পদ্মা নদীর মাঝি – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
খাওয়া-দাওয়ার পর আবার নৌকা চলিল। রাত্ৰি নটা দশটার সময় একেবারে নদীর কিনারায় সুষুপ্ত একখানি গ্রামের পাশে সেদিনকার মতো স্থগিত করা হয় যাত্রা।
তৃতীয় দিন অপরাহ্লে পাওযা গেল পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গম। নদী এখানে সাগরের মতোই পারাপারহীন। সন্ধ্যার দেরি নাই দেখিয়া কুবের সেদিন নৌকা বাঁধিল, এদিকে সে আগেও আসিয়াছে বটে, কিন্তু নদী ভালো করিয়া চেনা নয়, সন্ধ্যাব পর নৌকা চালাইতে সে সাহস করিল না।
পরদিন চাঁদপুরে নৌকা ভিড়িল।
ভালোয় ভালোয এতখানি পথ আসিয়া কুবেবের মনে আনন্দ ধরে না। এবার হোসেন মিয়া আসিয়া পড়িলেই সে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হইতে পারে। জাহাজঘাটে স্টিমার ভিড়িলে কুবের গিয়া যাত্রীদের অবরোহণ পথটির মুখে দাঁড়াইযা থাকে, মোটঘাট লইয়া দেশবিদেশের কত নরনারী তাহার সামনে দিয়া রেল স্টেশনের দিকে চলিয়া যায়, কুবেবের উৎসুক দৃষ্টি অনুসন্ধান করে হোসেনকে। সমস্ত যাত্রী নামিয়া আসিবার পরেও সে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকে।
হোসেন আসিল তিনদিন পরে রাত্রের স্টিমারে। প্রতীক্ষা করিতে করিতে কুবের চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, হোসেনকে দেখিবামাত্র সমস্ত চাঞ্চল্য তাহার অন্তর্হিত হইয়া গেল। নির্ভয় নিশ্চিন্ত রহস্যময় সদানন্দ মানুষটির সাহচর্যে মুহূর্তে সকল উত্তেজনা জুড়াইয়া যায়,–কঠিন কর্তব্য সম্পন্ন করার গর্ব, আগাম কর্তব্য সম্পাদনের দুর্ভাবনা কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। তাই বটে। ভালোয় ভালোয় কুবের চাঁদপুর আসিয়া পৌঁছিতে না পারিলেও কিছুই আসিয়া যাইত না বটে হোসেনের!—মৃদু মৃদু হাসিয়া সে বলিত, দরিয়ায চুবাইয়া আইছ নাও? ভালা করছ কুবির বাই!
হোসেন নৌকায় আসিয়া বসিল। সকলে তাহাকে ঘিরিযা রহিল, ছইয়েব মধ্যে নছিবন ও রসুলের স্ত্রী ঘোমটার ভিতর হইতে চাহিতে লাগিল—হোসেনকে দেখিয়াই তাহারা ঘোমটা দিয়াছে। মৃদু মৃদু হাসে হোসেন, সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করে; দাড়ি মুঠা করিয়া ধরিয়া সকৌতুকে রসুলের ছ বছরের মেয়েটাকে বিবিজান বলিয়া ডাকে। আমিনুদ্দি মেয়ের খবর জিজ্ঞাসা করিলে বলে তাহাকে সে বহাল তবিয়তে ঘরের কাজ করিতে দেখিয়া আসিয়াছে, দুশমন বলিয়া গাল দিয়া হোসেনকে সে নাকি কড়া কড়া কথা বলিয়াছে অনেক।
আমিনুদ্দির চোখ ছলছল করে। সে বলে, আল্লা জানে মিয়া, আর ফির্যা আমু না ভাবলি মনডা পোড়ায়।
হোসেন বলে, ফিরনের মন থাকলি কও মিয়া অখন, জাহাজে তুইলা দিই তোমারে কইল। খুশ না হলি ক্যান যাবা?
আমিনুদ্দি নীরবে মাথা নাড়ে।
হোসেন বলে, তবে কাইল তোমাগো নিকা সারি?
আমিনুদ্দি বিস্মিত হইয়া বলে, কাইল ক্যান? ময়নাদ্বীপি দিবা-দুইমাস বাদ।
হোসেন বলে, ময়নাদ্বীপি মোল্লা পামু কই? রাজবাড়ির আজীজ ছাহাব কন, ময়নাদ্বীপি শও জনা মানুষ হলি আর মসজিদ দিলি আর হিঁদুরে জমিন না দিলি গিয়া থাকতি পারেন। তা পারুম না মিয়া। হিঁদু না নিলি মানুষ পামু কই? হিঁদু নিলি মসজিদ দিমু না। ক্যামনে দিমু কও; মুসলমানে মসজিদ দিলি, হিঁদু দিব ঠাকুরঘর—না মিয়া, আমার দ্বীপির মদ্যি ও কাম চলব না।
সকলে অভিভূত হইয়া শোনে। হোসেনের মুখে ময়নাদ্বীপের কথা কুবের কখনও শোনে নাই, আজ হোসেন বলিতে থাকে ওই দ্বীপটির জন্য তার কত দরদ। নিলামে দ্বীপটি কিনিবার পর ওখানে জনপদ বসানোর স্বপ্ন দেখিতেছে সে, জীবনে আর তার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য নাই, কামনা নাই,—হাজার দেড়েক মানুষ ওখানে চলাফেরা করিতেছে, এক বিঘা জমিও দ্বীপের কোনোখানে আকৰ্ষিত নাই, মরিবার আগে এইটুকু শুধু সে দেখিয়া যাইতে চায়। কত অর্থ ও সময় সে ব্যয় করিয়াছে দ্বীপের পিছনে! ময়নাদ্বীপের নেশা পাইয়া না বসিলে আজ তো সে বড়োলোক—একসঙ্গে তাহার এতগুলি লাভরান ব্যাবসা দাঁড়াইয়া গিয়াছে যে ভাবিতে বসিলে আল্লার করুণার পরিচয়ে মাথা নত হইয়া আসে। হ, ময়নাদ্বীপ ব্যাপিয়া একদিন মানুষের জীবনের প্রবাহ বহিবে বলিয়া যে কাজে হোসেন হাত দেয় সেই কাজ খোদাতালা সফল করিয়া দেন। টাকা না থাকিলে সে পরিবে কেন এই কঠিন কাজ সম্পন্ন করিতে?
কী কও রসুল, নিকা সারি কাইল?
রসূল সায় দিয়া বলে, আমি কী কমু মিয়া, যা মন লয় করেন।
হোসেন বলে, বইন কী কয়, জিগাও।
রসুল ছইয়ের মধ্যে গিয়া খানিক পরামর্শ করিয়া আসে। নছিবনের মত আছে। আমিনুদ্দি নিঃশব্দে বসিয়া থাকে। আপন মনে কী যেন সে ভাবিতে থাকে বন্দরের আলোকমালার দিকে চাহিয়া! কুবের সবিস্ময়ে হোসেনের প্রত্যেকটি ভাবভঙ্গি লক্ষ করে। কী প্রতিভা লোকটার, কী মনের জোর : যেখানে যত ভাঙাচোরা মানুষ পায় কুড়াইয়া নিয়া জোড়াতালি দিয়া নিজের দ্বীপে রাজ্য স্থাপন করিতেছে—প্রজাবৃদ্ধির ব্যবস্থার দিকে তাহার সজাগ দৃষ্টি! হোসেনের উদ্দেশ্যই হয়তো তাই, আমিনুদ্দির মতো জীবনযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হতাশ ও নিরুৎসাহ মানুষগুলিকে আসলে তাহার প্রয়োজন নাই, ওরা তাহার দ্বীপটি যে নবীন নরনারীতে ভরিয়া দিবে, সে তাহাদেরই প্রতীক্ষা করিয়া আছে!
অনেক রাত্রে হোসেন বিদায় গ্রহণ করিল। নৌকায় তখন জল্পনা-কল্পনার অন্ত রহিল না। প্রথম বিস্ময়টা কাটিয়া যাওয়ার পর আমিনুদ্দির সঙ্গে সকলে হাস্য-পবিহাস জুড়িয়া দিল। ঠাট্টা করিতে বড়ো মজবুত শম্ভু। তার এক একটা কথায় নৌকায় হাসির কলরব উঠিতে লাগিল, ছইয়ের মধ্যে রমণী দুটি পর্যন্ত মাঝে মাঝে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিয়া মুখে কাপড় চাপা দিতে লাগিল।
পরদিন আমিনুদ্দির সঙ্গে নছিবনের নিকা হইয়া গেল। তার পরের দিন কতকগুলি চাষের যন্ত্রপাতি, তিন চার বস্তা আলু, এক পিপা সরিষার তৈল, কাঠের একটা বাক্সো বোঝাই নুন, কতকগুলি সস্তা বিলাতি কম্বল, এক বস্তা কাপড় জামা এই সব অজস্র জিনিসপত্রে হোসেন নৌকা বোঝাই করিয়া ফেলিল।
রাত্রি প্রভাত হইলে বলিল, নাও খোলো কুবির বাই।
কোনদিক যামু মিয়া বাই?
হোসেন বলিল, সমুন্দুর।
সারাদিন এই তীর ঘেঁষিয়া নৌকা চলিল। কেতুপুরের পদ্মায় যে নৌকাকে অত্যন্ত বৃহৎ মনে হইয়াছিল, এখন সেটিকে কুবেরের মোচার খোলা বলিয়া মনে হইতে লাগিল। পরদিন অপরাহ্লে নোয়াখালি জেলার নারিকেল বৃক্ষপূর্ণ তীরভূমিতে নৌকা বাঁধা হইল। এদিকে কুবের কখনও আসে নাই, বিস্ময়ের সঙ্গে সে হোসেনকে জিজ্ঞাসা করিল, এই কি সমুন্দুর? হোসেন একখানা ম্যাপ বাহির করিল। আঙুল দিয়া সে কুবেরকে চিনাইয়া দিতে লাগিল মেঘনার মোহানার দ্বীপগুলি—সিদ্ধিদ্বীপ, বিদৌদ্বীপ, সন্দ্বীপ, হাতিয়া প্রভৃতি। আরও পশ্চিমে মানপুরদ্বীপ, দক্ষিণ-শারাজপুর, বন্দোরাদ্বীপ। আর ওই যে ছোটো ছোটো বিন্দুগুলি দেখা যায় বাইশ নম্বর মোটা লাইনটার উপরে, ওগুলি মানিক দ্বীপপুঞ্জ। চিনিতে পারিতেছে কুবের? আর ওই পুব-পশ্চিমের বাইশ নম্বর লাইন আর উত্তর-দক্ষিণের এই একানব্বই নম্বর লাইনটা যে বিন্দুতে পরস্পরকে অতিক্ৰম করিয়াছে, এই বিন্দুটির কিছু উত্তর-পূর্বে ওই যে একটি সবুজ বিন্দু দেখা যায় ওর নাম ময়নাদ্বীপ। জানে কুবের,—ওরই নাম ময়নাদ্বীপ! আব ঘণ্টা দশেক নৌকা বাহিয়া তাহারা নোয়াখালির তীরভূমিকে পিছনে ফেলিবে, তারপর হাতিয়া ডাইনে রাখিয়া ধনমানিক দ্বীপ ছুঁইয়া, ধনমানিক দ্বীপ আর রাবনাবাদ দ্বীপের যোগরেখার সঙ্গে বিয়াল্লিশ ডিগ্রি কোণ করিয়া পূর্ব-দক্ষিণে নৌকা বাহিলে একদিনে ময়নাদ্বীপে পৌঁছানো যাইবে।
কুবের ভালো বুঝিতে পারে না! হী করিয়া নকশার বেখা ও লেখাগুলির দিকে চাহিয়া থাকে। কে জানে ওর মধ্যে মধ্যে ডাঙা ও জলের পার্থক্য কী কৌশলে আঁকা আছে, সে তো কোনো প্রভেদ বুঝিতে পারে না!
হোসেন মিয়া যে কত বড়ো দক্ষ নাবিক, দিকচিহ্নহীন সমুদ্রের বুকে তাহার নৌকা পরিচালনা দেখিয়াই তাহা বোঝা গেল। সামনে একটা কম্পাস রাখিয়া সে হাল ধরিয়া বসিল, নৌকার ছযজন মাঝি টানিতে লাগিল দাঁড়। সারাদিন পরে রক্তিম সূর্য সমুদ্রের জলে ডুবিয়া গেল, পুবে বহুদূরে কালো বিন্দুল মতো একটি দ্বীপ ছাড়া সূর্য শুধু দেখাইয়া গেল আকাশ ও জলরাশি। রাত্রেও দাঁড় টানার বিবাম হইল না, পালা করিয়া দুজন দুজন মাঝিকে দুঘণ্টা করিয়া ঘুমানোব অবসর দিয়া চারজনকে হোসেন সবসময়ে বসাইয়া রাখিল দাঁড়ে, নিজে এক মিনিটেব জন্যও চোখ বুজিল না। নৌকার সকলে হয়রান হইয়া গেল, কুবেরের মনে হইতে লাগিল নৌকা বাহিয়া জীবনে সে আর কোনোদিন এত শ্রান্ত হইয়া পড়ে নাই।
সকালবেলা দেখা গেল চাবিদিক নিবিড় কুয়াশায় ঢাকিয়া গিয়াছে।
হোসেন বলিল, বইঠা থোও কুবির, নোঙর ফেলো।
এতখানি কাছি টানিয়া নোঙর সমুদ্রের তলে গিয়া ঠেকিল যে কুবেরের মনে হইল নোঙরটা পাতালে গিয়া পৌঁছিযাছে। কুযাশায় নৌকা চালাইবার উপায় নাই, ধনমানিক দ্বীপের কাছাকাছি তাহারা আসিয়া পড়িযাছে, কুয়াশায় দেখিতে না পাইয়া পাশ কাটাইয়া দূ্রে চলিয়া গেলে বিপদ হইবে; এই দ্বীপটির অবস্থান দেখিয়া তবে ঠিক করা যাইবে বাবনাবাদ দ্বীপের সঙ্গে ইহার যোগরেখা, তারপর সোজা আগানো চলিবে কম্পাসের উপর নির্ভর করিয়া একেবারে ময়নাদ্বীপের দিকে। সারাদিন নৌকার অবস্থান বুঝিতে পাবা যাইবে কি না সন্দেহ। অপেক্ষা করিতে হইবে রাত্রির জন্য। রাত্রে তারা উঠিলে ওই যে অদ্ভুত যন্ত্রটা আছে হোসেনের, ওই যন্ত্রের ভিতর দিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া তবে হোসেন বলিতে পারিবে যে দিকে কতদূরে ধনমানিক দ্বীপ লুকাইয়া আছে।
কি জান মিয়া, কলের জাহাজ হলি, জানন যায় কত জোর চলতেছি, ঘণ্টায় কয় মাইল আলাম-সমুদ্দুরের কোনখানে রইছি হিসাব করলি মেলে। নাও চালাইয়া জানুম কিবা?—দাড়িতে হাত বুলায় হোসেন, সকলকে অভয় দিয়া আবার বলে, ডরাইও না, দশ বাজলি কুয়াশা থাকবে না। আইজ কাইল রোজ বিহানবেলা কুয়াশা হয়। অ্যাবে কি কুয়াশা কয় মাঝি?
বসিয়া বসিয়া হোসেন গল্প বলে, সকলে শোনে। এ যেন কেতুপুরেরই এক ভাঙা কুটিরে হোসেনের আড্ডা বসিয়াছে। এমনই কুয়াশার মধ্যে একবার সে সমুদ্রের বুকে হারাইয়া গিয়াছিল, তিনদিন নোঙর ফেলিয়া ছিল সমুদ্রে, জল ফুরাইয়া গিয়া শেষের দিন তৃষ্ণায় ছাতি তাহদের ফাটিয়া গিয়াছিল। তারপর হোসেন কম্পাস কিনিয়াছে, তারা দেখিয়া নৌকার অবস্থান নির্ণয়ের যন্ত্র কিনিয়াছে—চাঁটগায়ে হোসেন যখন জাহাজে কাজ করিত, খালাসির কাজ করিতে করিতে শেষ পর্যন্ত একটা মালবাহী স্টিমারের বো-সান পর্যন্ত সে হইয়াছিল, সেই সময় এক সাহেব কাপ্তেনের কাছে সে এ সব যন্ত্রের ব্যবহার শিখিয়াছে। বড়ো বড়ো জাহাজ চালাইয়া হোসেন এখন পৃথিবী ঘুরিয়া আসিতে পারে!
পৃথিবী সে কি ঘুরিয়া আসে নাই? হ, সে কাহিনি বলিবার মতো বটে! কুড়ি বছর বয়সে হোসেন বাড়ি ছাড়িয়া পালাইয়াছিল, তারপর অর্ধেক জীবন সে তো দেশ-বিদেশে ঘুরিয়াই কাটাইয়াছে—নদীর বুকে ও সমুদ্রে।
অনেক বেলায় আস্তে আস্তে কুয়াশা মিলাইয়া গেল। নোঙর তোলা হইল। দুঘণ্টা পরে দূরে দেখা গেল ধনমানিক দ্বীপ। কম্পাসটা সামনে রাখিয়া হোসেন হাল ধরিয়া বসিল, পরদিন ভোরবেলা তাহারা ময়নাদ্বীপে পৌঁছিয়া নোঙর ফেলিল।
এই ময়নাদ্বীপ? পাঁচ ছয় বৎসর ধরিয়া যে রহস্য-নিকেতনের কথা সে শুনিয়া আসিয়াছে? কুবের যেন একটিমাত্র দৃষ্টিপাতে সমস্ত দ্বীপটিকে দেখিয়া ফেলিতে চায়। দ্বীপের খানিকটা ডিম্বাকৃতি, খানিকটা ত্রিকোণ। দ্বীপের দীর্ঘতম পরিসর প্রায় এগাবো মাইল–হোসেন নিজে মাপিয়া দেখিয়াছে। দ্বীপের যেখানে নৌকা ভিড়িয়াছিল, সেদিকে খানিকটা অংশ পরিষ্কার করিয়া বসতি স্থাপিত হইয়াছে, চাষ হইতেছে, বাকি অংশ জঙ্গলে ঢাকা। পশ্চিম দিকে অসংখ্য নারিকেল গাছ, সমস্ত দ্বীপে ছড়াইয়া না পড়িয়া গাছগুলি একস্থানে ঘন হইয়া মাথা তুলিয়াছে কেন বোঝা যায় না।
জমি অত্যন্ত নিচু, এত নিচু যে আশঙ্কা হয় যেদিন খুশি হইবে সেইদিনই সমস্ত দ্বীপটিকে সমুদ্র গ্রাস করিয়া ফেলিবে। দ্বীপের মাঝখানে এক মাইল পরিমিত একটা লোনা জলা আছে, সমুদ্রের চেয়েও ওখানটা বুঝি নিচু, খাল কাটিয়া যোগ করিয়া দিলে সমুদ্রের জল আসিয়া ভরিয়া ফেলিবে। জলার ধারে খানিকটা ধানের জমি করা হইয়াছে, বিস্ময়কর ফসল ফলে। জলায় ও চারিদিকের জঙ্গলে অসংখ্য সাপ আছে, কিন্তু জন্তুজানোয়ার কিছু নাই, রাসু যে বাঘ সিংহের গল্প করিয়াছিল সেটা নিছক গল্পই।
হোসেন মিয়ার উপনিবেশে লোকসংখ্যা একশোর কম নয়, কিন্তু তার তিন ভাগই প্রায় ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে, যাদের অধিকাংশ এই দ্বীপে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। ম্যালেবিয়া ও সাপের সঙ্গে লড়াই করিয়া এখনও হোসেন জয়লাভ করিতে পারে নাই, জঙ্গলের সঙ্গে অবিরত সংগ্রাম চলিয়াছে, অনেক খাদ্য এখানে উৎপন্ন করা যায় না, জীবনের অনেক প্রয়োজন মিটাইতে সমুদ্র পথে পাড়ি দিতে হয় সভ্য জগতের দিকে। অবিশ্রাম খাটুনি এখানে, অসংখ্য অসুবিধা এখানে, জীবন এখানে নির্মম ও নীরব। রাসুর মতো অনেকে তাই পালাইয়া গিয়াছে। হোসেনের পাঁচ বছরের চেষ্টায় দ্বীপে তাই ত্রিশটির বেশি পরিবার নীড় বাঁধে নাই। আমিনুদ্দি ও রসুলকে ধরিলে দ্বীপের গৃহস্থ পরিবারের সংখ্যা এবার বত্রিশ হইল মাত্র।
কী কঠিন কাজে হোসেন মিয়া যে আত্মনিয়োগ করিয়াছে, কী সীমাহীন যে তাহার ধৈর্য ও অধ্যবসায়, এবার কুবের তাহা ভালো করিয়া বুঝিতে পারে। এই নিচু, জলা ও জঙ্গলপূর্ণ মনুষ্যবাসের অযোগ্য দ্বীপ, ধান ছাড়া আর কোনো ফসল যে দ্বীপের লোনা মাটিতে জন্মে না, লাউ কুমড়াগুলি ফলে কুঁকড়ানো শশার মতো ছোটো ছোটো,—এখানে এই মুষ্টিমেয় নরনারীর বসতি স্থাপন করাও হোসেন মিয়া ছাড়া আর কারও দ্বারা সম্ভব হইত না। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, ধনমানিক, রাবনাবাদ এইসব জনপূর্ণ দ্বীপের কথা কুবের শুনিয়াছে, ময়নাদ্বীপ যদি মানুষের বাসের যোগ্য হইত ওই সব দ্বীপের মতো কবে এখানে গড়িয়া উঠিত গ্রাম। এ কী কদর্য একটা দ্বীপ হোসেন বাছিয়া লইয়াছে?
হয়তো সস্তায় পাইয়াছিল বলিয়া। স্বাস্থ্যকর, উর্বর দ্বীপ কিনিয়া জমিদারি পত্তনের টাকা হোসেন কোথায় পাইত, ও রকম জনহীন দ্বীপই বা কোথায়।
দ্বীপ দেখিয়া আমিনুদ্দি ও বসুল বড়ো দমিয়া গিয়াছে। ফিরিয়া যাওয়ার কথাটাও তাদের মুখে শোনা গিয়াছে দু-একরাব। তবে হোসেনের সামনে তারা কিছু বলে নাই। বলা যায় না। কত উপকার যে হোসেন তাদের করিয়াছে তার হিসাব হয় না। আমিনুদ্দি অপরিশোধ্য আর্থিক ঋণেই শুধু আবদ্ধ নয়, হোসেন না দিলে এ জীবনে স্ত্রী কি আর তাহার জুটিত, নছিবনের মতো স্ত্রী? রসুলকে জেলের দুয়ার হইতে ছিনাইয়া নিয়া আসিয়াছে হোসেন, দেশে ফিরিলে জেলেই হয়তো তাহাকে ঢুকিতে হইবে। প্রতিদানে হোসেন আর কিছুই তাদের কাছে চায় না, তারা শুধু এখানে বাস করুক, স্বপ্ন সফল হোক হোসেনের। ইতিমধ্যে তাদের জন্য ঘর উঠিতে আরম্ভ হইয়াছে, দযা করিয়া ওই ঘরে তারা নীড় বাধিলে কৃতাৰ্থ হইয়া যাইবে হোসেন। জঙ্গল কাটিয়া যত জমি তারা চাষের উপযোগী করিতে পরিবে সব তাদের সম্পত্তি, খাজনা বা চাষের ফসল কিছুই হোসেন দাবি করিবে না। নিজেদের জীবিকা তাহারা যতদিন নিজেরাই অর্জন করিতে পরিবে না, জীবিকা পর্যন্ত জোগাইবে হোসেন। গৃহ ও নারী, অন্ন ও বস্ত্র, ভূমি ও স্বত্ব সবই তো পাইলে তুমি, এবার শুধু খাটিবে ও জন্ম দিলে সন্তানেব, এটুকু পরিবে না?
হোসেনের কাছে ফিরিয়া যাওয়াব কথা তাই কেহ মুখে আনিতে পারে না। ফিরিয়া যে যায়, সে যায় পালাইয়া, চুপিচুপি, চোরের মতো।
হোসেন তাদের ক্ষমা করে। দেখা হইলে রাসুর মতো হোসেন তাদের জঙ্গল সাফ করার মজুরি দেয়। জোর-জবরদস্তি হোসেনের নাই, অন্যায় সে কারও প্রতি করে না। শুধু তাকেই হোসেন শাস্তি দেয, ভীষণ ও মর্মান্তিক, যারা শত্ৰুতা করে হোসেনের, অকারণে ক্ষতি করিতে চায়, বিঘ্ন জন্মায় হোসেনের স্বপ্ন সফল হইবার পথে।
কদিন কুবের দ্বীপ দেখিয়া ও দ্বীপের মানুষগুলির সঙ্গে ভাব করিয়া কাটাইয়া দিল। খেতের ধান সব কাটা হইয়া গিয়াছে, কিছু সবিয়া, বুট ও মটর লাগানো হইয়াছে, মূলা, পালং, কপি প্রভৃতি শাকসবজি গত বছর বাঁচিয়া থাকিতে চাহে নাই, এ বছর কয়েক বিঘা জমিতে নূতন একপ্রকার সার দিয়া পবীক্ষাব জন্য কিছু কিছু চাষ হইয়াছে কী হইবে বলা যায় না।
আরও ভিতরের দিকে দ্বীপের মাটি রবিশস্যের উপযোগী কিনা দেখিবার জন্য জঙ্গলের মধ্যে এখন অল্প একটু স্থান পরিষ্কার করা হইতেছে। সকালবেলা দা কুড়াল লইযা একদল লোক জঙ্গলের মধ্যে মাইলথানেক হাঁটিয়া যায়, নির্বাচিত স্থানটিতে গাছপালা ঝোপঝাড় কাটিয়া সাফ কবে, শাবল দিয়া খুঁড়িয়া গাছের শিকড় তুলিয়া ফেলে, তারপর সারাদিন মশা ও পোকার কামড়ে শরীর ফুলাইযা সন্ধ্যার সময় ফিরিয়া আসে। কুবের একদিন দেখিতে গিযা শিহরিয়া ফিরিয়া আসিল। এই দ্বীপটির সৃষ্টির দিন হইতে যে বনভূমি কুমারী, তার বুকের এক খাবলা মাংস যেন সকলে ছিনাইয়া লইযাছে, চারিপাশে নিবিড় বনের মাঝখানে পরিষ্কৃত স্থানটুকু এমনই বীভৎস দেখায়!
কয়েকদিন আগে কী একটা গোলমাল হহয়ছিল দ্বীপে, হোসেন উপস্থিত না থাকিলে অনেকে একত্র হইয়া জটলা করে, ভাসা ভাসা দুটো একটা কথা কানে আসে কুবেরের। বিপিন নামে ষাট বছরের এক বৃদ্ধকে হোসেন এখানে মোড়ল করিয়াছে, তাকে ঘিরিয়াই জটলাটা জমাট বাঁধে বেশি, কুবের কাছে গেলেই কিন্তু সকলে চুপ করিয়া যায়। তারপর একদিন সন্ধ্যার সময় কাজকর্ম শেষ করিয়া সকলে যখন ঘরে ফিরিয়াছে, নিজের স্বতন্ত্র কুটিরের দাওয়ায় বসিয়া হোসেন প্রসন্ন মুখে টানিতেছে তামাক, বিপিন কথাটা ফাঁস করিল। বলিল, নালিশ আছে একটা। নালিশ? হোসেনের মুখ গম্ভীর হইয়া গেল।
বিপিন ধীরে ধীরে ব্যাপারটা খুলিয়া বলিল। নারীসংক্রান্ত লজ্জাকর ঘটনা। এনায়েত দ্বীপে আসিয়াছে মাত্র ছমাস আগে, ইতিমধ্যেই সে সকলকে বড়ো জ্বালাতন করিয়া তুলিয়াছে। প্রথম প্রথম এর সঙ্গে ওর সঙ্গে প্রায়ই তার কলহ বাধিত, একদিন নিরীহ দুর্বল গগন ঘোষকে মারিয়া সে জখম করিয়া দেয়, সকলে মিলিয়া তখন খুব শাসন করিয়া দেয় এনায়েতকে। তারপর হইতে সে বেশ শান্তশিষ্ট হইয়াই থাকে, ব্যাপারটা তাই হোসেনকে জানানো হয় নাই। কিন্তু কদিন আগে সে এক ভয়ানক অপরাধ করিয়া বসিয়াছে। বসির মিয়ার বউটি ছেলেমানুষ, কিছুদিন হইতে এনায়েত তাকে নাকি বিরক্ত করিতেছিল, ভয়ে বউটি কাহাকেও কিছু বলে নাই। তারপর একদিন দুপুরবেলা সকলে যখন কাজে গিয়াছে, এনায়েত বসিরের ঘরে প্রবেশ করে। বসিরের স্ত্রীর চেঁচামেচি শুনিয়া পাশের কুটিরের আকবরের স্ত্রী গিয়া পড়ায় বেচারি সেদিন ভালোয় ভালোয় রক্ষা পাইয়াছে।
হোসেন বলিল, হারামিব পোলারে কাইটা দরিয়ায় দিলা না ক্যান?
বিপিন স্বীকার করিল অতটা তাহারা করিতে পারে নাই, তবে মারধোর করা হইয়াছে যথেষ্ট! খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিযা সকলকে হোসেন ডাকিয়া আনিতে বলিল, এনায়েতও যেন আসে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সকলে আসিয়া জুটিল, মেয়েরাও কেহ কেহ আসিয়া তফাতে দাঁড়াইয়া রহিল কৌতুহলের সঙ্গে। বিচার হইবে এনায়েতের। কে জানে তাহাকে শূলেই দিবে না সাগবে ডুবাইয়া মারিবে হোসেন!