কতটা জমি দরকার – লিও টলস্টয়

দুই

এই কৃষকের বাড়ির পাশেই বাস করতেন এক মহিলা। তার প্রায় দুশাে চল্লিশ একর জমি ছিল। গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে বরাবরই তার ভালাে সম্পর্ক। কখনাে কারাের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করেননি। কিছুদিন হল তিনি তার জমির দেখাশােনা করার জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক নিযুক্ত করেছেন। এই লােকটি নানারকম জরিমানা করে আশপাশের কৃষকদের উপর অত্যাচার শুরু করেছে। পাখম এ-ব্যাপারে দারুণ সতর্ক, তবু কখনাে কোনাে সময়ে তার একটা ঘােড়া হয়তাে ঢুকে পড়ল মহিলার ক্ষেতে, কখনাে গরুটা গেল তার বাগানে, নয়তাে বাছুরটা বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ল, তার ফসল খেয়ে এল; আর এরকম কিছু ত্রুটি ঘটলেই জরিমানা দিতে হত পাখমকে।

এক শীতকালে চারদিকে গুজব রটে গেল যে এই জমিদার-মহিলা তার সব জমি বিক্রি করে ফেলবেন। আরাে শােনা গেল এই সমস্ত জমি এবং পাশের বড় রাস্তা সবই নাকি ওই মহিলার ওভারশিয়ার কিনবে। কথাটা কৃষকদের কানে গেলে তারা দুশ্চিন্তায় পড়ল। ভাবল এই লােক যদি এতবড় জমির মালিক হয়, তাহলে তাদের অবস্থা আরাে খারাপ হয়ে যাবে, বারবার জরিমানা করে চাষীদের নাজেহাল করে ছাড়বে। অথচ ওই জমির চারপাশেই এদের বসবাস। যেমন করেই হােক জমিটা তারা হাতছাড়া করতে রাজি নয়।

কাজেই গ্রামের সমিতির পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি-দল গেল মহিলার সঙ্গে দেখা করতে। তারা বলল, আপনার জমি ওভারশিয়ারের কাছে বিক্রি না করে আমাদের কাছে করুন, আমরা আপনাকে বেশি মূল্য দেব। মহিলা এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। তখন চাষীরা সমিতির নামে সমস্ত জমিটা কিনে নেবার চেষ্টা করল। বিরাট সভা ডাকল তারা, কিন্তু কোনাে মীমাংসায় পৌছুতে পারল না। আসলে হল কী, অলক্ষে শয়তান সকলের মনে এমনই ধোঁকা দিতে লাগল যে সবাই সবার উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলল। কাজেই তারা ঠিক করল, প্রত্যেকেই আলাদাভাবে যার যতটুকু ক্ষমতা সেই অনুযায়ী জমি কিনে নেবে। আর জমিদার মহিলাও এ-প্রস্তাবে রাজি হলেন।

একদিন পাখম জানতে পেল, তাদের এক প্রতিবেশী পঞ্চাশ একর জমি কিনছে অর্ধেক দাম দিয়ে। বাকি অর্ধেক টাকা একবছর পরে নিতে রাজি হয়েছেন মহিলা। শুনে পাখম ঈর্ষায় ফুলতে লাগল। সে ভাবল, অন্যে যদি সব জমি কিনে ফেলে তাহলে আমি কী করব? বউ এর সঙ্গে সে আলােচনায় বসল—দেখ, সবাই কিছু না কিছু জমি কিনছে। আমাদেরও একর বিশেক জমি কিনে নেয়া উচিত। দিনকালের যা অবস্থা, খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করাই একদিন অসম্ভব হয়ে উঠবে। ওভারশিয়ার তাে জরিমানা হিসাবেই আমাদের সব কেড়ে নিচ্ছে। ফতুর হওয়ার আগে আমাদের কিছু জমি কিনে রাখা দরকার।

শতখানেক রুবল তাদের আগে থেকেই জমানাে ছিল। এবার তারা একটা গাধার বাচ্চা আর অর্ধেক মৌমাছি বিক্রি করল। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকেও চাকরিতে পাঠিয়ে ওরা কোনােরকমে জমির অর্ধেক টাকা জোগাড় করে ফেলল।

টাকাগুলাে একসঙ্গে নিয়ে তিরিশ একর জমি এবং ছােট একটা বাগান পছন্দ করে পাখম মহিলার কাছে গেল জমি কিনতে। দরদস্তুর ঠিক করে মহিলার হাতে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে এল সে। পরে শহরে গিয়ে একটা দলিল লিখে তাতে সই করে সব পাকাপাকি হলে পাখম অর্ধেক টাকা দিল। কথা হল, জমির বাকি অর্ধেক দাম দুবছর শেষ হবার আগেই দিয়ে দেবে।

এবার সে শ্যালকের কাছ থেকে আরাে কিছু টাকা ধার করে বীজ কিনল। সময় হলে কেনা জমিতে বীজ বুনল। ফসল হল প্রচুর। কাজেই একবছরের মধ্যেই সে জমিদার মহিলার টাকা আর শ্যালকের দেনা দুই-ই শােধ করে দিল। ব্যস! পাখম হয়ে উঠল জমির মালিক। এখন সে নিজের জমিতে বীজ বােনে, ফসল কাটে, নিজের জমিতে ঘােড়া গরু নিয়ে ঘাস খাওয়ায়। আজকাল চাষ করতে, ফসল তুলতে কি বাগানের অবস্থা দেখতে যখনই সে ঘােড়ায় চড়ে নিজের জমিতে যায়, আনন্দে মন তার ভরে ওঠে। নিজের জমির ঘাসগুলােকে পর্যন্ত মনে হয় অন্য ঘাসের চেয়ে আলাদা; এখানে ফুলগুলােও যেন অন্যভাবে ফোটে। কত দিনই তাে পাশ দিয়ে যেতে-যেতে জমি দেখেছে সে এই জমি, জমির মাটি আজকের মতাে ভালাে তার কোনােদিনই লাগেনি।

পোস্টটি শেয়ার করুন