কতটা জমি দরকার – লিও টলস্টয়
সাত
সারারাত পাখমের চোখে ঘুম এল না। সারারাত কেটে গেল কেবল জমির স্বপ্ন দেখে, নতুন জমির ভাবনা ভেবে।
শুয়ে-শুয়েই ও ভাবতে লাগল, খুব বড় একটা চক্কর দিয়ে ফিরে আসতে হবে। সারাদিনে অন্তত পঁয়ত্রিশ মাইল হেঁটে আসতে পারব। আর পঁয়ত্রিশ মাইলের মধ্যে জমির পরিমাণ বিশ হাজার একরের কম হবে না। তখন আর আমাকে পায় কে! এর ভেতর যে-জমি একটু খারাপ হবে সে জমি বিক্রি করে ফেলব, ভালাে জমিগুলাে অবশ্য নিজেই চাষ করব আমি। এত জমি চাষের জন্য দুটো বলদ কিনতে হবে। আর রাখতে হবে গােটাদুয়েক চাকর। কিছু জমি ফেলে রাখতে হবে ঘাস জন্মাবার জন্য—গরু-ঘােড়াও তাে পালতে হবে!
সারারাত পাখম দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। ভােরের দিকে একটু তন্দ্রামতাে এল। সঙ্গে সঙ্গে সে স্বপ্ন দেখল একটা। সে যেন একটা তাবুতে শুয়ে শুয়ে শুনতে পাচ্ছে বাইরে কে একজন বেদম হাসছে আর কথা বলছে। কে এমন করে হাসছে দেখবার জন্য সে তাঁবুর বাইরে এসে দেখল, মাটির ওপর বসে আছেন সর্দার। বুকের দুপাশ চেপে ধরে সর্দার এমন করে হাসছেন যেন তার পেট ফেটে যাবে। স্বপ্নের মধ্যেই পাখম হেঁটে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এত হাসছেন কেন?’ কিন্তু ভালাে করে চেয়ে দেখতেই পাম বুঝতে পারল, লােকটি সর্দার নয়। এ তাে সেই বিদেশি লােক যে তাকে পরামর্শ দিয়ে এখানে এনেছে। পাখম তাকে জিজ্ঞেস করতে যাবে, ‘কিছুদিন আগে আপনি আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন না?’ ঠিক তখনি লােকটির চেহারা আবার বদল হয়ে গেল। পাখম দেখল এ যেন সেই প্রথম লােক যে ভলগা নদীর ওপার থেকে তার কাছে গিয়েছিল। পাখম আবার জিজ্ঞেস করতে গেল, ‘কীভাবে সে এখানে এল?” কিন্তু লােকটির চেহারা আবার বদলে গেল, পাম দেখল, এ লােকটি মানুষ নয়, এ হচ্ছে স্বয়ং শয়তান। মাথায় তার শিং আর পায়ে জন্তুর মতাে খুর। মাটিতে বসে হাসতে হাসতে কিসের দিকে যেন সে একভাবে তাকিয়ে আছে—আর হাসছে। স্বপ্নের ভেতরেই পাখম কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল, একটা লােক। তার পা খালি। পরনে পায়জামা, গায়ে শুধু একটা শার্ট-চিৎ হয়ে মরে পড়ে আছে। তার মুখ কাগজের মতাে শাদা। মরা লােকটিকে ভালাে করে দেখতে পাখম এগিয়ে গেল। দেখল মৃতলােকটি আর কেউ নয়—সে নিজেই। স্বপ্নে এইসব দেখে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পাখম জেগে উঠল। তার মনে হল, কী আজব স্বপ্নই না মানুষ ঘুমের ঘােরে দেখে। জানালা দিয়ে পুবের দিকে চাইতে সে দেখল ভােরের প্রথম আলাে ঘরে উকি দিচ্ছে।
না, আর কুঁড়েমি করা চলে না, যাত্রা শুরু করতে হবে এখনি। বলেই সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। চাকরকে ডেকে জাগাল এবং গাড়িতে ঘােড়া জুড়তে বলে বাসকিরদের কাছে রওনা হয়ে গেল।
বাসকিররাও ঘুম থেকে উঠে একে একে তৈরি হয়ে নিল। সর্দার এসে হাজির হলেন। সবাই তারা কুমিস দিয়ে সকালের খাবার খেল। তারা পাখমকেও চা খেতে বলল। কিন্তু তার হাতে আর সময় নেই। বলল, ‘যদি আমাদের যেতে হয় তাে এখনি চলুন। সময় হয়ে গেছে।’