অলক্ষুণে জুতো – মোহাম্মদ নাসির আলী

অলক্ষুণে জুতো
– মোহাম্মদ নাসির আলী

অনেক কাল আগের কথা। আলী আবু আম্মুরী নামে একজন ধনীলোক বাস করত বাগদাদ শহরে। শহরের ওপরে তার যেমন ছিল একখানা চমৎকার বাড়ি, তেমনি ছিল যথেষ্ট টাকা-পয়সা। শহরে সবাই তাকে ধনী বলে জানত। কিন্তু বিদেশী কেউ হঠাৎ এসে তার জামাকাপড় দেখে মোটেই ধারণা করতে পারত না যে, লোকটা সত্যি ধনী।

তার পাড়া পড়শিরা প্রায়ই বলাবলি করতো : আলী আবু ধনী হবে না কেন? লোকটা নিজের জন্য একটি দিনারও ব্যয় করে না। চেয়ে দ্যাখো একবার ওর জুতোজোড়ার দিকে, তাহলেই বুঝতে পারবে ও ধনী হয়েছে কী করে। বলেই তারা হাসতে থাকত।

আলী আবুর পায়ের নাগরাই জুতো নিয়ে বাগদাদ শহরের শিশুরা অবধি হাসাহাসি করে। হাসবে না-ই-বা কেন? এমন একজোড়া পুরোনো জুতো সারা বাগদাদ শহরে কেউ খুঁজে পাবে না। কেউ কেউ বলে, ও একজোড়া জুতো পরে আলী আবু জিন্দেগি কাবার করে দিয়েছে।

কিন্তু একজোড়া জুতো কী করে এতদিন টিকতে পারে? হ্যাঁ, আলী আবুর জুতোর কোনো জায়গায় একটি ফুটো হলেই সে বেরোয় মুচির সন্ধানে।

বাগদাদের মুচিরাও তাকে চিনে ফেলেছে। তাকে দেখলেই তারা বলে ওঠে, ওতে আর তালি লাগানো চলবে না সাহেব, ওটা বাদ দিয়ে একজোড়া নতুন জুতো কিনুন।

আলী আবু কিন্তু সে কথায় কান দেয় না। সে আর এক মুচির কাছে যায়। এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে কেউ হয়তো একটা তালি লাগিয়ে দেয়। এমনি করে আলী আবুর নাগরাই জুতো সকলের পরিচিত হয়ে উঠল। এমনকি বন্ধুরা একে অপরকে বলতে লাগলো, আলী আবুর নাগরাই জুতোর মতো তোমার পরমায়ু হোক।

কিন্তু অবশেষে সেই বিখ্যাত জুতোই আলী আবুর দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে উঠলো। শহরের রাস্তায় বেরিয়ে একদিন সে যাচ্ছিল এক কাচের শিশি-বোতলের দোকানের পাশ দিয়ে। দোকানি তাকে দেখে বলে উঠল, এই যে আবু ভাই, আপনার জন্য একটা খোশ-খবর আছে। বিদেশি এক সওদাগর এসেছে, অনেকগুলো আতরের শিশি বেচতে। চমৎকার রঙিন ফুলকাটা শিশি। মোটে ৫০ দিনার দাম। কিনে একমাস ঘরে রাখলে তার দাম কম-সে-কম একশো দিনার দিয়েই আমি নেব। আমার বদনসিব যে এখন একটি দিনারও হাতে নেই।

অমন লাভের লোভ কে সামলাতে পারে, সামলানো সহজ বিষয় নয়। আলী আবুর রাতদিন চিন্তাই হচ্ছে, কী করে টাকা বাড়ানো যায়। কাজেই সে তৎক্ষণাৎ রঙিন শিশিগুলো কিনে বাড়ি নিয়ে গেল।

দিনকয়েক পরে আরেক বন্ধু এসে খবর দিল, একটা লোক এসেছে বসরাই গোলাপজল বেচতে। চমৎকার জিনিস কিন্তু দাম একেবারে সস্তা। কিছুদিন পরেই এর দাম দুইগুণ-তিনগুণ হতে বাধ্য। আর তোমার সেই রঙিন শিশি ভর্তি করে বেচলে, চাই কি চারগুণও পেতে পারো। আহা কী গোলাপ!

টাকা বাড়াবার কী অমূল্য সুযোগ। যোগাযোগটা চমৎকার-রঙিন শিশি, তাতে গোলাপজল। আলী আবু ৫০ দিনার দিয়ে গোলাপজল কিনে নিয়ে এলো।

শিশিগুলো গোলাপজলে ভর্তি করে সে যত্ন করে রেখে দিল জানালা বরাবর একটা তাকের উপর। শিশি- বোতল রাখার পক্ষে এই জায়গাটাই তার বাড়িতে সবচেয়ে নিরাপদ।

অল্প কয়েকদিনের ভিতর দু-দুটো লাভের কারবার করতে পেরে আলী আবুর মন খুশিতে আটখানা।

সেদিন দুপুরবেলা সে শহরের হাম্মামে গিয়ে ঢুকল গোসল করতে। ঠিক সে সময়ে হাম্মাম থেকে গোসল সেরে বেরিয়ে আসছিল ওমর বিন আদি নামে তার এক বন্ধু। আলী আবুকে দেখেই সে বলে উঠলো, আস্‌সালামো আলাইকুম, আবু ভাই।

আলী আবু সাথে সাথে জবাব দিল। এমন সময় ওমরের নজর পড়ল আবুর জুতোর ওপর। ধনী বন্ধুর জুতোর এ দুর্দশা দেখে সে মাথা নেড়ে বলল, ভাই আলী আবু, তোমার তো মা-শাল্লাহ টাকা-পয়সার কমতি নেই। একজোড়া নতুন জুতো কেন তুমি কিনছো না ভাই? সারাটা বাগদাদ শহর খুঁজেও তোমার নাগরাই জুতোর শামিল আর একজোড়া জুতো কেউ বের করতে পারবে না। সত্যি বলছি, তোমার এ জুতোকে এবার পেনশন দিয়ে একজোড়া নতুনের ব্যবস্থা করা উচিত।

এই বলে ওমর বিন আদি মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেল। আবু কোনো জবাব না দিয়ে শুধু মুচকি হাসলো।

গোসল সেরে কাপড়-জামা পরে আবু বাইরে এসে দেখল, তার জুতোজোড়া জায়গামতো রাখা নেই। আসলে লোকের পায়ের ধাক্কায় দূরে এক বেঞ্চির তলায় দুখানা জুতো দুপাশে পড়ে আছে। আবুর পুরোনো জুতো যেখানে ছিল, সেখানে পড়ে আছে একজোড়া দামি চকচকে নতুন জুতো। চমৎকার জুতো, তাও ঠিক আবুর পায়ের মাপের।

আবু তখন মনে মনে ভাবল, আমার বন্ধু ওমরেরই এ কাজ। সে-ই নতুন জুতোজোড়া কিনে আমাকে উপহার দিয়ে গেছে। এজন্যই মাথা নাড়ছিল ওমর। প্রাণ খুলে বন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবু নতুন জুতো পায়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেলো।

আসলে আবুর অনুমান কিন্তু মোটেই সত্য নয়। জুতোজোড়া ছিল শহরের কাজির। আবুর মতো তিনিও জুতো ছেড়ে হাম্মামে ঢুকেছিলেন গোসল করবার জন্য। বাইরে এসে কাপড় পালটাতে গিয়ে তিনি দেখলেন, জুতো নেই সেখানে। দেখেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, আমার জুতো কী হলো?

কাজির জুতো নিখোঁজ? খোঁজ খোঁজ সাড়া পড়ে গেল তক্ষুনি। চারদিকে খুঁজে পেতে অবশেষে পাওয়া গেল আলী আবুর রঙবেরঙের তালিওয়ালা সেই নাগরাই জোড়া।

সেই জুতো চিনতে কারও বাকি রইল না। তালিওয়ালা সেই জুতো বাগদাদ শহরের কে না চেনে?

এ জুতো সেই কমবখত আলী আবুর না হয়ে যায় না। আমার নতুন জুতো নিয়ে সে-ই পালিয়েছে। হাতে-নাতে এভাবে না ধরলে কে ভাবতে পারে যে, ব্যাটা জুতোচোর? ব্যাটাকে ধরে এনে আচ্ছা সাজা দিতে হবে আজ।

– বলে কাজি চিৎকার করতে লাগলেন।

তারপর লোকজনদের ডেকে পুরোনো জুতো পাঠিয়ে দিলেন আলী আবুর বাড়িতে। তারা গিয়ে দেখতে পেল, সত্যি সত্যি আলী আবুর পায়ে কাজির সেই নতুন জুতো।

পোস্টটি শেয়ার করুন