ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী – শওকত ওসমান

মামা বিজয়বাবু ভাগ্নে পরিবর্তনে কোনো খোঁজ পাননি গোড়ার দিকে। মুরারি ভালো ছেলে, লেখাপড়ায় ফাঁকি দেওয়ার অভ্যেস নেই। রেজাল্টই প্রমাণ।

মেসে থাকে মামা-ভাগ্নে। এক কামরায় ডবল সিট। মামা-ভাগ্নে অবিশ্যি কথাবার্তা হয় কম। কিন্তু মুরারির হালেচালে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। কথাবার্তা কম। তা গুরুজনের সঙ্গে বয়োকনিষ্ঠের চিরাচরিত আদবের ব্যাপার। মুরারি কলেজে না গিয়ে শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। পার্কে, গাছতলায় শুয়ে আকাশ-পাতাল বিচরণ করে—মামা এসবের বিন্দুবিসর্গ জানতেন না।

একদিন আপিস যাওয়ার সময় বিজয়বাবুর চোখে পড়ল, ভাগ্নে নিজের সিটে শুয়ে আছে। একটা বই খোলা বুকের ওপর। মামা ভাবলেন, হয়তো ক্লান্তির চোখে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। আপিস থেকে ফিরে এসে তিনি মুরারিকে যে অবস্থায় দেখেছিলেন ঠিক সেই অবস্থায় পড়া শুরু করেছিল। ফলে ক্লান্তির চোটে ওই দশা। কিন্তু টেবিলের ওপর ভাত-তরকারি চাপা রয়েছে। বামনঠাকুরকে বলা আছে, মেসে কারো আবশ্যক পড়লে টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে রাখবে—সময়মতো যার যখন খুশি খাবে। ঢাকনি তুলে বিজয়বাবু দেখেন, মুরারি কিছু স্পর্শ করেনি।

মামা বিচলিত হয়ে পড়লেন। গোয়ালপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ-দর্শন। আপিস-ফেরত তিনি নিজেও ক্লান্ত। হাতমুখ ধুয়ে টিফিন সেরে অকুস্থলে পৌঁছলেন।

মুরারি তখনো নির্বিকার, গভীর ঘুমে মগ্ন। মামার অস্তিত্ব কি গতিবিধির খোঁজ তার কাছে ছিল না।

বিজয়বাবু কিছুক্ষণ ভাগ্নের দিকে অপলক তাকিয়ে ডাক দিলেন, ‘মুরারি-মুরারি।’ বেশ কয়েকবার।

মুরারি আচমকা উঠে বসে এবং ঘুমভাঙা উচ্চারণ করে, ‘মামা—!’

—এ কী? তুই এখনো খাসনি? শরীর খারাপ?

—না।

—তবে?

—ক্ষিধে নেই।

—তাহলে শরীর খারাপ।

—না।

কথোপকথনের ভেতর মুরারি একসময় বলে বসে, ‘মামা, আমি মুখহাত ধুয়ে আসি। আপনার সঙ্গে কথা আছে।’

—জলদি আয়। খাবি নে?

—না। অবেলা অসময়ে না খাওয়াই শরীরের জন্যে ভালো।

বিজয়বাবু কিছু আশ্বস্ত হন। মনের চতুর্দিকে নানা আশঙ্কা। আবার কি পুরাতন ব্যাধি ফিরে এলো? অবহেলায় আহার স্বাস্থ্যপ্রদ নয়। এতটুকু যার চেতনায় স্বাক্ষর আছে, তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা অনর্থক।

মেসের উঠানে চৌবাচ্চা। সেখানেই বারোয়ারি স্নানের ব্যবস্থা। একটু পরে মুরারি ফিরে এলো গামছায় মাথা মুছতে মুছতে। সে কেবল মুখহাত ধোয়নি, মাথায়ও প্রচুর জল ঢেলেছে। তা মামার চোখ এড়িয়ে যায়নি।

কে বলবে, ওই ব্যক্তির ভেতর অপ্রকৃতিস্থ হওয়ার কোনো লক্ষণ আছে? এমনকি মুরারি ঠাকুরকে চা দিয়ে যেতে বললে। এক টিনে মামা-ভাগ্নের বিস্কুট থাকে এজমালি। মুরারি তা খেতে খেতে মামাকে জানায় যে, তার মাথায় কয়েক মাস থেকে একটা প্রশ্ন জেগেছে। এখন মাতুলের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষ।

বিজয়বাবু অমন কথায় মনে মনে খুব খুশি হলেন। তাঁর পূর্বাশঙ্কা তাহলে অমূলক। হয়তো শারীরিক কারণে মুরারি এতক্ষণ ঘুমিয়েছে এবং কিছু খায়নি।

জলখাবার শেষে মাতুল-ভাগ্নের সংলাপ শুরু হলো।

মুরারি। ক’মাস থেকে আমার মনে হচ্ছে, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। মানুষও তা হতে পারে।

বিজয়। তা কী করে সম্ভব?

মুরারি। সম্ভব। কেউ কোনোদিন চেষ্টা করে দেখেছে কি?

বিজয়। তা দেখেনি।

মুরারি। তাহলে কী করে আপনি বলতে পারেন মানুষের পক্ষে সর্বত্র বিরাজমান হওয়া অসম্ভব?

বিজয়। খামকা চেষ্টা করে লাভ কী?

মুরারি। খামকা না। চেষ্টা করে দেখা যাক। যদি সফল না হই, তখন বলা যাবে অসম্ভব।

বিজয়। যদি কেউ বলে আমি প্রশান্ত মহাসাগর এক গণ্ডূষে শুষে নেব, তা কী সম্ভব, না বিশ্বাসযোগ্য?

মুরারি। তা আলাদা ব্যাপার। বিরাজমানতার সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। আমার মতে চেষ্টা করে দেখা উচিত।

বিজয়। অনর্থক চেষ্টা। সম্ভব নয়। সব জায়গায় যাবি কী করে? তোর কাছে মোটর আছে, এরোপ্লেন আছে, না ট্রেন আছে?

মুরারি। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়ে যাবে।

বিজয়। অনর্থক চেষ্টা।

মুরারি। চেষ্টার পর অনর্থক বলতে পারেন। কেউ চেষ্টা করেনি। আমি মানুষের ইতিহাসে পথিকৃৎ হতে চাই। জনপ্রিয়তার একটি লক্ষ্য : মানুষের মধ্যে সর্বত্র বিরাজমানতা। প্রকৃতি বাদ যায়। তা যাক। মানুষের দিক থেকে জনপ্রিয়তার মধ্যে ঐশ্বরিক বিভূতি আছে। তাই মানুষ জনপ্রিয় হতে চায়।

বিজয়। কিন্তু ঈশ্বর নিরাকার। তার পক্ষে সর্বত্র বিরাজমানতা সম্ভব। মানুষের আকার আছে। সে একই সময়ে সর্বত্র কিভাবে বিরাজমান হবে?

পোস্টটি শেয়ার করুন