পল্লী সমাজ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৩
“জ্যাঠাইমা?” ডাক শুনিয়া বিশ্বেশ্বরী ভাঁড়ার ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন। বেণীর বয়সের সঙ্গে তুলনা করিলে তাহার জননীর বয়স পঞ্চাশের কম হওয়া উচিত নয়; কিন্তু দেখিলে কিছুতেই চল্লিশের বেশী বলিয়া মনে হয় না। রমেশ নির্নিমেষচক্ষে চাহিয়া রহিল। আজও সেই কাঁচাসোনার বর্ণ। একদিন যে রূপের খ্যাতি এ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল, আজও সেই অনিন্দ্য সৌন্দর্য্য তাঁহার নিটোল পরিপূর্ণ দেহটিকে বর্জ্জন করিয়া দূরে যাইতে পারে নাই। মাথার চুলগুলি ছোট করিয়া ছাঁটা, সুমুখের দুই একগাছি কুঞ্চিত হইয়া কপালের উপর পড়িয়াছে। চিবুক, কপোল, ওষ্ঠাধর, ললাট সবগুলি যেন কোন বড় শিল্পীর বহুযত্নের বহু সাধনার ফল। সব চেয়ে আশ্চর্য্য তাঁহার দুটি চক্ষুর দৃষ্টি। সেদিকে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিলে সমস্ত অন্তঃকরণ যেন মোহাবিষ্ট হইয়া আসিতে থাকে।
এই জ্যাঠাইমা রমেশকে এবং বিশেষ করিয়া তাহার পরলোকগতা জননীকে একসময় বড় ভালবাসিতেন। বধূ-বয়সে যখন ছেলেরা হয় নাই—শাশুড়ি-ননদের যন্ত্রণায় লুকাইয়া বসিয়া এই দু’টি জায়ে যখন একযোগে চোখের জল ফেলিতেন—তখন এই স্নেহের প্রথম গ্রন্থি-বন্ধন হয়। তার পরে, গৃহবিচ্ছেদ, মামলা-মকদ্দমা, পৃথক্-হওয়া, কত রকমের ঝড়ঝাপটা এই দুটি সংসারের উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে; বিবাদের উত্তাপে বাঁধন শিথিল হইয়াছে; কিন্তু, একেবারে বিচ্ছিন্ন হইতে পারে নাই। বহুবর্ষ পরে সেই ছোট বৌয়ের ভাঁড়ারঘরে ঢুকিয়া, তাহারি হাতের সাজানো এই সমস্ত বহু পুরাতন হাঁড়ি-কলসির পানে চাহিয়া, জ্যাঠাইমার চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছিল। রমেশের আহ্বানে যখন তিনি চোখ মুছিয়া বাহির হইয়া আসিলেন, তখন সেই দুটি আরক্ত আর্দ্র চক্ষু-পল্লবের পানে চাহিয়া রমেশ ক্ষণকালের জন্য বিস্ময়াপন্ন হইয়া রহিল। জ্যাঠাইমা তাহা টের পাইলেন। তাহাতেই, বোধ করি, এই সদ্য-পিতৃহীন রমেশের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেই তাঁহার বুকের ভিতরটা যেভাবে হাহাকার করিয়া উঠিল, তাহার লেশমাত্র তিনি বাহিরে প্রকাশ পাইতে দিলেন না। বরং একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, “চিনতে পারিস্, রমেশ?” জবাব দিতে গিয়া রমেশের ঠোঁট কাঁপিয়া গেল। মা মারা গেলে, যতদিন না সে মামার বাড়ী গিয়াছিল, ততদিন, এই জ্যাঠাইমা তাহাকে বুকে করিয়া রাখিয়াছিলেন এবং কিছুতে ছাড়িতে চাহেন নাই। সেও মনে পড়িল; এবং এও মনে হইল, সেদিন ওবাড়ীতে গেলে জ্যাঠাইমা বাড়ী নাই বলিয়া দেখা পর্য্যন্ত করেন নাই। তার পর, রমাদের বাটীতে বেণীর সাক্ষাতে এবং অসাক্ষাতে তাহার মাসীর নিরতিশয় কঠিন তিরস্কারে সে নিশ্চয় বুঝিয়া আসিয়াছিল, এ গ্রামে আপনার বলিতে তাহার আর কেহ নাই। বিশ্বেশ্বরী রমেশের মুখের প্রতি মুহূর্ত্তকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “ছি, বাবা, এ সময়ে শক্ত হ’তে হয়।” তাঁহার কণ্ঠস্বরে কোমলতার আভাসমাত্র যেন ছিল না। রমেশ নিজেকে সামলাইয়া ফেলিল। সে বুঝিল, যেখানে অভিমানের কোন মর্য্যাদা নাই, সেখানে অভিমান প্রকাশ পাওয়ার মত বিড়ম্বনা সংসারে অল্পই আছে। কহিল, “শক্ত আমি হয়েচি, জ্যাঠাইমা! তাই যা পার্তুম, নিজেই করতুম; কেন তুমি আবার এলে? জ্যাঠাইমা হাসিলেন। কহিলেন, “তুই ত আমাকে ডেকে আনিস্নি, রমেশ, যে, তোকে তার কৈফিয়ৎ দেব? তা শোন্ বলি। কাজকর্ম্ম হবার আগে আর আমি ভাঁড়ার থেকে খাবার-টাবার কোনো জিনিস বা’র হ’তে দেব না। যাবার সময় ভাঁড়ারের চাবি তোর হাতেই দিয়ে যাব, আবার কা’ল এসে তোর হাত থেকেই নেব। আর কারু হাতে দিস্নি যেন! হাঁ রে, সে দিন তোর বড়দার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?” প্রশ্ন শুনিয়া রমেশ দ্বিধায় পড়িল। সে ঠিক বুঝিতে পারিল না, তিনি পুত্রের ব্যবহার জানেন কি না। একটু ভাবিয়া কহিল, “বড়দা তখন ৎ বাড়ী ছিলেন না।” প্রশ্ন করিয়াই জ্যাঠাইমার মুখের উপর একটা উদ্বেগের ছায়া আসিয়া পড়িয়াছিল; রমেশ স্পষ্ট দেখিতে পাইল, তাহার এই কথায় সেই ভাবটা যেন কাটিয়া গিয়া মুখখানি প্রসন্ন হইয়া উঠিল। হাসিমুখে, সস্নেহ-অনুযোগের কণ্ঠে বলিলেন, “আ আমার কপাল! এই বুঝি? হাঁ রে, দেখা হয়নি ব’লে আর যেতে নেই? আমি জানি রে, সে তোদের ওপর সন্তুষ্ট নয়; কিন্তু, তোর কাজ ত তোর করা চাই! যা, একবার ভাল ক’রে বল্গে যা, রমেশ! সে বড় ভাই, তার কাছে হেঁট হতে তোর কোন লজ্জা নেই। তা’ ছাড়া এটা মানুষের এম্নি দুঃসময় বাবা, যে, কোন লোকের হাতে পায়ে ধরে মিট্মাট ক’রে নিতেও লজ্জা নেই। লক্ষ্মী মাণিক আমার, যা একবার—এখন বোধ হয়, সে বাড়ীতেই আছে।” রমেশ চুপ করিয়া রহিল। এই আগ্রহাতিশয্যের হেতুও তাহার কাছে সুস্পষ্ট হইল না, মন হইতে সংশয়ও ঘুচিল না। বিশ্বেশ্বরী আরও কাছে সরিয়া আসিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, “বাইরে যাঁরা ব’সে আছেন, তাঁদের আমি তোর চেয়ে বেশি জানি। তাঁদের কথা শুনিস্নে। আর আমার সঙ্গে তোর বড়দার কাছে একবার যাবি চল্।” রমেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “না জ্যাঠাইমা, সে হবে না। আর বাইরে যাঁরা ব’সে আছেন, তাঁরা যাই হোন, তাঁরাই আমার সকলের চেয়ে আপনার।” সে আরও কি কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু হঠাৎ জ্যাঠাইমার মুখের প্রতি লক্ষ্য করিয়া সে মহাবিস্ময়ে চুপ করিল। তাহার মনে হইল, জ্যাঠাইমার মুখখানি যেন সহসা চারিদিকের সন্ধ্যার চেয়েও বেশি মলিন হইয়া গিয়াছে। খানিক পরে তিনি একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, তবে তাই। যখন তার কাছে যাওয়া হতেই পার্বে না, তখন আর সে নিয়ে কথা কয়ে কি হবে। যা হোক, তুই কিছু ভাবিস্নে বাবা, কিছুই আট্কাবে না। আমি আবার খুব ভোরেই আস্ব।” বলিয়া বিশ্বেশ্বরী তাঁহার দাসীকে ডাকিয়া লইয়া খিড়কির দ্বার দিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন। বেণীর সহিত রমেশের ইতিমধ্যে দেখা হইয়া যে একটা কিছু হইয়া গিয়াছে, তাহা তিনি বুঝিলেন। তিনি যে পথে চলিয়া গেলেন, সেই দিকে চাহিয়া কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া থাকিয়া, রমেশ ম্লানমুখে যখন বাহিরে আসিল, তখন গোবিন্দ ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বাবাজী, বড়গিন্নী এসেছিলেন না?” রমেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “হাঁ।” “শুন্লুম, ভাঁড়ার বন্ধ ক’রে চাবি নিয়ে গেলেন না।” রমেশ তেমনি মাথা নাড়িয়া জবাব দিল। কারণ, অবশেষে কি মনে করিয়া তিনি যাইবার সময় ভাঁড়ারের চাবি নিজেই লইয়া গিয়াছিলেন। “দেখলে ধর্ম্মদাস-দা, যা বলেচি তাই। বলি, মৎলবটা বুঝ্লে বাবাজী?” রমেশ মনে মনে অত্যন্ত ক্রূদ্ধ হইল। কিন্তু নিজের নিরুপায় অবস্থা স্মরণ করিয়া সহ্য করিয়া চুপ করিয়া রহিল। দরিদ্র দীনু ভট্চায তখনও যায় নাই। কারণ তাহার বুদ্ধি-শুদ্ধি ছিল না। সে ছেলে-মেয়ে লইয়া যাহার দয়ায় পেট ভরিয়া সন্দেশ খাইতে পাইয়াছিল, তাহাকে আন্তরিক দুটো আশীর্ব্বাদ না করিয়া, সকলের সম্মুখে উচ্চকণ্ঠে তাহার সাতপুরুষের স্তব-স্তুতি না করিয়া আর ঘরে ফিরিতে পারিতেছিল না। সে ব্রাহ্মণ নিরীহভাবে বলিয়া ফেলিল, “এ মৎলব বোঝা আর শক্ত কি ভায়া? তালাবন্ধ ক’রে চাবি নিয়ে গেচেন, তার মানে ভাঁড়ার আর কারো হাতে না পড়ে। তিনি সমস্তই ত জানেন।” গোবিন্দ বিরক্ত হইয়াছিল; নির্ব্বোধের কথায় জ্বলিয়া উঠিয়া তাহাকে একটা ধমক দিয়া কহিল, “বোঝো না, সোঝো না, তুমি কথা কও কেন বল ত। তুমি এ-সব ব্যাপারের কি বোঝ যে মানে কর্তে এসেচ?” ধমক খাইয়া দীনুর নির্ব্বুদ্ধিতা আরও বাড়িয়া গেল। সেও উষ্ণ হইয়া জবাব দিল, “আরে, এতে বোঝাবুঝিটা আছে কোনখানে? শুন্চ না, গিন্নী-মা স্বয়ং এসে বন্ধ ক’রে চাবি নিয়ে গেছেন? এতে কথা কইবে আবার কে?” গোবিন্দ আগুন হইয়া কহিল, “ঘরে যাও না ভট্চায। যে জন্যে ছুটে এসেছিলে—গুষ্টিবর্গ মিলে খেলে, বাঁধ্লে, আর কেন, ক্ষীরমোহন পরশু খেয়ো, আজ আর হবে না। এখন যাও আমাদের ঢের কাজ আছে।” দীনু লজ্জিত ও সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। রমেশ ততোধিক কুণ্ঠিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল। গোবিন্দ আরও কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সহসা রমেশের শান্ত অথচ কঠিন কন্ঠস্বরে থামিয়া গেল—“আপনার হ’ল কি গাঙুলীমশাই? যাকে-তাকে এমন খামকা অপমান কর্চেন কেন?” গোবিন্দ ভর্ৎসিত হইয়া প্রথমটা বিস্মিত হইল। কিন্তু পরক্ষণেই শুষ্ক-হাসি হাসিয়া বলিল, “অপমান আবার কাকে কর্লুম্ বাবাজী? ভাল, ওকেই জিজ্ঞাসা ক’রে দেখ না, ঠিক সত্যি কথাটি বলেচি কি না? ও ডালে-ডালে বেড়ায় ত আমি পাতায় পাতায় বেড়াই যে! দেখ্লে ধর্ম্মদাস-দা, দীনে বামনার আস্পর্দ্ধা? আচ্ছা—” ধর্মদাস-দা কি দেখিল, তাহা সেই জানে, কিন্তু রমেশ এই লোকটার নির্লজ্জতা ও স্পর্দ্ধা দেখিয়া অবাক্ হইয়া গেল। তখন দীনু রমেশের দিকে চাহিয়া নিজেই বলিল, “না বাবা, গোবিন্দ সত্য কথাই বলেচেন। আমি বড় গরীব, সে কথা সবাই জানে। ওঁদের মত আমার জমি-জমা চাষবাস কিছুই নেই। একরকম চেয়ে-চিন্তে ভিক্ষেসিক্ষে করেই আমাদের দিন চলে। ভালজিনিস ছেলেপিলেদের কিনে খাওয়াবার ক্ষমতা ত ভগবান্ দেননি—তাই, বড় ঘরে কাজকর্ম্ম হ’লে ওরা খেয়ে বাঁচে। কিন্তু মনে কোরো না, বাবা, তারিণীদাদা বেঁচে থাক্তে তিনি আমাদের খাওয়াতে বড় ভালবাস্তেন। তাই, আমি তোমাকে নিশ্চয় বল্চি বাবা, আমরা যে আশ মিটিয়ে খেয়ে গেলুম, তিনি ওপর থেকে, দেখে খুসীই হয়েচেন।” হঠাৎ দীনুর গভীর শুষ্ক চোখদুটো জলে ভরিয়া উঠিয়া, টপ্টপ্ করিয়া দুফোঁটা সকলের সুমুখেই ঝরিয়া পড়িল। রমেশ মুখ ফিরিয়া দাঁড়াইল। দীনু তাহার মলিন ও শতচ্ছিন্ন উত্তরীয়প্রান্তে অশ্রু মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, “শুধু আমিই নই বাবা! এদিকে আমার মত দুঃখী-গরীব যে যেখানে আছে, তারিণীদার কাছে, হাত পেতে কেউ কখনো অমনি ফেরেনি। সে কথা কে আর জানে বল? তাঁর ডান হাতের দান বাঁ হাতটাও টের পেত না যে! আর তোমাদের জ্বালাতন কর্ব না। নে, মা, খেঁদি ওঠ, হরিধন, চল্ বাবা ঘরে যাই, আবার কাল সকালে আস্ব, আর কি বল্ব বাবা রমেশ, বাপের মত হও, দীর্ঘজীবী হও।”
রমেশ তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে পথে আসিয়া আর্দ্রকন্ঠে কহিল, “ভট্চায্যি মশাই, এই দুটো তিনটে দিন আমার ওপর দয়া রাখ্বেন। আর বল্তে সঙ্কোচ হয়, কিন্তু এ বাড়ীতে হরিধনের মায়ের যদি পায়ের ধুলো পড়ে ত ভাগ্য ব’লে মনে কর্ব।” ভট্চায্যি মশায় ব্যস্ত হইয়া নিজের দুই হাতের মধ্যে রমেশের দুই হাত চাপিয়া ধরিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিলেন, “আমি বড় দুঃখী, বাবা রমেশ, আমাকে এমন ক’রে বল্লে যে লজ্জায় ম’রে যাই।”
ছেলেমেয়ে সঙ্গে করিয়া বৃদ্ধ ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। রমেশ ফিরিয়া আসিয়া মুহূর্ত্তের জন্য নিজের রূঢ় কথা স্মরণ করিয়া গাঙুলী মশায়কে কিছু বলিবার চেষ্টা করিতেই, তিনি থামাইয়া দিয়া উদ্দীপ্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এ যে আমার নিজের কাজ, রমেশ, তুমি না ডাক্লেও যে আমাকে নিজে এসেই সমস্ত কর্তে হ’ত। তাই ত এসেছি; ধর্ম্মদাস-দা’ আর আমি দুই ভায়ে ত তোমার ডাক্বার অপেক্ষা রাখিনি, বাবা।” ধর্ম্মদাস এইমাত্র তামাক খাইয়া কাসিতেছিল। লাঠিতে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া কাসির ধমকে চোখ-মুখ রাঙা করিয়া, হাত ঘুরাইয়া বলিল, “বলি শোন রমেশ, আমরা বেণী ঘোষাল নই। আমাদের জন্মের ঠিক আছে।” তাহার কুৎসিত কথায় রমেশ চম্কাইয়া উঠিল। কিন্তু আর রাগ করিল না। এই অত্যল্প সময়ের মধ্যেই সে বুঝিয়াছিল, ইহারা শিক্ষা ও অভ্যাসের দোষে অসঙ্কোচে কত বড় গর্হিত কথা যে উচ্চারণ করে, তাহা জানেও না।
জ্যাঠাইমার সস্নেহ অনুরোধে এবং তাঁহার ব্যথিত মুখ মনে করিয়া রমেশ ভিতরে ভিতরে পীড়া অনুভব করিতেছিল। সকলে প্রস্থান করিলে সে বড়দা’র কাছে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইল। বেণীর চণ্ডীমণ্ডপের বাহিরে আসিয়া যখন উপস্থিত হইল, তখন রাত্রি আটটা। ভিতরে যেন একটা লড়াই চলিতেছে। গোবিন্দ গাঙ্গুলীর হাঁকা-হাঁকিটাই সবচেয়ে বেশী। বাহির হইতেই তাহার কানে গেল, গোবিন্দ বাজি রাখিয়া বলিতেছে, “এ যদি না দু’দিনে উচ্ছন্ন যায়, ত আমার গোবিন্দ গাঙ্গুলী নাম তোমরা বদ্লে রেখো, বেণী বাবু! নবাবি কাণ্ডকারখানা শুন্লে ত? তারিণী ঘোষাল সিকি পয়সা রেখে মরেনি, তা’ জানি, তবে এত কেন? হাতে থাকে কর, না থাকে, বিষয় বন্ধক দিয়ে কে কবে ঘটা ক’রে বাপের ছাদ্দ করে, তা ত কখন শুনিনি, বাবা! আমি তোমাকে নিশ্চয় বল্চি, বেণীমাধব বাবু, এ ছোঁড়া নন্দীদের গদি থেকে অন্ততঃ তিনঢি হাজার টাকা দেনা ক’রেচে।” বেণী উৎসাহিত হইয়া কহিল, “তা হ’লে কথাটা ত বার ক’রে নিতে হচ্চে, গোবিন্দ খুড়ো?” গোবিন্দ স্বর মৃদু করিয়া বলিল, “সবুর কর না, বাবাজী! একবার ভাল করে ঢু্ক্তেই দাও না—তার পরে—বাইরে দাঁড়িয়ে কে ও? এ কি, রমেশ বাবাজী? আমরা থাক্তে এত রাত্তিরে তুমি কেন, বাবা?” রমেশ সে কথার জবাব না দিয়া অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিল, “বড়দা’, আপনার কাছেই এলুম।” বেণী থতমত খাইয়া জবাব দিতে পারিল না। গোবিন্দ তৎক্ষণাৎ কহিল, “আস্বে বৈ কি, বাবা, একশবার আস্বে! এ ত তোমারই বাড়ী। আর বড়ভাই পিতৃতুল্য। তাই ত আমরা বেণীবাবুকে বল্তে এসেছি, বেণীবাবু, তারিণীদার ওপর মনোমালিন্য তাঁর সঙ্গেই যাক্—আর কেন? তোমরা দু’ভাই এক হও, আমরা দেখে চোখ জুড়োই—কি বল, হালদারমামা? ও কি, দাঁড়িয়ে রইলে যে, বাবা—কে আছিস্ রে, একখানা কম্বলের আসন-টাসন পেতে দে না রে! না, বেণী বাবু, তুমি বড় ভাই—তুমিই সব। তুমি আলাদা হয়ে থাক্লে চলবে না। তা’ ছাড়া বড়গিন্নী ঠাক্রুন যখন স্বয়ং গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন, তখন—” বেণী চম্কাইয়া উঠিল—“মা গিয়ে ছিলেন?”
এই চমক্টা লক্ষ্য করিয়া গোবিন্দ মনে মনে খুসি হইল। কিন্তু, বাহিরে সে ভাব গোপন করিয়া নিতান্ত ভাল মানুষের মত খবরটা ফলাও করিয়া বলিতে লাগিল, “শুধু যাওয়া কেন, ভাঁড়ার-টাঁড়ার—করাকর্ম্ম যা’ কিছু তিনিই ত কর্চেন। আর তিনি না কর্লে কর্বেই বা কে?” সকলেই চুপ করিয়া রহিল। গোবিন্দ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “নাঃ—গাঁয়ের মধ্যে বড়গিন্নী ঠাক্রুনের মত মানুষ কি আর আছে?—না হবে? না বেণীবাবু, সাম্নে বল্লে খোসামোদ করা হবে, কিন্তু, যে যাই বলুক, গাঁয়ে যদি লক্ষ্মী থাকেন, ত সে তোমার মা। এমন মা কি কারু হয়?” বলিয়া পুনশ্চ একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া গম্ভীর হইয়া রহিলেন। বেণী অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অস্ফুটে কহিল,—“আচ্ছা—” গোবিন্দ চাপিয়া ধরিল, “শুধু আচ্ছা নয়, বেণীবাবু! যেতে হবে, কর্তে হবে, সমস্ত ভার তোমার উপরে। ভাল কথা, সবাই আপনারা ত উপস্থিত আছেন, নেমন্তন্নটা কি রকম করা হবে, একটা ফর্দ্দ ক’রে ফেলা হোক্ না কেন? কি বল, রমেশ বাবাজী? ঠিক্ কথা কি না, হালদার মামা! ধর্ম্মদাস-দা’ চুপ ক’রে রইলে কেন? কাকে বল্তে হবে, কাকে বাদ দিতে হবে, জান ত সব।”
রমেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সহজ-বিনীত-কন্ঠে বলিল, “বড়দা,’ একবার পায়ের ধুলো যদি দিতে পারেন—” বেণী গম্ভীর হইয়া কহিল, “মা যখন গেছেন, তখন আমার যাওয়া না যাওয়া—কি বল, গোবিন্দ খুড়ো?” গোবিন্দ কথা কহিবার পূর্ব্বেই রমেশ বলিল, “আপনাকে আমি পীড়াপীড়ি কর্তে চাইনে, বড়দা’, যদি অসুবিধে না হয়, একবার দেখে শুনে আস্বেন।”
বেণী চুপ করিয়া রহিল। গোবিন্দ কি একটা বলিবার চেষ্টা করিতেই রমেশ উঠিয়া চলিয়া গেল। তখন গোবিন্দ বাহিরের দিকে গলা বাড়াইয়া দেখিয়া ফিস্-ফিস্ করিয়া বলিল, “দেখ্লে, বেণীবাবু, কথার ভাবখানা!” বেণী অন্যমনস্ক হইয়া কি ভাবিতেছিল, কথা কহিল না।
পথে চলিতে চলিতে গোবিন্দের কথাগুলা মনে করিয়া রমেশের সমস্ত মন ঘৃণায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সে অর্দ্ধেক পথ হইতে ফিরিয়া আসিয়া সেই রাত্রেই আবার বেণী ঘোষালের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। চণ্ডীমণ্ডপের মধ্যে তখন তর্ক-কোলাহল উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু সে শুনিতেও তাহার প্রবৃত্তি হইল না। সোজা ভিতরে প্রবেশ করিয়া রমেশ ডাকিল, “জ্যাঠাইমা!”
জ্যাঠাইমা তাঁহার ঘরের সুমুখের বারান্দায় অন্ধকারে চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন; এত রাত্রে রমেশের গলা শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। “রমেশ? কেন রে?” রমেশ উঠিয়া আসিল। জ্যাঠাইমা ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “একটু দাঁড়া, বাবা, একটা আলো আন্তে ব’লে দি।” “আলোয় কাজ নেই জ্যাঠাইমা, তুমি উঠো না।” বলিয়া রমেশ অন্ধকারেই একপাশে বসিয়া পড়িল। তখন জ্যাঠাইমা প্রশ্ন করিলেন, “এত রাত্তিরে যে?”
রমেশ মৃদু কন্ঠে কহিল, “এখনো ত নিমন্ত্রণ করা হয়নি, জ্যাঠাইমা, তাই তোমাকে জিজ্ঞেস কর্তে এলুম।” “তবেই মুস্কিলে ফেল্লি বাবা! এঁরা কি বলেন? গোবিন্দ গাঙ্গুলী, চাটুয্যে মশাই—” রমেশ বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, “জানিনে, জ্যাঠাইমা, কি এঁরা বলেন। জান্তেও চাইনে—তুমি যা’ বল্বে তাই হবে।” অকস্মাৎ রমেশের কথার উত্তাপে বিশ্বেশ্বরী মনে মনে বিস্মিত হইয়া ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিলেন, “কিন্তু তখন যে বল্লি রমেশ, এরাই তোর সব চেয়ে আপনার! তা’ যাই হোক, আমার মেয়েমানুষের কথায় কি হবে বাবা? —এ গাঁয়ে যে আবার,—আর এ গাঁয়েই কেন বলি, সব গাঁয়েই—এ ওর সঙ্গে খায় না, ও তার সঙ্গে কথা কয় না—একটা কাজকর্ম্ম পড়ে গেলে আর মানুষের দুর্ভাবনার অন্ত থাকে না। কাকে বাদ দিয়ে কাকে রাখা যায়, এর চেয়ে শক্ত কাজ আর গ্রামের মধ্যে নেই।” রমেশ বিশেষ আশ্চর্য্য হইল না। কারণ, এই কয়দিনের মধ্যেই সে অনেক জ্ঞানলাভ করিয়াছিল। তথাপি জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, এ রকম হয়, জ্যাঠাইমা?” “সে অনেক কথা, বাবা। যদি থাকিস্ এখানে, আপনিই সব জান্তে পারবি। কারুর সত্যিকার দোষ-অপরাধ আছে, কারুর মিথ্যে অপবাদ আছে—তা’ ছাড়া মামলা—মকদ্দমা, মিথ্যে সাক্ষী দেওয়া নিয়েও মস্ত দলাদলি। আমি যদি তোর ওখানে দুদিন আগে যেতুম, রমেশ, তা হ’লে এত উদ্যোগ আয়োজন কিছুতে ক’রতে দিতুম না। কি যে সেদিন হবে, তাই কেবল আমি ভাবচি।” বলিয়া জ্যাঠাইমা একটা নিশ্বাস ফেলিলেন। সে নিশ্বাসে যে কি ছিল, তাহার ঠিক মর্ম্মটি রমেশ ধরিতে পারিল না, এবং কাহারো সত্যকার অপরাধই বা কি এবং কাহারও মিথ্যা অপবাদই বা কি হইতে পারে, তাহাও ঠাহর করিতে পারিল না। বরঞ্চ উত্তেজিত হইয়া কহিল,—“কিন্তু আমার সঙ্গে ত তার কোন যোগ নেই। আমি একরকম বিদেশী বল্লেই হয়—কারো সঙ্গে কোন শত্রুতা নেই। তাই আমি বলি জ্যাঠাইমা, আমি দলাদলির কোন বিচারই কর্ব না, সমস্ত ব্রাহ্মণ-শূদ্রই নিমন্ত্রণ করে আস্ব। কিন্তু, তোমার হুকুম ছাড়া ত পারিনে; তুমি হুকুম দাও জ্যাঠাইমা!” জ্যাঠাইমা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিয়া বলিলেন—“এ রকম হুকুম ত দিতে পারিনে রমেশ! তাতে ভারি গোলযোগ ঘটবে। তবে তোর কথাও যে সত্যি নয়, তাও আমি বলিনে। কিন্তু এ ঠিক সত্যি-মিথ্যের কথা নয়, বাবা। সমাজ যাকে শাস্তি দিয়ে আলাদা ক’রে রেখেচে, তাকে জবরদস্তি ক’রে ডেকে আনা যায় না। সমাজ যাই হোক্, তাকে মান্য করতেই হবে। নইলে তার ভাল কর্বার মন্দ কর্বার কোন শক্তিই থাকে না—এ রকম হ’লে ত কোনমতে চল্তে পারে না রমেশ!” ভাবিয়া দেখিলে রমেশ এ কথা যে অস্বীকার করিতে পারিত, তাহা নহে; কিন্তু এইমাত্র নাকি বাহিরে এই সমাজের শীর্ষস্থানীয়দের ষড়্যন্ত্র এবং নীচাশয়তা তাহার বুকের মধ্যে আগুনের শিখার মত জ্বলিতেছিল, তাই, সে তৎক্ষণাৎ ঘৃণাভরে বলিয়া উঠিল, “এ গাঁয়ের সমাজ বল্তে ধর্ম্মদাস, গোবিন্দ—এঁরা ত? এমন সমাজের একবিন্দু ক্ষমতাও না থাকে, সেই ত ঢের ভাল, জ্যাঠাইমা!” জ্যাঠাইমা রমেশের উষ্ণতা লক্ষ্য করিলেন; কিন্তু শান্তকণ্ঠে বলিলেন, “শুধু এঁরা নয়, রমেশ, তোমার বড়দা’ বেণীও সমাজের একজন কর্ত্তা।” রমেশ চুপ করিয়া রহিল। তিনি পুনরপি বলিলেন, “তাই আমি বলি, এঁদের মত নিয়ে কাজ করো গে, রমেশ! সবেমাত্র বাড়ীতে পা দিয়েই এঁদের বিরুদ্ধতা করা ভাল নয়।” বিশ্বেশ্বরী কতটা দূর চিন্তা করিয়া যে এইরূপ উপদেশ দিলেন, তীব্র উত্তেজনার মুখে রমেশ তাহা ভাবিয়া দেখিল না; কহিল, “তুমি নিজে এইমাত্র বল্লে জ্যাঠাইমা, নানান্ কারণে এখানে দলাদলির সৃষ্টি হয়। বোধ করি, ব্যক্তিগত আক্রোশটাই সবচেয়ে বেশী। তা’ ছাড়া, আমি যখন সত্যিমিথ্যে কারো কোন দোষ অপরাধের কথাই জানিনে, তখন, কোন লোককেই বাদ দিয়ে অপমান করা আমার পক্ষে অন্যায়।” জ্যাঠাইমা একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, “ওরে পাগ্লা, আমি যে তোর গুরুজন—মায়ের মত। আমার কথাটা না শোনাও ত তোর পক্ষে অন্যায়!” “কি কর্ব জ্যাঠাইমা, আমি স্থির করিচি, আমি সকলকেই নিমন্ত্রণ কর্ব।” তাহার দৃঢ়সঙ্কল্প দেখিয়া বিশ্বেশ্বরীর মুখ অপ্রসন্ন হইল; বোধ করি বা মনে মনে বিরক্ত হইলেন; বলিলেন, “তা হ’লে আমার হুকুম নিতে আসাটা তোমার শুধু একটা ছল মাত্র।” জ্যাঠাইমার বিরক্তি রমেশ লক্ষ্য করিল, কিন্তু বিচলিত হইল না। খানিক পরে আস্তে আস্তে বলিল, “আমি জান্তুম জ্যাঠাইমা, যা অন্যায় নয়, আমার সে কাজে তুমি প্রসন্নমনে আমাকে আশীর্ব্বাদ করবে। আমার—” তাহার কথাটা শেষ হইবার পূর্ব্বেই বিশ্বেশ্বরী বাধা দিয়া বলিয়া উঠিলেন, কিন্তু এটাও ত তোমার জানা উচিত ছিল, রমেশ, যে, আমার সন্তানের বিরুদ্ধে আমি যেতে পার্ব না?”
কথাটা রমেশকে আঘাত করিল। কারণ, মুখে সে যাই বলুক, কেমন করিয়া তাহার সমস্ত অন্তঃকরণ কা’ল হইতে এই জ্যাঠাইমার কাছে সন্তানের দাবী করিতেছিল, এখন দেখিল, এ দাবীর অনেক ঊর্দ্ধে তাঁর আপন সন্তানের দাবী জায়গা জুড়িয়া বসিয়া আছে। সে ক্ষণকালমাত্র চুপ করিয়া থাকিয়াই উঠিয়া দাঁড়াইয়া চাপা অভিমানের সুরে বলিল,—“কা’ল পর্য্যন্ত তাই জান্তুম, জ্যাঠাইমা! তাই তোমাকে তখন বলেছিলুম, যা’ পারি, আমি একলা করি, তুমি এসো না, তোমাকে ডাকবার সাহসও আমার হয়নি।” এই ক্ষুণ্ণ অভিমান জ্যাঠাইমার অগোচর রহিল না। কিন্তু আর জবাব দিলেন না, অন্ধকারে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। খানিকপরে রমেশ চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই বলিলেন, “তবে একটু দাঁড়াও বাছা, তোমার ভাঁড়ার ঘরের চাবিটা এনে দিই” বলিয়া ঘরের ভিতর হইতে চাবি আনিয়া রমেশের পায়ের কাছে ফেলিয়া দিলেন। রমেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া অবশেষে গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া চাবিটা তুলিয়া লইয়া আস্তে আস্তে চলিয়া গেল। ঘণ্টাকয়েকমাত্র পূর্ব্বে সে মনে মনে বলিয়াছিল, ‘আর আমার ভয় কি, আমার জ্যাঠাইমা আছেন।’ কিন্তু একটা রাত্রিও কাটিল না, তাহাকে আবার নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিতে হইল, “না, আমার কেউ নেই—জ্যাঠাইমাও আমাকে ত্যাগ করিয়াছেন।”