পদ্মা নদীর মাঝি – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
গণেশকে ধনঞ্জয় চিড়া কিনিতে পাঠাঁইয়াছিল। সে ফিরিয়া আসিলে নৌকা খুলিয়া দেওয়া হইল। এখন বইঠা না ধরিলেও চলে। উজান স্রোতের টানে নৌকা আপনি গ্রামের দিকে ভাসিয়া চলিবে। গণেশ ও ধনঞ্জয় গুড় মুখে দিয়া শুকনো চিড়া চিবাইতে লাগিল। কুবের কিছু খাইল না। কেবল কয়েক আঁজলা নদীর জল পান করিল। নদীর বুক জুড়িয়া এখন ভাঙা ঢেউগুলির মাথায় অসংখ্য সূর্য জুলিয়া উঠিতেছে। কাকচিলা মাছরাঙা প্রভৃতি পাখিগুলি ক্ৰমাগত জলে ঝাঁপাইয়া মাছ ধরিতেছে। অনেক দূরে অস্পষ্ট সংকেতের মতো একটি স্টিমারের ধোঁয়া চোখে পড়ে। আকাশ উজ্জ্বল ও নির্মল। মেঘের চিহ্নও নাই।
গণেশ সহসা মমতা বোধ কবিয়া বলে, না আইলে পারতি কুবির আইজ। কুবের কোনো জবাব দেয় না। নিঃশব্দে থাকে।
গণেশ বলে, মাথাটা টিপা দিমু নাকি?
কুবের বলে, অঁ হঁ।
গণেশ খানিকক্ষণ ভাবিয়া বলে, হাল ধইরা যদি বইবার পারস্ কুবির, খুড়া আর আমি বইঠা বাই, তড়াতড়ি পৌঁছান যায়।
পুবদিকে গ্রামের বাহিরে জেলেপাড়া। চারিদিকে ফাঁকা জায়গার অন্ত নাই কিন্তু জেলেপাড়ার বাড়িগুলি গায়ে গায়ে ঘেঁষিয়া জমাট বাঁধিয়া আছে। প্রথম দেখিলে মনে হয় এ বুঝি তাহাদের অনাবশ্যক সংকীর্ণতা, উন্মুক্ত উদার পৃথিবীতে দরিদ্র মানুষগুলি নিজেদের প্রবঞ্চনা করিতেছে। তারপর ভাবিয়া দেখিলে ব্যাপারটা বুঝিতে পারা যায়। স্থানের অভাব এ জগতে নাই তবু মাথা গুজিবার ঠাঁই এদের ওইটুকুই। সবটুকু সমতল ভূমিতে ভূস্বামীর অধিকার বিস্তৃত হইয়া আছে, তাহাকে ঠেলিয়া জেলেপাড়ার পরিসর বাড়িতে পায় না। একটি কুঁড়ের আনাচেকানাচে তাহারই নির্ধারিত কম খাজনার জমিটুকুতে আরেকটি কুঁড়ে উঠিতে পায়। পুরুষানুক্ৰমে এই প্রথা চলিয়া আসিতেছে। তারই ফলে জেলে পাড়াটি হইয়া উঠিয়াছে জমজমাট।
দিন কাটিয়া যায়। জীবন অতিবাহিত হয়। ঋতুচক্ৰে সময় পাক খায়, পদ্মার ভাঙন ধরা তীরে মাটি ধসিতে থাকে, পদ্মার বুকে জল ভেদ করিয়া জাগিয়া উঠে চর, অর্ধ শতাব্দীর বিস্তীর্ণ চর পদ্মার জলে আবার বিলীন হইয়া যায়। জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে শিশুর ক্ৰন্দন কোনোদিন বন্ধ হয় না। ক্ষুধাতৃষ্ণার দেবতা, হাসিকান্নার দেবতা, অন্ধকার আত্মার দেবতা, ইহাদের পূজা কোনো দিন সাঙ্গ হয় না। এ দিকে গ্রামের ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণতর ভদ্রমানুষগুলি তাহদের দূরে ঠেলিয়া রাখে, ও দিকে প্রকৃতির কালবৈশাখী তাহদের ধ্বংস করিতে চায়, বর্ষার জল ঘরে ঢোকে, শীতের আঘাত হাড়ে গিয়া বাজে কনকন। আসে রোগ, আসে শোক। টিকিয়া থাকার নির্মম অনমনীয় প্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি কাড়াকড়ি করিয়া তাহারা হয়রান হয়। জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষন্ন। জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায়। আর দেশি মদে। তালের রস গাজিয়া যে মদ হয়, ক্ষুধার অন্ন পচিয়া যে মদ হয়। ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লিতে। এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।
পদ্মা ও পদ্মার খালগুলি ইহাদের অধিকাংশের উপজীবিকা। কেহ মাছ ধরে, কেহ মাঝিগিরি করে। কুবেরের মতো কেহ জাল ফেলিয়া বেড়ায় খাস পদ্মার বুকে, কুঁড়োজাল লইয়া কেহ খালে দিন কাটায়। নৌকার যাহারা মাঝি, যাত্রী লইয়া মাল বোঝাই দিয়া পদ্মায় তাহারা সুদীর্ঘ পাড়ি জমায়, এ গাঁয়ের মানুষকে ও গাঁয়ে পৌঁছাইয়া দেয়। এ জলের দেশ। বর্ষাকালে চারিদিক জলে জলময় হইয়া যায়। প্রত্যেক বছর কয়েকটা দিনের জন্য এই সময়ে মানুষের বাড়ি ঘর আর উঁচু জমিগুলি ছাড়া সারাটা দেশ জলে ডুবিয়া থাকে। জল যেবার বেশি হয় মানুষের বাড়ির উঠানও সেবার রেহাই পায় না। পথঘাটের চিহ্নও থাকে না। একই গ্রামে এ পাড়া হইতে ও পাড়ায় যাইতে প্রয়োজন হয় নৌকার। কয়েকদিন পরে জল কমিয়া যায়, জলের ভিতর হইতে পথগুলি স্থানে স্থানে উঁকি দিতে আরম্ভ করে, কিন্তু আরও একমাসের মধ্যে পথগুলি ব্যবহার করা চলে না। যানবাহন এ দেশে এক রকম নাই। মানুষের সম্বল নৌকা। উঠিতে বসিতে, সকলের নৌকার দরকার হয়।
নৌকার প্রয়োজন কমে সেই শীতের শেষে, ফালুন চৈত্র মাসে। খালে তখন জল থাকে না, মাঠে জলের বদলে থাকে ফসল অথবা ফসল-কাটা রিক্ততা। মানুষ মাঠের আলে আলে হাঁটিয়া গ্রাম হইতে গ্রামাস্তরে যায়।
নৌকা চলে পদ্মায়। পদ্মা তো কখনও শুকায় না। কবে এ নদীর সৃষ্টি হইযাছে কে জানে। সমুদ্রগামী জলপ্রবাহের আজও মুহুর্তের বিরাম নাই। গতিশীল জলতলে পদ্মার মাটির বুক কেহ কোনোদিন দ্যাখে নাই, চিরকাল গোপন হইয়া আছে।
জেলেপাড়া নদী হইতে বেশি দূরে নয়। তবু এইটুকু পথ চলিতেই কুবেরের কষ্ট হইতেছিল। নৌকায় সমস্ত পথটা আবোল-তাবোল বকিয়া গণেশ এতক্ষণে চুপ করিয়াছে। ধনঞ্জয় নৌকা হইতে নামে নাই। পাশের গ্রামে কুটুম বাড়িতে তাহার কী প্রয়োজন ছিল। নৌকা লইয়া সে একাই সেখানে চলিয়া গিয়াছে।
গণেশের বাড়িটাই পড়ে আগে। সে বাড়িতে ঢুকিল না। অসুস্থ কুবেরের সঙ্গে আগাইয়া চলিল।
নকুল দাস ঘরের দাওয়ায় বসিয়া তামাক খাইতেছিল। কুবেরকে দেখিতে পাইয়া ডাকিয়া বলিল, অ কুবির, শোন, শুইনা যা।
গণেশ বলিল, কুবির জুরে বড়ো কাতর গো।
নকুল বলিল, জুর নাকি? তবে যা, বাড়িত যা। দ্যাখ গিয়া বাড়িতে কী কাণ্ড হইয়া আছে।
এমন কথা শুনিয়া ব্যাপারটা না জানিয়া যাওয়া চলে না। কুবের উদ্বিগ্ন হইয়া বলিল, কীসের কাণ্ড নকুলদা?
শ্যাষ রাইতে তর বউ খালাস হইছে কুবির।
কুবের অবাক হইয়া বলিল, হ? নয় মাস পুইরা যে মাত্র কয়টা দিন গেছে নকুলদা? ইটা হইল কিবা?
ক্যান? নয় মাসে খালাস হয় না?
গণেশ জিজ্ঞাসা করিল, পুরুষ ছাওয়াল হইছে না?
নকুল সায় দিয়া বলিল, হ। আমাগোর পাঁচি গেছিল, আইসা কয় কী, কুবেরের ঘরে নি রাজপুত্তুর আইছে বাবা, ওই একরত্তি একখান পোলা, তাঁর চাঁদপানা মুখের কথা কী কমু। রং হইছে গোরা।
কুবেরের স্তিমিত চোখ দুটি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। নকুল শয়তানি হাসি হাসিয়া পরিহাস করিয়া বলিল, তুই ত দেখি কালা কুষ্টি কুবির, গোরাচাঁদ আইল কোয়ান থেইকা? ঘরে ত থাকস না রাইতে, কিছু কওন যায় না বাপু।
গণেশ রাগিয়া বলিল, বউ গোরা না নকুলদা?
হ, বউ ত গোরাই, হ?
এর বাড়ির পিছন দিয়া ওর বাড়ির উঠান দিয়া কুবের ও গণেশ এবাব একটু জোরে জোরে পা ফেলিয়াই বাড়ির দিকে আগাইয়া গেল। গণেশ ভারী খুশি। বারবার সে বলিতে লাগিল, পোলা হইব কই নাই কুবির? কই নাই ইবাব তর পোলা না হইয়া যায় না?
শেষে বিরক্ত হইয়া কুবের বলিল, চুপ যা গণেশ। পোলা দিয়া করুম কী নিজেগোর খাওন জোটে না, পোলা!
গণেশ ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, তুই নি গোসা করস কুবির?
কবুম না? মইরবার কস নাকি আমা্রে তুই?
তাহার মেজাজের এই আকস্মিক উত্তাপ গণেশের কাছে বড়াই দুর্বোধ্য ঠেকিল। অত তাহার ভবিষ্যতের কথা ভাবিবার, হিসাব করিবার ক্ষমতা নাই। বউ থাকিলে মাঝেমাঝে ছেলেমেয়ে হয় এই পর্যন্ত সে জানে, সুবিধা অসুবিধার কথাটা ভাবিয়া দ্যাখে না। তা ছাড়া পৃথিবীতে মানুষ আসিলে তাহাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব যে মানুষের নয়, যিনি জীব দেন তার, গণেশ এটা বিশ্বাস করে। সুতরাং ছেলে হওয়ার সংবাদে কুবেবের রাগ করিবার কী কারণ আছে সে ভাবিয়া পাইল না। ভাবিবার চেষ্টাও করিল না।
বেড়া দেওয়া ছোটো একটি উঠানের দুদিকে দুখানা ঘর, কুবেরের বাড়ির এর বেশি পরিচয় নাই। এ দিকের ঘরের সংকীর্ণ দাওয়ায় একটা ছেঁড়া মাদুর চট প্রভৃতি দিয়া ঘেরিয়া লওয়া হইয়াছে। চাহিলেই বুঝিতে পারা যায় ওটি আঁতুড়ঘর। কারণ চটের ফাঁক দিয়া ভিতরে শায়িতা মালাকে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে।
কুবের ও দিকের দাওয়া-বিহীন ঘরটিতে ঢ়ুকিয়া পড়িল। বাহিরে বর্ষার আকাশে কড়া রোদ উঠিলেও জানালা দরজার বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় এ ঘরের ভিতরটা একটু অন্ধকার। কোনার দিকে রক্ষিত জিনিসগুলি চিনিতে হইলে ঠাহর করিয়া দেখিতে হয়। ঘরের একদিকে মাটিতে পোতা মোটা বাঁশের পায়ায় চৌকি সমান উঁচু বাঁশের বাতা বিছানো মাচা। মাচার অর্ধেকটা জুড়িয়া ছেঁড়া কাঁথার বিছানা। তৈলচিক্কণ কালো বালিশটি মাথায় দিয়া কুবেরের পিসি এই বিছানায় শয়ন করে। মাচার বাকি অংশটা হাঁড়ি কলসিতে পরিপূর্ণ। নানা আকারের এতগুলি হাঁড়ি কলসি কুবেরের জীবনে সঞ্চিত হয় নাই, তিন পুরুষ ধরিয়া জমিয়াছে। মাচার নীচেটা পুরাতন জীর্ণ তক্তায় বোঝাই। কুবেরের বাপের আমলের একটা নৌকা বারবার সারাই করিয়া এবং চালানোর সময় ক্ৰমাগত জল সেচিয়া বছর চারেক আগে পর্যন্ত ব্যবহার করা গিয়াছিল, তারপর একেবারে মেরামত ও ব্যবহারের অনুপযুক্ত হইয়া পড়ায় ভাঙিয়া ফেলিয়া তক্তাগুলি জমাইয়া রাখা হইয়াছে। ঘরের অন্যদিকে ছোটো একটা টেঁকি। টেঁকিটা কুবেরের বাবা হারাধন নিজে তৈয়ারি করিয়াছিল। কাঠ সে পাইয়াছিল পদ্মায়। নদীর জলে ভাসিয়া আসা কাঠ সহজে কেহ ঘরে তোলে না, কার চিতা রচনার প্রয়োজনে ও-কাঠ নদীতীরে আনা হইয়াছিল কে বলিতে পারে? শবের মতো চিতার আগুনের জড়তম সমিধটিরও মানুষের ঘরে স্থান নাই। কিন্তু এই টেঁকির কাঠটির ইতিহাস স্বতন্ত্র। কুবের তখন ছোটো, পদ্মানদীর মাঝির ছেলে যতটুকু বয়সে পদ্মায় সাঁতার দিবার মতো পাকা সাঁতারু হইয়া উঠিতে পারে না, তত ছোটো। ছোটো একটি নৌকায় ছেলেকে সঙ্গে করিয়া হারাধন পদ্মা পার হইতেছিল। নদীর মাঝামাঝি পুরানো নৌকার তলাটা হঠাৎ কী করিয়া ফাঁসিয়া যায়। তখন আশ্বিন মাস, সেখানে পদ্মার এ তীর ও তীরের ব্যবধান তিন মাইলের কম নয়। পদ্মা যাহাকে বুকে করিয়া মানুষ করিয়াছে, পদ্মার বুকে যত ঢেউ থাক মেইল দেড়েক সাঁতার দিয়া তীরে উঠে তার পক্ষে কষ্টকর কিন্তু অসম্ভব নয়। হারাধন একা হইলে ভাবনা ছিল না। কুবের আর একটু বড়ো এবং শক্ত সমর্থ হইলেও সে বিপদে পড়িত না। কিন্তু ছেলেমানুষ কুবের ভয় পাইয়া সাঁতার দিতে চাহে নাই, দিশেহারা হইযা ক্ৰমাগত হারাধনকে জড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়াছিল। তখন যে লম্বা কাঠের গুড়িটি হাতের কাছে আগাইয়া আসিয়া তাহদের বাঁচাইয়া দিয়াছিল, হয়তো তাহা চিতা রচনার জন্যই কেহ শ্মশানে আনিয়াছিল। হারাধন কিন্তু কাঠটি ফেলিয়া দিতে পারে নাই। ঘরের আসবাবে পরিণত করিয়া সাদরে গৃহে স্থান দিয়াছে।
কুবেরের পিসি আর তার বড়ো মেয়ে গোপি কুবেরকে দেখিয়াই চেচামেচি করিয়া কাছে আসিয়াছিল। কুবের কারও সঙ্গে কথা বলিল না। লম্বা হইয়া পিসির বিছানায় শুইয়া পড়িল।
পিসি বলিল, শুলি যে ধন? বউ ওদিকে পোলা বিয়াইয়া সারছে দেইখা আয।
গোপি বলিল, বাই উ ওই বাবুগোর পোলার নাখান ধলা হইছে বাবা। নকুইলার মাইয়া পাঁচি কি কইয়া গেল শুনবা? সায়েব গো এমন হয় না। না পিসি?
কুবের চেঁচাইয়া ধমক দিয়া বলিল, নকুইলা কী লো হারামজাদি? জ্যাঠা কইবার পার না?
গোপি মুখ ভার করিয়া বলিল, ক্যান কমু জ্যাঠা? বজ্জাতটা আমারে যা মুখে লয় কয় না?
কী কয়?
রাইত কইরা মাইজাবাবু নি আমাগোর বাড়ি আহে তাই জিগায়। ইবার জিগাইলে একদল পাঁক দিমুনে ছুইড়া মুখের মধ্যে।
দিস, বলিয়া কুবের ঝিমাইতে থাকে। খানিক পরে ও ঘরের দাওয়া হইতে শিশুর জোরালো কান্না শুনিতে পাওয়া যায়। মনে হয়, ছেলেটা আগেভাগে আসিয়া পড়িলেও গলায় রীতিমতো জোর করিয়া আসিয়াছে, চেঁচাইতে পারে।