পদ্মা নদীর মাঝি – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

ময়নাদ্বীপ হইতে রাসুর আকস্মিক আবির্ভাবের বিস্ময় গ্রামের লোকের কাছে পুরানো হইয়া গিয়াছে, রাসুর অভিজ্ঞতার গল্প শুনিবার কৌতুহল কাহারও নাই। রাসু বলিতে চায়, সবিস্তারে বারবার আগাগোড়া সমস্ত কাহিনিটা বলিবার জন্য সে ছটফট করে, কিন্তু শ্রোতা পায় না। কত শুনিবে লোকে শুনিয়া শুনিয়া কান ঝালাপালা হইয়া গিয়াছে সকলের।

হোসেন মিয়া কিছু টাকা দিয়াছে রাসুকে, রাসুর ইচ্ছা টাকাটা দিয়া সে একটি বউ খরিদ করে, গোপি হইলেই ভালো হয়। কিন্তু কুবের এ প্রস্তাব কানেও তোলে না। কত টাকা দিয়াছে হোসেন মিয়া তাহাকে? হাজার না লাখ? আর কী আছে রাসুর—ঘর দুয়ার, জীবিকার উপায়? তা ছাড়া গোপির পাত্র একরকম ঠিক হইয়াই আছে—গণেশের শালা যুগল। যুগলের মতো পাত্র থাকিতে যার তার হাতে কুবের মেয়ে দিবে কেন?

গোপিকে কিন্তু বড়োই পছন্দ হইয়াছে রাসুর। ময়নাদ্বীপের গল্প করিবার ছলে সে কুবেরের বাড়ি আসে, আড়চোখে আড়চোখে সারাক্ষণ সে গোপির দিকে তাকায়, পরির মতো সুন্দরী মনে হয় গোপিকে তাহার। ভাইকে কোলে করিয়া বাঁকা হইয়া কী তাহার দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা! হ, রুখো রুখো লালচে বটে চুলগুলি গোপির, কপালটা একটু উঁচুই, থ্যাবড়ানো নাকের নীচে উত্তোলিত ওষ্ঠে ঠেকিয়া নোলকটা তাহার দুলিতে পায় না, আর হ, বড়ো নোংরা গোপি। তবু তো রাসু চোখ ফিবাইতে পারে না। তবু তো তার মনে পড়ে না এমন অতুলনীয় রূপ সে কোথাও দেখিয়াছে! কী রং গোপির! কী মনোহব তাহার চলাফেরা, কী চাউনি!

বয়স রাসুর বেশি হয় নাই, যুগলের চেয়েও তার বয়স কম। নূতন করিয়া সংসাব পাতিয়া জীবনটা আবার গুছাইয়া লইবার সময় তাহার পার হইযা যায় নাই। গোপিকে পাইলে আবার সে আরম্ভ করিতে পারে,–বয়স্থা বাড়ন্ত মেযে গোপি, বিবাহের একবছবের মধ্যে ও স্বামীর ঘর করিতে আসিবে, পাঁচ বছরের একটা মেয়েকে বিবাহ করিয়া তার বড়ো হইবার আশায় হা করিষা বসিয়া থাকিবার ধৈর্য রাসুর আব নাই। যাদের সে বিসর্জন দিয়া আসিয়াছে ময়নাদ্বীপে, তাড়াতাড়ি আবার তাদের ফিরিয়া পাওয়া চাই। একা একা বড়ো কষ্ট হইতেছে রাসুর। পীতম মাঝির সঙ্গে রাসুর কলহ হইয়া গিয়াছে। হোসেন মিয়ার দেওয়া টাকাটা বগাইয়া লওয়ার জন্য পীতম মাঝি বড়োই ব্যস্ত হইয়া উঠিযাছিল। রাসু তাই পৃথক হইয়া গিয়াছে। কে জানত গ্রামেব মধ্যে পীতমের মেযে যুগীই সর্বস্বান্ত পিসতুতো ভাইটিকে এতখানি খাতির করিবে। শীতলকে দিযা বাবুদের বলিয়া নিজের ঘরের কাছে খানিকটা জমি যুগীই রাসুকে জোগাড় করিযা দিয়াছে—-রাসু একখানা ঘর তুলিযাছে সেখানে।

সেই ঘরে রাসু বাস করে একা, হয়তো ধ্যান কবে গোপির। বিকালে কেতুপুর গ্রামের মধ্যে সওদা আনিতে যাওয়ার সময় পথের নির্জনতম অংশে কোনোদিন গোপি রাসুকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিতে পায়।

রাসু বলে, কই যাও গোপি? সে একটু স্নেহ-ব্যঞ্জক হাসি হাসে। গাঁট হইতে বাহির করে একটি কাচ বসানো পিতলের আংটি আর পুঁতির মালা, বলে নিবা?

গোপি খুশি হইয়া উপহার গ্রহণ করে। রাসুকে ভালোই লাগে তাহার, রাসুর জন্য সে একটু দুঃখ বোধ করে। কোথায় সেই ময়নাদ্বীপ কে জানে, সকলকে রাসু সেখানে হারাইয়া আসিয়াছে, বড়ো কষ্ট পাইয়াছে সে জীবনে। তা ছাড়া রাসুর কথাগুলি ভারী মিষ্টি, শুনিতে বড়ো ভালো লাগে গোপির। আর কী খাতিরটা রাসু তাহাকে করে। কত যেন সে বড়ো হইয়াছে, এগারো বছবের মেযে সে নয়।

যুগীর সঙ্গে মাঝে মাঝে রাসু পরামর্শ করে, একটা কী উপায় ঠাওরানো যায় না কুবেরকে যাহাতে রাজি করানো যায়? পরামর্শ অনেক হয়, উপায় হয় না। শীতলের অনুপস্থিতিতে তাহার পরিষ্কার শয্যায় আরাম করিয়া বসিয়া তাহার হুঁকায় তামাক টানিতে টানিতে পরামর্শ করিতে পারাটুকুই লাভ হয় রাসুর। আর যুগীর সমবেদনা। রাসুকে যুগী খুব খাতির-যত্ন করে, রাসুর মুখে ময়নাদ্বীপের কাহিনি বারবার শুনিয়াও সে শ্রান্ত হয় না। কত বাসিন্দা ময়নাদ্বীপে? কী কী ফসল হয়? দ্বীপের চারিদিকে বুঝি সমুদ্র? আচ্ছা, সমুদ্র কত বড়ো—পদ্মার চেয়েও বড়ো বুঝি? আজও যুগী রাসুকে এই সব প্রশ্ন করিতে ভালোবাসে। যুগীর বয়স বেশি নয়, বছর বাইশ,—বড়ো শান্ত তাহার স্বভাব, বড়ো সরল তাহার মন। শীতল তাহাকে সুখে রাখিয়াছে, আড়াল করিয়া রাখিয়াছে জেলেপাড়ার দারিদ্র্য ও হীনতা হইতে। যুগীর মনে অপরিমিত সন্তোষ। এত দয়ামায়া, এমন কোমলতা জেলেপাড়ার আর কোনো মেয়ের নাই। জেলেপাড়ার কারও ঘরে কোনোদিন যদি অন্ন না থাকে, চুপি চুপি একরার যুগীর কাছে আসিতে পারিলে আর তাহার উপবাসের ভয় থাকে না—দুঃখের কাহিনি যে যত জমজমাট করিয়া বলিতে পারে ছলছল চোখে যুগী তাহাকে চাল দেয় তত বেশি–খরচের পয়সা দান করিয়া শীতলের বকুনি শোনে। শীতল লোকটা বড়ো কৃপণ, যুগীর দান করা স্বভাবটা সে পছন্দ করে না, কিন্তু এমন আশ্চর্য মন মানুষের, যুগীর এই মন্দ স্বভাবের জন্যই তাহাকে শীতল ভালোবাসে বেশি। যুগীকে সে কৃপণ হইতে বলে কিন্তু সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিলে যুগী যেদিন ভয়ে ভয়ে তাহাকে শোনায় না যে একজন আসিয়া তাহার ঘাড় ভাঙিয়া যা পারিয়াছে আদায় করিয়া লইয়া গিয়াছে, সেদিন মনটা যেন খুঁতখুঁত করে শীতলের।

মাছের মূল্য বাবদ কুবের কয়েক আনা পয়সা পাইত। শীতল কখনও ঋণ পরিশোধ করে না। তাগিদ করিয়া করিয়া কুবের হয়রান হইয়া গিয়াছে। তবু, একদিন সকালে আবার সে আশা করিয়া আসিল।

যুগী রাঁধিতেছিল, শীতল আর রাসু করিতেছিল গল্প। কুবেরকে দেখিয়া রাসু চঞ্চল হইয়া উঠিল, বসিতে দিয়া খাতির করিয়া কলিকাটা বাড়াইয়া দিয়া বলিল, তামুক খাও।

না, কুবেরের বসিবার সময নাই, তামাক খাওয়ার সময় নাই! শীতল তাড়াতাডি পয়সাটা দিয়া দিক, সে তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইবে—বসিয়া তামাক টানিতে আসিয়াছে নাকি সে? হ, কুবের আজ রাগিয়াছে। আজ সে মাছের দাম আদায় করিয়া ছাড়িবে। শীতল প্রথমে অমায়িক হাসি হাসিয়া জিজ্ঞাসা করে, এত রাগ কেন কুবেরের, এই সকাল বেলা? তারপর সেও রাগিয়া যায়, বলে যা যা দিমু না পয়সা, কর গিয়া নালিশ!

রাসু বুঝি কুবেরকে খুশি করিতে চায়, সে বলিল, দ্যান শেতলবাবু, দিয়া দ্যান পয়সা।

পয়সা দিল যুগী। কলহের মাঝখানে দশ আনা পয়সা আনিয়া কুবেবের সামনে রাখিয়া দিল, শীতলকে ধমক দিয়া বলিল, সামান্য ক আনা পয়সাব জন্য এত কাণ্ড করা কী জন্য? কত কর্তৃত্ব যুগীর। শীতল কথাটি বলিল না, কুবেরের দিকে কড়া চোখে চাহিয়া ঘরের ভিতরে চলিযা গেল।

পয়সা কুড়াইয়া কুবের উঠিল, সঙ্গে উঠিল রাসু। কী বিনয় রাসুর, কী সব তোষামোদে কথা! পথ চলিতে চলিতে রাসু নানা কথা বলে। এবার সে একটা ব্যাবসা আরম্ভ করিবে—-ব্যাবসা ছাড়া পয়সা নাই মানুষের, একটা সে দোকান দিবে দেবীগঞ্জে। কীসের দোকান এখনও সে তা ঠিক করে নাই, ভাবিয়া চিন্তিয়া একটা কিছু ঠিক করিয়া লইবে—কুবের কী পরামর্শ দেয়? জীবনে উন্নতি করিবে রাসু, প্রাণপণ করিয়া লাগিলে কী না হয় জগতে? তা ছাড়া পুরুষেব ভাগ্যের কথা কে জানে। আজ ফকির—কাল রাজা! কুবের গম্ভীর মুখে সায় দিয়া বলে, হ। ভাবে, ময়নাদ্বীপে গিয়া বড়ো বড়ো কথা বলিতে শিখিয়া আসিয়াছে রাসু, চাল দিতে শিখিয়াছে।

মাঠের দিকে চাহিলে বোঝা যায় জল কোথায় নামিয়া গিয়াছে, ধানের ফসল কাত হইয়া পড়িয়া আছে। পদ্মা হইতে আজ জোর বাতাস বহিতেছিল, চারিদিকে অসংখ্য পাখির কলরব, শিশিরভেজা ডাঙায় ছড়াইয়া আছে সোনার রোদ। শরৎকাল আসিয়া পড়িয়াছে সন্দেহ নাই। নদীতীরে কাশের বন এবার সাদা হইয়া উঠিবে। কুবেরের সঙ্গে রাসু তাহার বাড়ি পর্যন্ত আগাইয়া যায়। না, গোপি এখন বাড়ি নাই। কপিলার সঙ্গে সে জল আনিতে গিয়াছে নদীতে। কুবের রাসুকে বসিতে বলে না, পিসির নিরিবিলি ঘরখানায় গিয়া ঢোকে ঘুমের জন্য, রাসু আস্তে আস্তে ফিরিয়া যায়। যায় সে নদীর ধারে, গাল সে খায় কপিলার, তারপর হনহন করিয়া হাটিতে আরম্ভ করে কেতুপুর গ্রামের দিকে। না, নদীর ধারে ও ভাবে দাঁড়ানো উচিত হয় নাই। কপিলা যদি বলিযা দেয় কুবেরকে?

পোস্টটি শেয়ার করুন