ইঁদুরের ভোজ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইঁদুরের ভোজ
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছেলেরা বললে, ভারি অন্যায়, আমরা নতুন পণ্ডিতের কাছে কিছুতেই পড়ব না৷
নতুন পণ্ডিতমশায় যিনি আসছেন তাঁর নাম কালীকুমার তর্কালঙ্কার৷
ছুটির পরে ছেলেরা রেলগাড়িতে যে যার বাড়ি থেকে ফিরে আসছে ইস্কুলে৷ ওদের মধ্যে একজন রসিক ছেলে কালাে কুমড়াের বলিদান বলে একটা ছড়া বানিয়েছে, সেইটে সকলে মিলে চীৎকার শব্দে আওড়াচ্ছে। এমন সময় আড়খােলা ইস্টেশন থেকে গাড়িতে উঠলেন একজন বুড়াে ভদ্রলােক৷ সঙ্গে আছে তাঁর কথায় মােড়া বিছানা৷ ন্যাকড়া দিয়ে মুখ বন্ধ করা দু-তিনটে হাঁড়ি, একটা টিনের ট্রাঙ্ক, আর কিছু পুটুলি৷ একটা ষণ্ডাগােছের ছেলে, তাকে ডাকে সবাই বিচকুন ব’লে, সে চেঁচিয়ে উঠল– এখানে জায়গা হবে না বুড্ঢা, যাও দুসরা গাড়িতে৷ |
বুড়াে বললেন, বড়াে ভিড়, কোথাও জায়গা নেই, আমি এই কোণটুকুতে থাকব, তােমাদের কোনাে অসুবিধা হবে না৷ ব’লে ওদের বেঞ্চি ছেড়ে দিয়ে নিজে এক কোণে মেঝের উপর বিছানা পেতে বসলেন৷ ছেলেদের জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা, তােমরা কোথায় যাচ্ছ, কী করতে৷ বিচকুন বলে উঠল, শ্রাদ্ধ করতে৷ বুড়াে জিজ্ঞাসা করলেন, কার শ্রাদ্ধ ? উত্তরে শুনলেন, কালাে কুমড়াে টাটকা লঙ্কার। ছেলেগুলাে সব সুর করে চেচিয়ে উঠল–কালাে কুমড়াে টাটকা লঙ্কা দেখিয়ে দেব লববাডঙ্কা৷ আসানসােলে গাড়ি এসে থামল, বুড়াে মানুষটি নেমে গেলেন, সেখানে স্নান করে নেবেন৷ স্নান সেরে গাড়িতে ফিরতেই বিচকুন বললে, এ গাড়িতে থাকবেন না মশায়৷ কেন বলাে তাে ভারি ইঁদুরের উৎপাত৷ ইঁদুরের ? সে কী কথা৷ দেখুন-না আপনার ঐ হাঁড়ির মধ্যে ঢুকে কী কাণ্ড করেছিল৷
ভদ্রোলােক দেখলেন তাঁর যে হাঁড়িতে কদমা ছিল সে হাঁড়ি ফাঁকা৷ আর যেটাতে ছিল খইচুর তার একটা দানাও বাকি নেই৷
বিচকুন বললে, আর আপনার ন্যাকড়াতে কী একটা বাঁধা ছিল সেটা সুদ্ধ নিয়ে দৌড় দিয়েছে৷
সেটাতে ছিল ওঁর বাগানের গুটি-পাঁচেক পাকা আম৷
ভদ্রলােক একটু হেসে বললেন, আহা, ইঁদুরের অত্যন্ত ক্ষিদে পেয়েছে দেখছি।
বিচকুন বললে, না না, ও জাতটাই ওরকম, ক্ষিদে না পেলেও খায়৷
ছেলেগুলাে চীৎকার করে হেসে উঠল, বললে, হাঁ মশায়, আরাে থাকলে আরাে খেত।
ভদ্রলােক বললেন, ভুল হয়েছে, গাড়িতে এত উঁদুর একসঙ্গে যাবে জানলে আরাে কিছু আনতুম৷
এত উৎপাতেও বুড়াে রাগ করলে না দেখে ছেলেরা দমে গেল– রাগলে মজা হত৷
বর্ধমানে এসে গাড়ি থামল। ঘন্টাখানেক থামবে৷ অন্য লাইনে গাড়ি বদল করতে হবে। ভদ্রলােকটি বললেন, বাবা, এবারে তােমাদের কষ্ট দেব না, অন্য কামরায় জায়গা হবে৷
না না, সে হবে না, আমাদের গাড়িতেই উঠতে হবে। আপনার পুটুলিতে যদি কিছু বাকি থাকে আমরা সবাই মিলে পাহারা দেব, কিছুই নষ্ট হবে না৷
ভদ্রলােক বললেন, আচ্ছা বাবা, তােমরা গাড়িতে ওঠো, আমি আসছি৷
ছেলেরা তাে উঠল গাড়িতে৷ একটু বাদেই মিঠাইওয়ালার ঠেলাগাড়ি ওদের কামরার সামনে এসে দাঁড়ালাে, সেইসঙ্গে ভদ্রলােক।
এক-এক ঠোঙা এক-একজনের হাতে দিয়ে বললেন, এবারে ইঁদুরের ভােজে অনটন হবে না৷
ছেলেগুলাে হুরে ব’লে লাফালাফি করতে লাগল৷ আমের ঝুড়ি নিয়ে আমওয়ালা এল — ভােজে আমও বাদ গেল না৷
ছেলেরা তাঁকে বললে, আপনি কী করতে কোথায় যাচ্ছেন বলুন৷
তিনি বললেন, আমি কাজ খুঁজতে চলেছি, যেখানে কাজ পাব সেখানেই নেবে পড়ব৷
ওরা জিজ্ঞাসা করলে, কী কাজ আপনি করেন ? তিনি বললেন, আমি টুলাে পণ্ডিত, সংস্কৃত পড়াই৷
ওরা সবাই হাততালি দিয়ে উঠল ; বললে, তা হলে আমাদের ইস্কুলে আসুন৷ তােমাদের কর্তারা আমাকে রাখবেন কেন ?
রাখতেই হবে৷ কালাে কুমড়াে টাটকা লঙ্কাকে আমরা পাড়ায় ঢুকতেই দেব না।
মুশকিলে ফেললে দেখছি! যদি সেক্রেটারিবাবু আমাকে পছন্দ না করেন ? পছন্দ করতেই হবে– না করলে আমরা সবাই ইস্কুল ছেড়ে চলে যাব। আচ্ছা বাবা, তােমরা আমাকে তবে নিয়ে চলাে৷
গাড়ি এসে পৌঁছল স্টেশনে। সেখানে স্বয়ং সেক্রেটারিবাবু উপস্থিত৷ বৃদ্ধ লােকটিকে দেখে বললেন, আসুন, আসুন তর্কালঙ্কার মশায়! আপনার বাসা প্রস্তুত আছে৷
ব’লে পায়ের ধুলাে নিয়ে প্রণাম করলেন৷