পল্লী সমাজ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

“জ্যাঠাইমা!”

“কে, রমেশ? আয় বাবা, ঘরে আয়।” বলিয়া আহ্বান করিয়া বিশ্বেশ্বরী তাড়াতাড়ি একখানি মাদুর পাতিয়া দিলেন। ঘরে পা দিয়াই রমেশ চমকিত হইয়া উঠিল। কারণ, জ্যাঠাইমার কাছে যে স্ত্রীলোকটি বসিয়াছিল, তাহার মুখ দেখিতে না পাইলেও বুঝিল—এ রমা। তাহার ভারি একটা চিত্তজ্বালার সহিত মনে হইল, ইহারা মাসীকে মাঝ্‌খানে রাখিয়া অপমান করিতেও ত্রুটি করে না, আবার নিতান্ত নির্লজ্জার মত নিভৃতে কাছে আসিয়াও বসে! এদিকে রমেশের আকস্মিক অভ্যাগমে রমারও অবস্থাসঙ্কট কম হয় নাই। কারণ, শুধু যে সে এ গ্রামের মেয়ে, তাই নয়; রমেশের সহিত তাহার সম্বন্ধটাও এইরূপ যে, নিতান্ত অপরিচিতার মত ঘোমটা টানিয়া দিতেও লজ্জা করে, না দিয়াও সে স্বস্তি পায় না। তা ছাড়া সেদিন মাছ লইয়া একটা সেদিন কাণ্ড ঘটিয়া গেল! তাই সবদিক্‌ বাঁচাইয়া যতটা পারা যায়, সে আড় হইয়া বসিয়াছিল। রমেশ আর সেদিকে চাহিল না। ঘরে যে আর কেহ আছে, তাহা একেবারে অগ্রাহ্য করিয়া দিয়া, ধীরে সুস্থে মাদুরের উপর উপবেশন করিয়া কহিল, “জ্যাঠাইমা!” জ্যাঠাইমা বলিলেন, “হঠাৎ এমন দুপুরবেলা যে, রমেশ?” রমেশ কহিল, “দুপুরবেলা না এসে তোমার কাছে যে একটু বস্‌তে পাইনে। তোমার কাজ ত কম নয়!” জ্যাঠাইমা তাহার প্রতিবাদ না করিয়া শুধু একটুখানি হাসিলেন। রমেশ মৃদু হাসিয়া বলিল, “বহুকাল আগে ছেলেবেলায় একবার তোমার কাছে বিদায় নিয়ে গিয়েছিলুম। আবার আজ একবার নিতে এলুম। এই হয়ত শেষ নেওয়া, জ্যাঠাইমা!” তাহার মুখের হাসি সত্ত্বেও কন্ঠস্বরে ভারাক্রান্ত হৃদয়ের এমনই একটা গভীর অবসাদ প্রকাশ পাইল যে, উভয় শ্রোতা বিস্মিত-ব্যথায় চমকিয়া উঠিলেন।

“বালাই, ষাট্‌! ও কি কথা, বাপ।” বলিয়া বিশ্বেশ্বরীর চোখদুটি যেন ছলছল করিয়া উঠিল। রমেশ শুধু একটু হাসিল। বিশ্বেশ্বরী স্নেহার্দ্রকন্ঠে প্রশ্ন করিলেন, “শরীরটা কি এখানে ভাল থাক্‌চে না,—বাবা?” রমেশ নিজের সুদীর্ঘ এবং অত্যন্ত বলশালী দেহের পানে বার দুই দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, “এ যে খোট্টার দেশের ডালরুটির দেহ জ্যাঠাইমা, এ কি এত শীঘ্রই খারাপ হয়? তা’ নয়, শরীর আমার বেশ ভালই আছে, কিন্তু এখানে আমি আর একদণ্ডও টিঁকতে পাচ্ছিনে, সমস্ত প্রাণটা যেন আমার থেকে-থেকে খাবি খেয়ে উঠ্‌চে।” শরীর খারাপ হয় নাই শুনিয়া, বিশ্বেশ্বরী নিশ্চিন্ত হইয়া হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই তোর জন্মস্থান—এখানে টিঁকতে পারচিস্‌নে, কেন বল্‌ দেখি?” রমেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, “সে আমি বল্‌তে চাইনে। আমি জানি তুমি নিশ্চয়ই সমস্ত জানো।” বিশ্বেশ্বরী ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া, একটু গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “সব না জান্‌লেও কতক জানি বটে। কিন্তু, সেই জন্যেই ত বলচি, তোর আর কোথাও গেলে চল্‌বে না, রমেশ?” রমেশ কহিল, “কেন চল্‌বে না, জ্যাঠাইমা? কেউ ত এখানে আমাকে চায় না।” জ্যাঠাইমা বলিলেন, “চায় না বলেই ত তোকে আর কোথাও পালিয়ে যেতে আমি দেব না। এই যে ডাল রুটি খাওয়া দেহের বড়াই কর্‌ছিলি রে, সে কি পালিয়ে যাবার জন্যে?” রমেশ চুপ করিয়া রহিল। আজ কেন যে তাহার সমস্ত চিত্ত জুড়িয়া গ্রামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছিল, তাহার একটু বিশেষ কারণ ছিল। গ্রামের যে পথটা বরাবর ষ্টেশনে গিয়া পৌঁছিয়াছিল, তাহার একটা জায়গা আটদশ বৎসর পূর্ব্বে বৃষ্টির জলস্রোতে ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। সেই অবধি ভাঙনটা ক্রমাগত দীর্ঘতর এবং গভীরতর হইয়া উঠিয়াছে। প্রায়ই জল জমিয়া থাকে—স্থানটা উত্তীর্ণ হইতে সকলকেই একটু দুর্ভাবনায় পড়িতে হয়। অন্য সময়ে কোনমতে পা টিপিয়া, কাপড় তুলিয়া, অতি সন্তর্পণে ইহারা পার হয়, কিন্তু বর্ষাকালে আর কষ্টের অবধি থাকে না। কোন বছর বা দুটো বাঁশ ফেলিয়া দিয়া, কোন বছর বা একটা ভাঙা তালের ডোঙা উপুড় করিয়া দিয়া, কোনমতে তাহারি সাহায্যে ইহারা আছাড় খাইয়া, হাত-পা ভাঙ্গিয়া, ওপারে গিয়া হাজির হয়। কিন্তু এত দুঃখসত্ত্বেও গ্রামবাসীরা আজ পর্য্যন্ত তাহার সংস্কারের চেষ্টামাত্র করে নাই। মেরামত করিতে টাকাকুড়ি ব্যয় হওয়া সম্ভব। এই টাকাটা রমেশ, নিজে না দিয়া চাঁদা তুলিবার চেষ্টায় আটদশদিন পরিশ্রম করিয়াছে; কিন্তু আট-দশটা পয়সা কাহারো কাছে বাহির করিতে পারে নাই। শুধু তাই নয়—আজ সকালে ঘুরিয়া আসিবার সময়, পথের ধারে শ্যাকরাদের দোকানের ভিতরে এই প্রসঙ্গ হঠাৎ কাণে যাওয়ায়, সে বাহিরে দাঁড়াইয়া শুনিতে পাইল, কে একজন আর একজনকে হাসিয়া বলিতেছে, “একটা পয়সা কেউ তোরা দিস্‌নে। দেখচিস্‌নে ওর নিজের গরজটাই বেশী? জুতো পায়ে মস্‌মসিয়ে চলা চাই কিনা! না দিলে, ও আপনি সারিয়ে দেবে তা’ দেখিস! তা ছাড়া এতকাল যে ও ছিল না, আমাদের ইষ্টীশান যাওয়া কি আট্‌কে ছিল? কে আর একজন কহিল, সবুর কর না হে! চাটুয্যে মশাই বল্‌ছিলেন, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শীতলাঠাকুরের ঘরটাও ঠিকঠাক করে নেওয়া হবে। খোশামোদ ক’রে দুটো ‘বাবু’ ‘বাবু’ কর্‌তে পার্‌লেই ব্যস! তখন হইতে সারা-সকালবেলাটা এই দুটো কথা তাহাকে যেন আগুন দিয়া পোড়াইতেছিল। জ্যাঠাইমা ঠিক এই স্থানটাতেই ঘা দিলেন। বলিলেন, “সে ভাঙনটা যে সারাবার চেষ্টা কর্‌ছিলি, তার কি হ’ল?” রমেশ বিরক্ত হইয়া কহিল, “সে হবে না, জ্যাঠাইমা—কেউ একটা পয়সা চাঁদা দেবে না।” বিশ্বেশ্বরী হাসিয়া বলিলেন, “দেবে না বলে হবে না রে! তোর দাদামশায়ের ত তুই’ অনেক টাকা পেয়েচিস্‌—এই ক’টা টাকা তুই ত নিজেই দিতে পারিস্‌! রমেশ একেবারে আগুন হইয়া উঠিল। কহিল, “কেন দেব? আমার ভারী দুঃখ হচ্চে যে, না বুঝে অনেক গুলো টাকা এদের ইস্কুলের জন্যে খরচ করে ফেলেছি। এ গাঁয়ের কারো জন্যে কিচ্ছু কর্‌তে নেই।” রমার দিকে একবার কটাক্ষে চাহিয়া লইয়া বলিল,—এদের দান কর্‌লে এরা বোকা মনে করে; ভাল কর্‌লে গরজ ঠাওরায়। ক্ষমা করাও মহাপাপ; ভাবে—ভয়ে পেছিয়ে গেল!” জ্যাঠাইমা খুব হাসিয়া উঠিলেন; কিন্তু রমার চোখমুখ একেবারে রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। রমেশ রাগ করিয়া কহিল, “হাস্‌লে যে জ্যাঠাইমা?” “না হেসে করি কি বল্‌ ত বাছা?” বলিয়া সহসা একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বিশ্বেশ্বরী বলিলেন, “বরং আমি বলি, তোরই এখানে থাকা সবচেয়ে দরকার। রাগ করে যে জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছিস্‌, রমেশ, বল্‌ দেখি তোর রাগের যোগ্য লোক এখানে আছে কে?” একটু থামিয়া, কতটা, যেন নিজের মনেই বলিতে লাগিলেন—“আহা! এরা যে কত দুঃখী, কত দুর্ব্বল—তা’ যদি জানিস্‌, রমেশ, এদের উপর রাগ কর্‌তে তোর আপনি লজ্জা হবে। ভগবান্‌ যদি দয়া ক’রে তোকে পাঠিয়েছেন—তবে এদের মাঝ্‌খানেই তুই থাক্‌, বাবা।” “কিন্তু, এরা যে আমাকে চায় না, জ্যাঠাইমা!” জ্যাঠাইমা বলিলেন, “তাই থেকেই কি বুঝ্‌তে পারিসনে, বাবা, এরা তোর রাগ অভিমানের কত অযোগ্য? আর শুধু এরাই নয়—যে গ্রামে ইচ্ছে ঘুরে আয় দেখ্‌বি সমস্তই এক।” সহসা রমার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “তুমি যে সেই থেকে ঘাড় হেঁট করে চুপ করে বসে আছ, মা?—হাঁ রমেশ, তোরা দু’ভাই বোনে কি কথাবার্ত্তা বলিস্‌নে? না মা, সে কোরো না। ওর বাপের সঙ্গে তোমাদের যা’ হয়ে গেছে, সে ঠাকুরপোর মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। সে নিয়ে তোমরা দুজন মনান্তর ক’রে থাক্‌লে ত কিছুতেই চলবে না।” রমা মুখ নীচু করিয়াই আস্তে আস্তে বলিল, “আমি মনান্তর রাখ্‌তে চাইনে, জ্যাঠাইমা! রমেশদা’—” অকস্মাৎ তাহার মৃদুকণ্ঠ রমেশের গম্ভীর উত্তপ্ত কণ্ঠস্বরে ঢাকিয়া গেল। সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “এর মধ্যে তুমি কিছুতে থেকো না মা! জ্যাঠাইমা! সেদিন কোনগতিকে ওঁর মাসীর হাতে প্রাণে বেঁচেচ; আজ আবার উনি গিয়ে যদি তাঁকে পাঠিয়ে দেন—একেবারে তোমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে তবে তিনি বাড়ী ফির্‌বেন।” বলিয়াই কোনরূপ বাদ-প্রতিবাদের অপেক্ষামাত্র না করিয়াই দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।

বিশ্বেশ্বরী চেঁচাইয়া ডাকিলেন, “যাসনে, রমেশ, কথা শুনে যা।” রমেশ দ্বারের বাহির হইতে বলিল, “না, জ্যাঠাইমা—যারা অহঙ্কারের স্পর্দ্ধায় তোমাকে পর্য্যন্ত পায়ের তলায় মাড়িয়ে চলে, তাদের হয়ে একটি কথাও তুমি বোলো না—” বলিয়া তাহার দ্বিতীয় অনুরোধের পূর্ব্বেই চলিয়া গেল। বিহ্বলের মত রমা কয়েক মুহূর্ত্ত বিশ্বেশ্বরীর মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া কাঁদিয়া ফেলিল—“এ কলঙ্ক আমার কেন, জ্যাঠাইমা? আমি কি মাসীকে শিখিয়ে দিই, না, তার জন্য আমি দায়ী?” জ্যাঠাইমা তাহার হাতখানা নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া সস্নেহে বলিলেন, “শিখিয়ে যে দাও না, এ কথা সত্যি। কিন্তু তাঁর জন্যে দায়ী তোমাকে কতকটা হ’তে হয় বই কি মা!” রমা অন্য হাতে চোখ মুছিতে মুছিতে রুদ্ধ অভিমানে সতেজ অস্বীকার করিয়া বলিল, “কেন দায়ী? কখ্‌খনো না। আমি যে এর বিন্দুবিসর্গও জান্‌তাম না, জ্যাঠাইমা! তবে কেন আমাকে উনি, মিথ্যে দোষ দিয়ে, অপমান ক’রে গেলেন?” বিশ্বেশ্বরী ইহা লইয়া আর তর্ক করিলেন না। ধীরভাবে বলিলেন, “সকলে ত ভেতরের কথা জান্‌তে পারে না, মা। কিন্তু তোমাকে অপমান কর্‌বার ইচ্ছে ওর কখনো নেই, এ কথা তোমাকে আমি নিশ্চয় বল্‌তে পারি। তুমি ত জান না, মা, কিন্তু আমি গোপাল সরকারের মুখে শুনে টের পেয়েছি, তোমার ওপর ওর কত শ্রদ্ধা, কত বিশ্বাস। সেদিন তেঁতুলগাছটা কাটিয়ে দু’ঘরে যখন ভাগ করে নিলে, তখন ও কা’রো কথায় কাণ দেয়নি যে; ওর তা’তে অংশ ছিল। তাদের মুখের ওপর হেসে বলেছিল, চিন্তার কারণ নেই—রমা যখন আছে, তখন আমার ন্যায্য অংশ আমি পাবই; সে কখনো পরের জিনিস আত্মসাৎ কর্‌বে না। আমি ঠিক জানি, মা, এত বিবাদ-বিসংবাদের পরেও তোমার ওপর ওর সেই বিশ্বাসই ছিল, যদি না সেদিন গড়পুকুরের—” কথাটার মাঝখানেই বিশ্বেশ্বরী সহসা থামিয়া গিয়া নির্নিমেষ-চক্ষে কিছুক্ষণ ধরিয়া রমার আনত শুষ্কমুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া অবশেষে বলিলেন, “আজ একটা কথা বলি, মা, তোমাকে। বিষয়-সম্পত্তি রক্ষা করার দাম যতই হোক রমা, এই রমেশের প্রাণটার দাম তার চেয়ে অনেক—অনেক বেশি। কারো কথায়, কোন বস্তুর লোভেতেই, মা সেই জিনিসটিকে তোমরা চারিদিক থেকে ঘা মেরে মেরে নষ্ট ক’রে ফেলো না। দেশের যে ক্ষতি তাতে হবে, আমি নিশ্চয় বল্‌চি তোমাকে, কোন কিছু দিয়েই আর তার পূরণ হবে না।” রমা স্থির হইয়া রহিল, একটি কথারও প্রতিবাদ করিল না। বিশ্বেশ্বরী আর কিছু বলিলেন না। খানিক পরে রমা অস্পষ্ট মৃদুকন্ঠে কহিল,—“বেলা গেল, আজ বাড়ী যাই জ্যাঠাইমা!” বলিয়া প্রণাম করিয়া, পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া চলিয়া গেল।

পোস্টটি শেয়ার করুন