ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী – শওকত ওসমান
ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী
– শওকত ওসমান
আমরা সহপাঠী ছিলাম। হৃদ্যতার বন্দি।
বলা বাহুল্য, একই স্কুল। রূপচাঁদ ভুক্ত ছিলেন এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি। তাঁরই বদান্যতায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রামের নাম নন্দনপুর। শ্রীযুক্ত রূপচাঁদ উক্ত গ্রামের অধিবাসী ছিলেন না। সুতরাং এখন উপলব্ধি করা যায়, বদান্যতার সঙ্গে বিশেষ মহানুভবতা ছিল। প্রতিষ্ঠাতা নিজের গ্রাম নয়, কেন্দ্রীয় একটি গ্রাম বেছে নেন যেন আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিদ্যার্থীরা স্কুলে আসতে পারে। পাশ দিয়েই চলে গিয়েছিল সেকালের সরকারি জেলা বোর্ডের সড়ক। পাড়াগাঁয়ে যাতায়াতের কথাও ভাবতে হয়। চষা ক্ষেত, মাঠের আল, খানাখোন্দল, এবড়োখেবড়ো জমি—বিদ্যার্জন এবং লোক-চলাচলের আদ্যে অনুকূল নয়। শ্রীযুক্ত ভুক্ত তা জানতেন—সেদিক থেকেও তাঁর দৃষ্টি প্রশংসনীয়।
আরো একটি কথা বলে রাখা যায়। ষাট বছর পূর্বে অর্থাৎ সে যুগে স্কুলের শ্রেণিবিভাগ আজকের মতো ছিল না। সপ্তম শ্রেণী থেকে উচ্চ ইংরেজি স্কুল বা ইংলিশ হাই স্কুলের ক্লাস শুরু হোত। তারপর ষষ্ঠ শ্রেণী। এইভাবে ক্রমে ক্রমে কমে-কমে প্রথম শ্রেণী বা ফার্স্ট ক্লাস। বর্তমান যুগে গতি বিপরীত। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত কোথাও কোথাও যায়। এইসব কথা বলা অতীতের কিছু আঁচ দেওয়ার জন্যে।
পল্লী অঞ্চলে স্কুলের সংখ্যা সে-যুগে ছিল খুব কম। চার-পাঁচ মাইল দূর থেকে অনেককে বিদ্যাভ্যাসে আসতে হোত। শিক্ষাবিস্তারের কারো তাগিদ তাই কৃতজ্ঞতার তুলাদণ্ডে ওজন করা কঠিন ছিল ওই যুগে।
রূপচাঁদ ভুক্ত হাই স্কুলে মুরারি পাচাল ছিল আমার সহপাঠী—ষষ্ঠ শ্রেণীতে। পাচাল পদবিটি সচরাচর দেখা যায় না। আমি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম মুরারির মিষ্টি ব্যবহারে। তার চেহারাটিও ছিল আকর্ষণীয়। স্কুলে পণ্ডিতমশাই কবিতা মুখস্থ করতে দিতেন। মুরারি পাচালের আবৃত্তি হোত সবচেয়ে শ্রুতিমধুর। কৈশোরকাল ভবিষ্যতে সূচারুরূপে ধরা হয়। ক্লাসে মুরারি ফার্স্ট হোত না বটে, কিন্তু উপরের দিকে—অর্থাৎ, প্রথম চার-পাঁচজনের মধ্যে তার পজিশন ছিল বাঁধা।
ইংরেজি প্রবাদ : প্রত্যুষকাল দিনের সূচনা। কথাটা মুরারির ক্ষেত্রে মিথ্যে হয়ে গেল।
ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে প্রমোশন পাওয়ার পরই মুরারির মাথার গণ্ডগোল দেখা দিল। খেয়ালের বশে কখন কী করে বসবে বলা দায়। হাফ-ইয়ার্লি বা ষাণ্মাসিক পরীক্ষায় দেখা গেল সে ফার্স্ট হয়ে বসে আছে। সব বিষয়ে ফার্স্ট। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষা দিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে মাঠে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে, বিকেলে ‘ফিট’ হয়ে পড়ে গেল স্কুলের কম্পাউন্ডে। মাইল দুই দূরে গ্রাম। খবর পেয়ে বাড়ির লোকেরা ওকে তুলে নিয়ে যায়। পাঁচ দিন মুরারি বিছানায় পড়ে রইল। আশ্চর্য, এক জল ছাড়া আর কিছু আহার করল না। সাত দিনের মাথায় সে আবার স্বাভাবিক, যেন কিছুই ঘটেনি।
উদ্বিগ্ন মা-বাবা মুরারির চিকিৎসার দিকে মন দিলেন। সে যুগে মনোরোগের বৈজ্ঞানিক কেতায় চিকিৎসার কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। হাতুড়ে কবিরাজ, তুকতাক, ফুঁকফাঁক অথবা কোনো ঠাকুরের থানে মানত—এসবই ছিল দাওয়াই। কোনো মন্দির বা দরগায় ‘হত্যে’ দিয়ে পড়ে থাকারও রেওয়াজ ছিল। সেখানে হিন্দু-মুসলমান বিপদে পড়ে এক গোয়ালের গরু। ঠাকুরের থান বা পিরের দরগার ক্ষেত্রে সে যুগে কোনো সাম্প্রদায়িকতা ছিল না।
মুরারির বাবা-মা মুষড়ে পড়লেন। অমন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে শেষে এমন ব্যাধির খপ্পরে পড়ল। তখন মুরারি স্কুলে আসত খেয়ালের বশবর্তী হয়ে। গার্জেনদের সঙ্গে স্কুল-কর্তৃপক্ষের একটা অলিখিত চুক্তি ছিল। মুরারি স্কুলে যাক বা না যাক, বেতন দিয়ে যাবেন বাবা। তিনি উচ্চবিত্ত কৃষক। টাকাপয়সার তেমন অভাব ছিল না।
মুরারি স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিক—যেকোনো অবস্থায় আমার কাছে এলে শান্ত হয়ে যেত, কথা বলত আমার সঙ্গে। তার বেশির ভাগ অবিশ্যি অসংলগ্ন। কিন্তু তার আদব-কায়দার পরিধি একচুল এদিক-ওদিক হোত না। মুরারির বাবা তাই আমাকে তাঁদের বাড়ি যেতে বলতেন। আমার মা-বাবা আবার দু’মাইল রাস্তা একা একা আমাকে ছেড়ে দিতে রাজি হতেন না। কাজেই সঙ্গী খুঁজতে হোত। তবু মুরারি অসুস্থ হলে আমি তাদের বাড়ি যেতাম। সকালে গিয়ে বিকেলে ফেরা। আমারও তো লেখাপড়া আছে। তবু সব অবহেলায় পাশে ঠেলে মুরারিদের বাড়ি যেতে আমার ভালোই লাগত। কিন্তু কাছে গেলে মন হাঁকাহাঁকি জুড়ে দিত ভেতরে-ভেতরে—’পালাও, পালাও।’ কারণ, অসংলগ্ন প্রলাপ মাঝে মাঝে শোনার ধৈর্য কতক্ষণ আর থাকে?
রেহাই পাওয়া যেত বৈকি। যখন সে স্বাভাবিক তখন তো সে বহু সুবোধ বালকের চেয়েও ঢের বেশি শিষ্টাচারী। মাঝে মাঝে সে ক্লাস করত। টিচার পড়া ধরলে জবাব দিত একদম ঠিক ঠিক। ছেলে তো খারাপ নয়। একদিক থেকে তুখখার (তীক্ষ্নধার) বলা যায়। ক্লাসের ফার্স্ট বয় হয়তো নয়, তবে কাছাকাছি তো বটেই।
মুশকিল ওইখানে-কখন শ্রীমান মুরারি পাচালের মাথা বিগড়াবে, তার তো ঠাঁই-ঠিকানা নেই। বিগড়ে গেলে তো সে আর এক চিজ অথবা চিড়িয়া। হয়তো মাঠে মাঠে দৌড় মেরে শেষে কোনো পাড়ার কাছে এসে চিৎকার পাড়বে, ‘আমি এই কলিযুগের ত্রাণকারী। পাপে ভরে গেছে পৃথিবী। পাপ ঘরের ভেতর পোকার মতো কিলবিল করছে। আমি ফুঁ দিলেই সব উড়ে যাবে। ফুঁ-ফুঁ-ফুঁ…।’ তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে ফুৎকার-ধ্বনি প্রদান চলবে বহুক্ষণ।
এসব কাণ্ড বিসদৃশ কিছু নয়। আশপাশে যারা থাকে তাদের কিছু হাসির খোরাক। কিন্তু আরো নানা রকম ব্যাপার বাধিয়ে বসত মুরারি। কথায় বলে, পাগলের কাণ্ড। মাথা ভালো থাকলে সে সোজা স্কুলে চলে আসত। কামাই করত না। চুপচাপ বসে যেত পিছনের বেঞ্চিতে। অবিশ্যি মুরারির আবির্ভাবে ক্লাসের পরিবেশ সঙ্গে সঙ্গে অস্বাভাবিক হয়ে উঠত। শিক্ষক ক্লাসে, তাই ছাত্ররা হল্লার সুযোগ পেত না। কিন্তু গা টেপাটেপি করত চাপা-হাসিতে।
একদিন ক্লাসে সত্যি এক কাণ্ড ঘটে গেল। বলা বাহুল্য, মুরারির বেহাল হালৎ। আগে ওর ব্লাডপ্রেশার ছিল না। সম্প্রতি তাও এসে জুটেছে। মুরারি ক্লাসে ঢুকেই সম্বোধনী বক্তৃতা জুড়ে দেয়, ‘ভদ্রমহোদয় সঙ্গীগণ, আমি শ্রীমুরারি পাচাল, পিতা শ্রীঅমুকচন্দ্র পাচাল তস্য সন্তান আমি কোনো বদ্ধ পাগল নই। তবে আমি পাগাল। তা-ও ঠিক। ডিগ্রির হেরফের। হ্যাঁ আমি, কাল থেকে নয়, পাঁচ শ বছর আগে থেকে সন্ন্যাসী হয়ে গেছি। সংসারত্যাগী। আমার ইহজগতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। আমি সন্ন্যাসী…’
ভালো কথা, আমাদের অঙ্কের মাস্টারমশাই উপেনবাবু তখন ক্লাস নিচ্ছিলেন। তাঁর টেবিলের পাশে দাঁড়িয়েই মুরারি চার-পাঁচ মিনিট আরো উপদেশমূলক বক্তৃৃতা দিল। চমৎকার যুক্তির গাঁথুনি। কে বলে মুরারি পাগল। কিন্তু উপেনবাবু বোধ হয় ভুল করে তাকে বাধা দিয়ে ফেললেন। না, বাধাও ঠিক নয়। তিনি কেশে উঠেছিলেন। তখনো মুরারি সকলকে সম্বোধন করে বলে চলে, ‘বন্ধুগণ, আমি সন্ন্যাসী। ইহজগতের সঙ্গে আমার নীল-ইংরেজি নীল-বাংলার নয়। আমি সন্ন্যাসী—ঠিকই।’