কতটা জমি দরকার – লিও টলস্টয়

ছয়

ওদের তর্কাতর্কির মাঝে শেয়ালের চামড়ার লম্বা টুপি-পরা একটা লােক সামনে এসে পঁড়াল। দোভাষী পাখমকে বলল, “ইনিই হচ্ছেন আমাদের সর্দার।”

সঙ্গে সঙ্গে পাখম সবচেয়ে সুন্দর একটা জামা আর সের-পাঁচেক ভালাে চা সর্দারকে উপহার দিল। সর্দার হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করলেন সেসব। তারপর তিনি তার আসনে বসলে বাসকিররা সমস্ত ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বলল। তাদের কথা শুনে সর্দার হাতের ইশারায় সবাইকে বসতে বললেন। হাসিমুখে তিনি রুশভাষায় পাখমকে বললেন, ‘বেশ, তুমি যা চাও তাই হবে। কোন্ জমিটা তােমার পছন্দ আমাদের দেখিয়ে দাও। আমাদের জমির কোনাে অভাব নেই।’

পাখম মনে মনে ভাবতে লাগল, যতটা সম্ভব জমি আদায় করে নিতে হবে। আর লেখাপড়া করে পাকাপাকিভাবে নেয়া উচিত। তা না হলে আজ দিচ্ছে, কাল যদি আবার কেড়ে নেয়।

এরকম ভাবনার পর সে সর্দারকে বলল, ‘আপনার দয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের জমির কোনাে অভাব নেই, তার মাঝ থেকে সামান্য একটুমাত্র চাইছি। কোন জমিটুক আমার হবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে চাই। আমি মেপে আমাকে লেখাপড়া করে দেয়া যাবে কি হুজুর? মানুষের মরা-বাঁচা ঈশ্বরের হাতে। আপনারা দয়ালু বলেই আমাকে এ জমি দিতে রাজি হয়েছেন, কিন্তু দুদিন পরে আপনাদের ছেলেমেয়েরা আবার সেটা কেড়েও তাে নিতে পারে।’

সর্দার সরল মানুষ। তিনি বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ। লেখাপড়া করেই তােমাকে দেব।’

পাখম এবার সেই বিদেশি লােকটির কথা তুলে বলল, তাকেও তাে আপনারা শহুরে পাকা দলিল করে জমি দিয়েছেন। দয়া করে আমার বেলায়ও সেরকম করুন।

এবার সর্দার পাখমের মনের কথাটি ধরতে পারলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে। আমাদের এখানে একজন মুন্সি থাকেন। সেই শহরে গিয়ে তােমার দলিলের ব্যবস্থা করে দেবে।’

‘আমাদের এখানে জমির দাম দিন প্রতি একহাজার রুবল মাত্র।’ ‘দিন-প্রতি’ কথাটা পাখম বুঝতে পারল না। তাই সে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘দিন প্রতি’ এটা আবার কেমন মাপ? একদিনে কত একর জমি হবে?’

‘জমির মাপজোখ আমরা বাপু তেমন জানি না। তাই দিনের হিসেবে আমরা জমি বিক্রি করি। অর্থাৎ একদিনের মধ্যে তুমি যতটা জমি ঘুরে আসতে পারবে তার সবটাই তােমার। এই হচ্ছে আমাদের জমির মাপ, আর তার দাম হল একহাজার রুবল।

পাখম অবাক হয়ে বলল, “বলেন কী! একদিনে তাে গােটা একটা জেলা ঘুরে আসা যায় !”

সর্দার হেসে ফেললেন। বললেন, ‘তাহলে একটা জেলার সমান জমিই তােমার হবে। তবে হ্যাঁ, একটা শর্ত আছে। যেখান থেকে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তুমি রওনা হবে, সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে যদি ঠিক সেখানে ফিরে আসতে না পারাে তবে তােমার টাকা বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।’

পাখম আবার জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, কতটা আমি গিয়েছি তার চিহ্ন রাখব কেমন করে?”

‘কেন, আমরা তােমার সঙ্গেই থাকব। পছন্দমতাে তুমি যেখান থেকে যাত্রা শুরু করবে। আমরা সেখানেই দাড়িয়ে থাকব আর তুমি হাঁটা শুরু করলে আমার কয়েকটি যুবক ঘােড়ায় চড়ে তােমার পিছে পিছে যাবে। তুমি যেখানে যেখানে বলবে সেখানেই তারা একটি করে খুঁটি পুতবে। তারপর সেই খুটি বরাবর লাঙল চালিয়ে দাগ দেয়া হবে। শুধু সূর্যাস্তের আগেই তােমাকে যাত্রা শুরুর জায়গায় ফিরে আসতে হবে। যতটা জমি তুমি ঘুরে আসতে পারবে সবটাই হবে তােমার।’

মনের খুশিতে পাখম যেন ফেটে পড়ছিল। ঠিক হল, আগামীকাল খুব ভােরে পাখম যাত্রা শুরু করবে।

আরাে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে তারা সকলে মিলে পান করল কুমিস, গরম ভেড়ার মাংস আর ধোয়া-ওঠা চা। খাওয়াদাওয়ার উৎসব শেষে পাখম শুতে গেল। আহ! কী সুন্দর নরম পাখির পালকের উষ্ণ বিছানা!

অন্যেরাও শােবার জন্য চলে গেল। কথা হল, আগামীকাল সূর্যাস্তের আগেই নদীর ধারের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সবাই এসে জমায়েত হবে।

পোস্টটি শেয়ার করুন