কতটা জমি দরকার – লিও টলস্টয়

পাঁচ

বিদেশি লােকটির কাছ থেকে পথঘাট জেনে নিয়ে পাখম যাবার জন্য তৈরি হল। স্ত্রী-পুত্র সব রেখে গেল জমি-জমা, ঘরবাড়ি দেখাশােনা করতে। সঙ্গে একজন চাকর নিয়ে পাখম হাজির হল এক শহরে। এখান থেকে একবাক্স চা, কিছু মদ আর বেশকিছু টুকিটাকি জিনিশ কিনল বাসকির সর্দারদের উপহার দেবার জন্য।

সেখান থেকে আবার ওরা যাত্রা শুরু করল, প্রায় তিনশ মাইলের বেশি পথ পার হয়ে সাতদিনের দিন সে বাসকিরদের তাবুতে গিয়ে হাজির হল।

এদের সম্পর্কে যা-কিছু সে কানে শুনেছিল তার সবই ঠিক। খােলা প্রান্তরের ভেতর দিয়ে যে নদীটা বয়ে চলেছে, তারই ধারে ধারে চামড়ার ছাউনি দেয়া তাবুতে ওরা বাস করে। জমি তারা চাষ করে না, কোনাে ফসলও খায় না। খােলা মাঠে চরে বেড়াচ্ছে গরু-মহিষ আর কোসাক ঘােড়ার দল। ঘােড়ার বাচ্চাগুলাে বেঁধে রেখেছে তাবুর পেছনে। দিনে দুবার করে মা ঘােড়াকে তাড়িয়ে আনা হয় বাচ্চাদের দুধ খাওয়াতে। বাকিদেরও প্রধান খাদ্য এই ঘােড়ার দুধ। লােকগুলাে ঘােড়ার দুধ দিয়ে কুমিস নামে একরকমের পানীয় তৈরি করে। কুমিস থেকে আবার তৈরি হয় পনির। তারা কুমিস আর চা পান করে, ভেড়ার মাংস খায় আর মনের আনন্দে বাঁশি বাজায়। লােকগুলাের স্বাস্থ্য খুব ভালাে, সবসময় হাসি-তামাশায় মশগুল, বছরের অর্ধেকটা সময় তারা শুয়ে বসেই কাটায়। লেখাপড়া কেউ জানে বলে মনে হয় না, রুশভাষা তাে একজনও বােঝে না। তবে মানুষ হিসেবে তারা খুবই সরল। অন্তরগুলাে দয়ায় ভরা।

পাখমকে দেখেই তারা দলে দলে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে তার চারপাশে ভিড় করে দাড়াল। একজন দোভাষী এল পাখমের কথাবার্তা বুঝিয়ে দিতে। ওরা বুঝতে পারল পাখম এসেছে কিছু জমি কেনা যায় কি না তাই দেখতে। এ-কথা শুনে লােকগুলাে ভারি খুশি হয়ে পাখমকে বুকে জড়িয়ে ধরল। পাখমকে তারা সবচেয়ে বড় তাবুর ভেতরে নিয়ে গেল। সবচেয়ে ভালাে জায়গায় তাকে বসিয়ে নিজেরা বসল তার চারদিক ঘিরে। চা এল, কুমিস এল, একটা ভেড়াও জবাই হল পাখমের জন্য। পাখম তার উপহারের জিনিশগুলাে বের করে সবার মধ্যে বিলিয়ে দিল। বাসকিরদের সে কী আনন্দ। নিজেদের ভেতর কী যেন বলাবলি করে তারা দোভাষীকে ডাকল।

দোভাষী তখন পাখমকে বুঝিয়ে বলল, এরা বলছে যে তুমি এসেছ বলে বাসকিররা খুব খুশি হয়েছে। এদের রীতি হল কোনাে উপহার পেলে তার বিনিময়ে যে-কোনাে উপায়ে অতিথির আশা পূরণ করা। তুমি অনেককিছু এনে এদের উপহার দিয়েছ। এখন এরা জানতে চাইছে, তুমি এদের কোন্ জিনিশ সবচেয়ে বেশি পছন্দ করাে। তুমি যা চাইবে তাই তােমাকে দেয়া হবে।

পাখম বলল, এখানে এসে আমার সবচেয়ে ভালাে লেগেছে তােমাদের জমি। যেখান থেকে আমি এসেছি, সেখানে জমির বড় অভাব। আর যাও-বা আছে, তাতে ভালাে ফসল ফলে না। তােমাদের জমির তুলনা মেলা ভার। এত ভালাে জমি এর আগে কখনাে দেখিনি আমি।’

দোভাষী তার কথাগুলাে বাসকিরদের বুঝিয়ে দিল। বাসকিররা আবার কিছুক্ষণ আলােচনা করল নিজেদের ভেতর। পাখম তাদের কথাবার্তার কিছুই বুঝতে পারছিল না। অবশ্য তাদের হাে-হাে করা তুমুল হাসি দেখে বােঝা যাচ্ছিল পাথমের ওপর তারা সন্তুষ্ট।

বেশ কিছুক্ষণ পর তাদের আলােচনা থামলে দোভাষী পাখমকে বলল, ‘তােমার সদয় ব্যবহার আর সুন্দর উপহারের পরিবর্তে এরা তােমাকে জমি দিতে রাজি হয়েছে। তােমার যত জমি দরকার ততটুকুই পাবে।’

এই সময় লােকগুলাে আবার যেন কী নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু করে দিল। পাখম দোভাষীকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, ‘এদের কেউ কেউ বলছে, তােমাকে জমি দেবার আগে একবার সর্দারকে বলে নেয়া উচিত। তাকে না-জানিয়ে কিছু করা ঠিক হবে না। অন্যেরা বলছে সর্দারকে জানাবার কোনাে দরকার নেই।

পোস্টটি শেয়ার করুন