাইমন বসে পড়ে বুটজোড়া তাকে পরিয়ে দিয়ে বলল, “এই তো ঠিক হয়েছে ভাই, এইবার হাঁটো, শরীরটাকে গরম করে নাও। হাঁটতে পারবে তো?”

উঠে দাড়িয়ে লোকটি সাইমনের দিকে তাকাল, কিন্তু কোনো কথা বলতে পারল না।

“আরে, কথা বলছ না কেন? নাও, এসো, আর যদি দুর্বল বোধ করো, আমার লাঠিটায় ভর দাও। পা-টা ঝেড়ে নাও একটু।”

লোকটি হাঁটতে শুরু করল। অনায়াসেই হাঁটতে লাগল। একটুও পিছিয়ে রইল না।

পথে যেতে যেতে সাইমন বলল, “তুমি কোথায় থাকো বলো?”

“এ-অঞ্চলে নয়।”

“সে তো জানি। এ-অঞ্চলের সব লোককে আমি চিনি। কিন্তু ওই প্রার্থনাঘরের কাছে তুমি। এলে কী করে?

“বলতে পারব না।”

“কেউ তোমাকে মেরেছিল বলে মনে হচ্ছে?”

“কেউ আমাকে মারেনি। ঈশ্বর শাস্তি দিয়েছেন।”

“ঈশ্বর সব জায়গাতেই আছেন, সে তো সকলেই জানে। তুমি কোথায় যাবে?”

“আমার কাছে সব জায়গাই সমান।”

সাইমন বিস্মিত হল। লোকটি উদ্ধত নয়, তার কথাগুলো শান্ত, কিন্তু নিজের সম্পর্কে কিছুই সে বলতে চায় না। সাইমন ভাবল, “কতকিছুই তো আমরা বুঝি না।” তারপর লোকটিকে বলল :

“ঠিক আছে, নিজের আস্তানায় যাবার আগে তুমি আমার বাড়িতেই চলো।”

সাইমন হাঁটতে লাগল। লোকটিও চলল তার পাশে পাশেই।

বাতাস উঠল। বেশ শীত করছে। স্ত্রীর জ্যাকেটটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে ভাবতে লাগল :“ভেড়ার চামড়া আমাকে কোথায় টেনে এনেছে! বেরিয়েছিলাম ভেড়ার চামড়ার খোঁজে, আর ফিরছি যখন তখন নিজের কোর্টটাও গায়ে নেই, বরং একটা ন্যাংটো লোককে নিয়ে চলেছি সঙ্গে করে। মাত্রোনা আমাকে ছেড়ে কথা কইবে না।”

শেষের কথাটা মনে হতেই সাইমন ভীত হয়ে পড়ল। তবু লোকটির দিকে তাকাতেই তার মনে পড়ে গেল প্রার্থনাঘরের কাছে তার সেই চাউনির কথা। সঙ্গে সঙ্গে মনটা খুশিতে ভরে উঠল।

পোস্টটি শেয়ার করুন