ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী – শওকত ওসমান

বিজয়বাবু ভাগ্নের এসব কীর্তিকলাপ সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল ছিলেন না। কারণ, খবর পৌঁছত না তাঁর কাছে। উপরিউক্ত খবর তিনি কাগজে পড়েছিলেন, ‘খামখেয়ালি যুবকের কাণ্ড’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে। তিনি ভাবতে পারেননি গুণধর যুবক তাঁর ভাগ্নে। রিপোর্টে নামের উল্লেখ ছিল না।

আর একবার টেলিফোনের তারগুচ্ছের ওপর বসে গান গাইতে শুরু করেছিল মুরারি। ইলেকট্রিক তার হলে তো চরম একটা কিছু ঘটে যেত।

বিজয়বাবুর জবাবদিহি ছিল নিজের বিবেকের কাছে। তাঁর পরামর্শেই তো ভাগ্নে আজ শহরে। তবে তখনো তিনি হাল ছাড়ার বান্দা নন। ভাবতেন ব্যাধি সাময়িক এবং পূর্বের মতো একদিন সেরে যাবে।

কলেজের ছুটিতে বাড়ি যায়নি মুরারি। বাবার চিঠি আসে। মামা উত্তর দেন। বাহানার অভাব হয় না। পরীক্ষা প্রস্তুতি বা ওই জাতীয় আর কিছু। গাঁয়ে গেলে ঘুরে বেড়াবে, পড়াশোনার ক্ষতি হবে।

কিন্তু পরিস্থিতি কূলে ওঠে না। মামা-ভাগ্নের সংলাপ তিক্ত হতে থাকে।

—খোকা, ঈশ্বরের সঙ্গে কি মানুষ পারে?

—হয়তো পারে না। কিন্তু চেষ্টা করে দেখা উচিত। জানো, মামা—।

মামা ভাগ্নের মুখের দিকে তাকান। ওদিকে বাক্যস্রোত যথা-প্রবাহিত, ‘আমি আজকাল কোনো বড় মিটিং বাদ দিইনে। সব জায়গায় যাই। সর্বত্র বিরাজমানতার এই এক উপায়।’

কীভাবে? কৌতূহলে মাতুলের প্রশ্ন।

মিটিংয়ে হাজার হাজার লোক জমে। সেখানে তাদের নিশ্বাস মিশে যাচ্ছে। তুমি এক জায়গায় থেকেও আর একই জায়গায় নেই। তোমার নিশ্বাস তখন প্রবাহপথ পেয়েছে, ধেয়ে চলেছে ওই জোয়ারে।

ভাগিনা থামে। সে ফিলসফির ছাত্র এবং ভালো ছাত্র। মামা আর তর্কে প্রবৃত্ত হন না। আপন দুর্বলতা-সচেতন মামা তাই কথার মোড় ফেরাতে বলেন, ‘খোকা, অসম প্রতিযোগিতা আসলে ভালো নয়। ঈশ্বরের সঙ্গে বেয়াদবি পাপ। তা আখেরে সর্বনাশ ডেকে আনে।’

—বাজে কথা। আমি কোনো বেয়াদবি করছি না, আমি মানুষ হিসেবে চেষ্টা করছি।

মামা হটে গেলেন। কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে বেশি দেরি লাগল না।

সাধারণত যেখানেই যাক, মুরারি রাত্রি দশটা কি এগারোটার মধ্যে ফিরে আসত। মামা নিশ্চিন্ত থাকতেন। অন্তত নিরাপত্তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেনি তাঁর ভগিনীপুত্র।

শীতের এক রাত্রে মুরারি বিছানা ছেড়ে বাইরে পা বাড়িয়েছিল। মামা আদৌ টের পাননি। মুরারির সেই রাত্রির অ্যাডভেঞ্চার পুলিশ ও অন্যান্য সূত্র ধরে পরে রিপোর্টের আকারে পাওয়া যায়।

মুরারির গায়ে ছিল শুধু সুতি চাদর আর ভেতরে গেঞ্জি। পৌষের শেষ। কিন্তু শীতের প্রকোপ কিছু কম ছিল না। মুরারি পাড়া থেকে বেরিয়ে শহরের রাস্তায় পয়লা দফা না হেঁটে গড়িয়ে-গড়িয়ে গায়ে ধুলো মেখেছিল। পরে চাদর খুলে বগলে তুলে নেয় সে। অত রাত্রে পথে কোনো লোক ছিল না। তবু এক বিরল পথচারী তাকে পাগল ভেবে আর কাছে যায়নি বটে, তবে মুরারির প্রলাপ তথা চিৎকার তার কানে পড়েছিল : ‘তিনি সর্বত্র আছেন। জনপ্রিয়তার মধ্যে সেই লক্ষণ মেলে, যা সর্বত্র বিরাজমানতার মধ্যেও পাওয়া যায়। আমিও তেমন সর্বত্র থাকব। কেন থাকব না?’ পথিক-জন গায়ে গরম কোট চাপিয়েও শীতের জুলুমে কাঁপছিল। তখন তার চোখে পড়েছিল, মুরারির উদোম গা, ধুতি মালকোঁচা-মারা আর চাদর বগলে। পাগলের কাণ্ড দেখার ধৈর্য ছিল না পথিকের, এই রিপোর্টটুকু পুলিশের সংগ্রহ।

শীতের রাত্রি গভীর এবং বিস্তৃত। মুরারি অতক্ষণ কী করছিল, তার সব হদিস তো জানার উপায় নেই। তবে পরিমাণ দেখে কিছু কিছু অনুমান করা যায়।

সে মাটির ওপর গড়াগড়ি ছেড়ে কোনো একপর্যায়ে হেঁটেছিল বা দৌড় দিয়েছিল—অথবা এই জাতীয় কিছু করেছিল, যার ফলে সে তিন মাইল দূরে শহরতলিতে পৌঁছায়। বর্ধিষ্ণু শহরের শিং ষাঁড়ের মতো মাটি গুঁতিয়ে-গুঁতিয়ে এগোয়। শিঙের আগায় ধুলোবালি-ময়লা, অন্যান্য আবর্জনা লেগে থাকা স্বাভাবিক। নগর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। এই এলাকায় বাস করে সমাজেও যারা আবর্জনা বিশেষ—মেথর, মুদ্দাফরাস, দীনদরিদ্র, ছিন্নমূল মানুষ। বস্তি তাঁরাই জাঁকিয়ে তোলে সেখানে নর্দমা এবং আকাশের মুখোমুখি অবস্থান ঘটে।

মুরারিকে এমন নর্দমায় পাওয়া যায় পরদিন ভোরে। তখন সে মৃত। মেথরপট্টির পালিত শুয়োরের লীলাভূমি এইসব নর্দমা। মুরারির আশপাশে শুয়োর চরছিল। পোস্টমর্টেম থেকে জানা যায়, ওর শরীর থেকে অনেক রক্ত ঝরেছিল। দেহের কয়েক জায়গায় জখম। অনুমান করা যায়, পুলিশেরও তাই ধারণা, কোনো দাঁতাল শুয়োরের চারণভূমিতে মুরারি অনধিকার প্রবেশ করতে গিয়েছিল। জন্তু তাকে আদৌ শ্রদ্ধা দেখায়নি।

মুরারি জীবনের শেষ অঙ্ক এমনই অনুমানের ব্যাপার হয়ে রইল। ছোট মানিব্যাগে-রক্ষিত চিরকুট থেকে ঠিকানা পাওয়া যায়। ভোর থেকে উৎকণ্ঠিত বিজয়বাবুর কাছে সব খবর পৌঁছায় সন্ধ্যায়—পুলিশের কল্যাণে।

অনেককাল পূর্বের ঘটনা।

অনেক কিছু ভুলে যাওয়ার কথা।

কেবল আজও মুরারি আমার স্মৃতির রাজ্যে সর্বত্র বিরাজমান।


পোস্টটি শেয়ার করুন