জন্মঃ ১৫ই আগস্ট ১৯২৬ সালে। মাতামহের বাড়ি কলকাতার কালীঘাটের ৪৩,মহিম হালদার স্ট্রীটের বাড়িতে সুকান্ত ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন।
বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি।
আট-নয় বছর বয়স থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়ে’ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তার দিনকতক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তার লেখা বিবেকান্দের জীবনী। মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেন। এটি পরে তার ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। বলে রাখা ভালো, পাঠশালাতে পড়বার কালেই ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্য বন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন। অরুণাচল তার আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। সুকান্তকে বলা হয় গণমানুষের কবি। অসহায়-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ, দুঃখ তার কবিতার প্রধান বিষয়। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্তও ছিলেন সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে সুকান্তের ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি তার কবিতার নিপুণ কর্মে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণী বৈষম্য। মানবতার জয়ের জন্য তিনি লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অসুস্থতা অর্থাভাব তাকে কখনো দমিয়ে দেয়নি। মানুষের কল্যাণের জন্য সুকান্ত নিরন্তর নিবেদিত থেকেছেন। তিনি মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন। তার অগ্নিদীপ্ত সৃষ্টি প্রণোদনা দিয়ে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী ছিলেন।
মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন। সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন।তার কবিতায় অনাচার ও বৈষ্যমের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ পাঠকদের সংকচিত করে তোলে। গণমানুষের প্রতি গভীর মমতায় প্রকাশ ঘটেছে তার কবিতায়। তার রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তার রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও লৈখিক দক্ষতায় অনন্য। সাধারণ বস্তুকেও সুকান্ত কবিতার বিষয় করেছেন। বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি উঠে এসেছে তার কবিতায়। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস সুকান্তের কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তার বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। স্বল্প সময়ের জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দিজেন্দ্রলাল রায়, জীবনানন্দ দাশসহ সে সময়ের বড় বড় কবির ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি। নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন নিজ প্রতিভা, মেধা ও মননে। সুকান্ত তার বয়সিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন তার পরিণত ভাবনায়। ভাবনাগত দিকে সুকান্ত তার বয়স থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন।
উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিঃ ছাড়পত্র, ঘুম নেই, পূর্বাবাস তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
মৃত্যুঃ ১৩ মে ১৯৪৭| তিনি একাধারে বিপ্লবী ও স্বাধীনতার আপোসহীন সংগ্রামী কবি সুকান্ত ছিলেন কমুনিষ্ট পার্টির সারাক্ষণের কর্মী। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করলেন তাতে তার শরীরে প্রথম ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে মাত্র ২১ বছর বয়সে কলিকাতার ১১৯ লাউডট স্ট্রিটের রেড এড কিওর হোমে মৃত্যুবরণ করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবন মাত্র ২১ বছরের আর লেখালেখি করেন মাত্র ৬/৭ বছর। সামান্য এই সময়ে নিজেকে মানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তার রচনা পরিসরের দিক থেকে স্বল্প অথচ তা ব্যাপ্তির দিক থেকে সুদূরপ্রসারী।