অনুরাধা – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ছয়
এমনি করিয়া এই পাঁচটা দিন কাটিল। মেয়েদের যত্নের ছবিটা বিজয়ের মনে ছিল চিরদিনই অস্পষ্ট, মাকে সে ছেলেবেলা হইতে অসুস্থ ও অপটু দেখিয়াছে, গৃহিণীপনার কোন কর্তব্যই তিনি সম্পূর্ণ করিয়া উঠিতে পারেন নাই—নিজের স্ত্রীও ছিল মাত্র বছর–দুই জীবিত—তখন তাহার পাঠ্যাবস্থা। ইহার পরে হইতে দীর্ঘকাল কাটিয়া গেল সুদূর প্রবাসে। সেদিকের অভিজ্ঞতার ভালো–মন্দ অনেক স্মৃতি মাঝে মাঝে মনে পড়ে, কিন্তু সমস্তই যেন অবাস্তব বইয়ে পড়া কল্পিত কাহিনী। জীবনের সত্য প্রয়োজনে একেবারে সম্বন্ধবিহীন।
আর আছে তাহার দাদার স্ত্রী প্রভাময়ী। যে পরিবারে বৌদিদিদের বিচার চলে, ভালো–মন্দর আলোচনা হয়, সে পরিবার তাহাদের নয়। মাকে অনেকদিন কাঁদিতে দেখিয়াছে, বাবা বিরক্ত ও বিমর্ষ হইয়াছেন, কিন্তু এ–সকল সে নিজেই অসঙ্গত ও অনধিকার–চর্চা মনে করিয়াছে। জ্যাঠাইমা দেবর–পুত্রের খোঁজ না রাখিলে, বধূ শ্বশুর–শাশুড়ীর সেবা না করিলে যে প্রচণ্ড অপরাধ হয়, এ ধারণা তাহার নয়। তাহার নিজের স্ত্রীকেও অনুরূপ আচরণ করিতে দেখিলে সে যে মর্মাহত হইত তাহাও নয়। কিন্তু তাহার এতকালের ধারণাকে এই শেষের পাঁচটা দিন যেন ধাক্কা দিয়া নড়বড়ে করিয়া দিল। আজ সন্ধ্যার ট্রেনে তাহার যাত্রা করিবার সময়, চাকর জিনিসপত্র বাঁধিয়া প্রস্তুত করিতেছে, আর ঘণ্টা–কয়েক মাত্র দেরি, সন্তোষ আসিয়া আড়াল হইতে বলিল, মাসীমা খেতে ডাকচেন।
এমন সময়ে?
হাঁ, বলিয়াই সে সরিয়া পড়িল।
বিজয় ভিতরে আসিয়া দেখিল যথারীতি বারান্দায় আসন পাতিয়া ঠাঁই করা হইয়াছে; মাসির গলা ধরিয়া কুমার ঝুলিতেছিল, তাহার হাত হইতে নিজেকে মুক্ত করিয়া অনুরাধা রান্নাঘরে গিয়া প্রবেশ করিল।
আসনে বসিয়া বিজয় কহিল, এ কি ব্যাপার!
ভিতর হইতে অনুরাধা বলিল, দুটি খিচুড়ি রেঁধে রেখেচি, খেতে বসুন।
জবাব দিতে গিয়া আজ বিজয়কে গলাটা একটু পরিষ্কার করিয়া লইতে হইল, কহিল, অসময়ে কেন আবার কষ্ট করতে গেলেন? আর যদি করলেন খান–কতক লুচি ভেজে দিলেই হ’তো।
অনুরাধা কহিল, লুচি ত আপনি খান না। বাড়ি পৌঁছতে রাত্রি দুটো–তিনটে বাজবে, না খেয়ে উপোস করে গেলেই কি কষ্ট আমার কম হবে? কেবলি মনে পড়বে ছেলেটা না খেয়ে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
বিজয় নীরবে কিছুক্ষণ আহার করিয়া বলিল, বিনোদকে বলে গেলুম সে যেন আপনাকে দেখে। যে–ক’টা দিন এ–বাড়িতে আছেন যেন অসুবিধে কিছু না হয়।
সে আবার কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিল, আর একটা কথা জানিয়ে যাই। যদি দেখা হয় গগনকে বলবেন, আমি তাকে মাপ করেচি, কিন্তু এ গাঁয়ে যেন আর না সে আসে। এলে ক্ষমা করব না।
কখনো দেখা হলে তাঁকে জানাব, এই বলিয়া অনুরাধা ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, মুশকিল হয়েছে কুমারকে নিয়ে। আজ সে কিছুতেই যেতে চাচ্চে না। অথচ কেন যে চাচ্চে না তাও বলে না।
বিজয় কহিল, বলতে চায় না নিজেই জানে না বলে। অথচ, মনে মনে বোঝে সেখানে গেলে ওর কষ্ট হবে।
কষ্ট হবে কেন?
সে বাড়ির নিয়ম ওই। কিন্তু হ’লোই বা কষ্ট, এর মধ্যে দিয়েই ত ও এত বড় হ’লো।
তা হলে গিয়ে কাজ নেই। থাক আমার কাছে।
বিজয় সহাস্যে কহিল, আমার আপত্তি নেই, কিন্তু বড়জোর এই মাসটা, তার বেশী ত থাকতে পারবে না–তাতে লাভ কি?
উভয়েই মৌন হইয়া রহিল।
অনুরাধা বলিল, ওর বিমাতা যিনি আসবেন শুনেচি তিনি শিক্ষিতা মেয়ে।
হ্যাঁ, তিনি বি. এ. পাস করেছেন।
কিন্তু, বি. এ. পাস ত ওর জ্যাঠাইমাও করেছেন।
নিশ্চয় করেছেন। কিন্তু বি. এ. পাসের কেতাবের মধ্যে দেওরপোকে যত্ন করার কথা লেখা নেই। সে পরীক্ষা তাঁকে দিতে হয়নি।
কিন্তু রুগ্ন শ্বশুর–শাশুড়ী? সে কথাও কি কেতাবে লেখে না?
না। এ প্রস্তাব আরও হাস্যকর।
হাস্যকর নয় এমন কি কিছু আছে?
আছে। বিন্দুমাত্র অনুযোগ না করাই হচ্ছে আমাদের সমাজের সুভদ্র বিধি।
অনুরাধা ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, এ বিধি আপনাদেরই থাক। কিন্তু যে বিধি সকলের সমান সে হচ্চে এই যে, ছেলের চেয়ে বি. এ. পাস বড় নয়। এমন মেয়েকে ঘরে আনা অনুচিত।
কিন্তু আনতে কাউকে ত হবেই। যে দলের আবহাওয়ার মধ্যে গিয়ে আমরা দাঁড়িয়েছি সেখানে বি. এ. পাস নইলে মানও বাঁচে না, মনও বোঝে না। এবং বোধ হয় ঘরও চলে না। মা-বাপ-মরা বোনপোর জন্যে গাছতলা স্বীকার করে নিতে চায় এমন মেয়ে নিয়ে আমাদের বনবাস করা চলে, কিন্তু সমাজে বাস করা চলে না।
অনুরাধার কণ্ঠস্বর পলকের জন্য তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল—না, সে হবে না। একজন নির্দয় বিমাতার হাতে তুলে দিতে ওকে আপনি পারবেন না।
বিজয় কহিল, সে ভয় নেই। কারণ, তুলে দিলেও হাত থেকে আপনিই গড়িয়ে কুমার নীচে এসে পড়বে। কিন্তু তাই বলে তিনি নির্দয়ও নয়, এবং আমার ভাবী পত্নীর স্বপক্ষে আপনার কথার আমি তীব্র প্রতিবাদ করি। মার্জিত রুচিসম্মত উদাস অবহেলায় তাঁদের নেতিয়ে–পড়া আত্মীয়তায় বর্বরতার লেশ নেই। ও দোষটা দেবেন না।
অনুরাধা হাসিয়া বলিল, প্রতিবাদ যত খুশি করুন, কিন্তু জিজ্ঞেসা করি, নেতিয়ে-পড়া আত্মীয়তার মানেটা হলো কি?
বিজয় বলিল, ও আমাদের বড় সার্কেলের পারিবারিক বন্ধন। ওর কোড আলাদা, চেহারা স্বতন্ত্র। ওর শেকড় টানে না রস, পাতার রঙ সবুজ না হতেই ধরে হলুদের বর্ণ। আপনি পাড়াগাঁয়ে গৃহস্থঘরের মেয়ে, ইস্কুলে-কলেজে পড়ে পাস করেন নি, পার্টিতে পিকনিকে মেশেন নি, ওর নিগূঢ় অর্থ আপনাকে আমি বোঝাতে পারব না, কেবল এইটুকু আশ্বাস দিতে পারি কুমারের বিমাতা এসে তাকে বিষ খাওয়াবার আয়োজনও করবেন না, চাবুক-হাতে তাড়া করেও বেড়াবেন না। কারণ সে মার্জিত রুচিবিরুদ্ধ আচরণ। সুতরাং সেদিকে নির্ভয় হতে পারেন।
অনুরাধা বলিল, আমি তাঁর কথা ছেড়ে দিলুম, কিন্তু আপনি নিজে দেখবেন কথা দিন। এই আমার মিনতি।
বিজয় কহিল, কথা দিতেই ইচ্ছে করে, কিন্তু, আমার স্বভাবও আলাদা, অভ্যাসও আলাদা। আপনার আগ্রহ স্মরণ করে মাঝে মাঝে দেখবার চেষ্টা করব, কিন্তু যতটা আপনি চান তা পেরে উঠব মনে হয় না। কিন্তু আমার খাওয়া শেষ হলো এখন যাই। যাবার উদ্যোগ করি গে। বলিয়া সে উঠিয়া পড়িল, কহিল, রইল কুমার আপনার কাছে, ওকে ছাড়বার দিন এলে দেবেন বিনোদকে দিয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে। প্রয়োজন হয় অসঙ্কোচে সন্তোষকেও সঙ্গে দেবেন। প্রথমে এসে যে ব্যবহার করেচি ঠিক সেই আমার প্রকৃতি নয়। এ ভরসা আর একবার দিয়ে চললুম—আমার বাড়িতে কুমারের চেয়ে বেশি অনাদর সন্তোষের ঘটবে না।
বাড়ির সম্মুখে ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়াইয়া, জিনিসপত্র বোঝাই দেওয়া হইয়াছে; বিজয় উঠিতে যাইতেছে, কুমার বলিল, বাবা, মাসীমা ডাকচেন একবার।
সদর দরজার পাশে দাঁড়াইয়া অনুরাধা কহিল, প্রণাম করব বলে ডেকে পাঠালুম, আবার কবে যে করতে পাবো জানিনে। এই বলিয়া গলায় আঁচল দিয়া দূর হইতে প্রণাম করিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া কুমারকে কোলের কাছে টানিয়া লইয়া বলিল, ঠাকুরমাকে ভাবতে বারণ করবেন। যে–ক’টা দিন ছেলেটা আমার কাছে রইল অযত্ন হবে না।
বিজয় হাসিয়া বলিল, বিশ্বাস করা কঠিন।
কঠিন কার কাছে? আপনার কাছেও নাকি? বলিয়া সেও হাসিতে গিয়া দু’জনের চোখাচোখি হইল। বিজয় স্পষ্ট দেখিতে পাইল তাহার চোখের পাতা দুটি জলে ভিজা। মুখ নামাইয়া বলিল, কুমারকে নিয়ে গিয়ে কিন্তু কষ্ট দেবেন না যেন। আর বলতে পাব না বলেই বার বার করে বলে রাখচি। আপনাদের বাড়ির কথা মনে হলে ওকে পাঠাতে আমার ইচ্ছে হয় না।
না-ই বা পাঠালেন।
প্রত্যুত্তরে সে শুধু একটা নিঃশ্বাস চাপিয়া চুপ করিয়া রহিল।
বিজয় বলিল, যাবার পূর্বে আপনার প্রতিশ্রুতির কথাটা আর একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাই। কথা দিয়েছেন কখনো কিছু প্রয়োজন হলে চিঠি লিখে আমাকে জানাবেন।
আমার মনে আছে। জানি, গাঙ্গুলিমশায়ের কাছে ভিক্ষুকের মতই আমাকে চাইতে হবে, মনের সমস্ত ধিক্কার বিসর্জন দিয়েই চাইতে হবে, কিন্তু আপনার কাছে তা নয়। যা চাইব স্বচ্ছন্দে চাইব।
কিন্তু মনে থাকে যেন, এই বলিয়া বিজয় যাইতে উদ্যত হইলে সে কহিল, তবে আপনিও একটা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। বলুন প্রয়োজন হলে আমাকেও জানাবেন?
জানাবার মত আমার কি প্রয়োজন হবে অনুরাধা?
তা কি করে জানব। আমার আর কিছু নেই, কিন্তু প্রয়োজন হলে প্রাণ দিয়ে সেবা করতেও ত পারব।
আপনাকে ওরা করতে দেবে কেন?
আমাকে কেউ বাধা দিতে পারবে না।