দেবদাস – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
দুই
দেবদাসকে পরদিন খুব মারধর করা হইল,—সমস্তদিন ঘরে রুদ্ধ করিয়া রাখা হইল। তাহার পর, তাহার জননী যখন ভারী কান্নাকাটি করিতে লাগিলেন, তখন দেবদাসকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল।পরদিন ভোরবেলায় সে পলাইয়া আসিয়া পার্ব্বতীর ঘরের জানালার নিকট দাঁড়াইল—ডাকিল, পারু! আবার ডাকিল, পারু!
পার্ব্বতী জানালা খুলিয়া কহিল, দেবদা!
দেবদাস ইশারা করিয়া বলিল, শিগগির আয়। দু’জনে একত্র হইলে দেবদাস বলিল, তামাক খাবার কথা বলে দিলি কেন?
তুমি মারলে কেন?
তুই জল আনতে গেলি না কেন?
পার্ব্বতী চুপ করিয়া রহিল।
দেবদাস বলিল, তুই বড় গাধা—আর যেন বলে দিসনে।
পার্ব্বতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না।
তবে চল্, ছিপ কেটে আনি। আজ বাঁধে মাছ ধরতে হবে।
বাঁশঝাড়ের নিকট একটা নোনা গাছ ছিল, দেবদাস তাহাতে উঠিয়া পড়িল। বহুকষ্টে একটা বাঁশের ডগা নোয়াইয়া পার্ব্বতীকে ধরিতে দিয়া কহিল, দেখিস যেন ছেড়ে দিসনে, তা হলে পড়ে যাব।
পার্ব্বতী প্রাণপণে টানিয়া ধরিয়া রহিল। দেবদাস সেইটা ধরিয়া একটা নোনাডালে পা রাখিয়া, ছিপ কাটিতে লাগিল। পার্ব্বতী নীচে হইতে কহিল, দেবদা, পাঠশালে যাবে না?
না।
জ্যাঠামশাই তোমাকে পাঠিয়ে দেবেন।
বাবা আপনি বলেচেন, আমি আর ওখানে পড়ব না। বাড়িতে পণ্ডিত আসবে।
পার্ব্বতী একটু চিন্তিত হইয়া উঠিল। পরে বলিল, কাল থেকে গরমের জন্য আমাদের সকালবেলা পাঠশালা বসে, আমি এখনি যাব।
দেবদাস উপর হইতে চক্ষু রাঙাইয়া বলিল, না, যেতে হবে না।
এই সময়ে পার্ব্বতী একটু অন্যমনস্ক হইয়া পড়িল,—অমনি বাঁশের ডগা উপরে উঠিয়া গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে দেবদাস নোনাডাল হইতে নীচে পড়িয়া গেল। বেশী উঁচু ছিল না বলিয়া তেমন লাগিল না, কিন্তু গায়ে অনেক স্থানে ছড়িয়া গেল। নীচে আসিয়া ক্রুদ্ধ দেবদাস একটা শুষ্ক কঞ্চি তুলিয়া লইয়া পার্ব্বতীর পিঠের উপর, গালের উপর, যেখানে-সেখানে সজোরে ঘা-কতক বসাইয়া দিয়া বলিল, যা, দূর হয়ে যা।
প্রথমে পার্ব্বতী নিজেই লজ্জিত হইয়া পড়িয়াছিল; কিন্তু যখন ছড়ির পর ছড়ি ক্রমাগত পড়িতে লাগিল, তখন সে ক্রোধে ও অভিমানে চক্ষু দুটি আগুনের মতো করিয়া কাঁদিয়া বলিল, এই আমি জ্যাঠামশায়ের কাছে যাচ্ছি—
দেবদাস রাগিয়া আর এক ঘা বসাইয়া দিয়া বলিল, যা, এখনি বলে দিগে যা—বয়ে গেল।
পার্ব্বতী চলিয়া গেল। যখন অনেকটা গিয়াছে, তখন দেবদাস ডাকিল, পারু!
পার্ব্বতী শুনিয়াও শুনিল না—আরও দ্রুত চলিতে লাগিল। দেবদাস আবার ডাকিল, ও পারু, শুনে যা না!
পার্ব্বতী জবাব দিল না। দেবদাস বিরক্ত হইয়া, কতকটা চিৎকার করিয়া, কতকটা আপনার মনে বলিল, যাক—মরুক গে।
পার্ব্বতী চলিয়া গেলে, দেবদাস যেমন-তেমন করিয়া দুই-একটা ছিপ কাটিয়া লইল। তাহার মনটা বিগড়াইয়া গিয়াছিল। কাঁদিতে কাঁদিতে পার্ব্বতী বাড়ি ফিরিয়া আসিল। তাহার গালের উপর ছড়ির দাগ নীল হইয়া ফুলিয়া রহিয়াছে। প্রথমেই ঠাকুরমার চক্ষে পড়িল। তিনি চেঁচাইয়া উঠিলেন,—ওগো, মা গো, কে এমন করে মারলে পারু?
চোখ মুছিতে মুছিতে পার্ব্বতী কহিল, পণ্ডিতমশাই।
ঠাকুরমা তাহাকে ক্রোড়ে লইয়া ভয়ানক ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, চল তো, একবার নারাণের কাছে যাই, দেখি সে কেমন পণ্ডিত! আহা—বাছাকে একেবারে মেরে ফেলেচে!
পার্ব্বতী পিতামহীর গলা জড়াইয়া কহিল, চল।
মুখুয্যে মহাশয়ের নিকট আসিয়া পিতামহী পণ্ডিত মহাশয়ের অনেকগুলি পুরুষের উল্লেখ করিয়া তাহাদিগের পারলৌকিক অশুভ ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন এবং খাদ্যদ্রব্যেরও তেমন ভাল ব্যবস্থা করিলেন না। শেষে স্বয়ং গোবিন্দকে নানামতে গালি পাড়িয়া বলিলেন, নারাণ, দেখ তো মিনসের আস্পর্ধা! শুদ্দুর হয়ে বামুনের মেয়ের গায়ে হাত তোলে! কি করে মেরেচে একবার দেখ। বলিয়া গালের উপর নীল দাগগুলা বৃদ্ধা অত্যন্ত বেদনার সহিত দেখাইতে লাগিলেন।
নারায়ণবাবু তখন পার্ব্বতীকেই প্রশ্ন করিলেন, কে মেরেচে পারু?
পার্ব্বতী চুপ করিয়া রহিল। তখন ঠাকুরমাই আর একবার চিৎকার করিয়া বলিলেন, আবার কে! ঐ গোঁয়ার পণ্ডিতটা।
কেন মারলে?
পার্বতী এবারও কথা কহিল না। মুখুয্যেমশাই বুঝিলেন, কোন দোষ করার জন্য মার খাইয়াছে—কিন্তু এরূপ আঘাত করা উচিত হয় নাই, প্রকাশ করিয়া তাহাই বলিলেন। শুনিয়া পার্বতী পিঠ খুলিয়া বলিল, এখানেও মেরেচে।
পিঠের দাগগুলা আরও স্পষ্ট, আরো গুরুতর। তাই দু’জনেই নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া গেলেন। পণ্ডিত মহাশয়কে ডাকিয়া কৈফিয়ত তলব করিবেন, মুখুয্যে মহাশয় এরূপ অভিসন্ধিও প্রকাশ করিলেন; এবং স্থির হইল যে, এরূপ পণ্ডিতের নিকট ছেলেমেয়ে পাঠান উচিত নহে।
রায় শুনিয়া পার্ব্বতী খুশি হইয়া ঠাকুরমার কোলে চড়িয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল। বাটীতে পৌঁছিয়া পার্ব্বতী জননীর জেরায় পড়িল। তিনি ধরিয়া বসিলেন, কেন মেরেচে বল্?
পার্ব্বতী বলিল, মিছিমিছি মেরেচে।
জননী কন্যার খুব করিয়া কান মলিয়া দিয়া বলিলেন, মিছিমিছি কেউ কখন মারে?
দালান দিয়া সেই সময়ে শাশুড়ি যাইতেছিলেন, তিনি ঘরের চৌকাঠের কাছে আসিয়া বলিলেন, বৌমা, মা হয়ে তুমি মিছিমিছি মারতে পার, আর সে মুখপোড়া পারে না?
বৌমা বলিল, শুধু-শুধু কখনো মারেনি। যে শান্ত মেয়ে—কি করেচে, তাই মার খেয়েচে।
শাশুড়ি বিরক্ত হইয়া বলিলেন—আচ্ছা, তাই না হয় হলো, কিন্তু ওকে আর আমি পাঠশালে যেতে দেব না।
একটু লেখাপড়া শিখবে না!
কি হবে বৌমা? একটা-আধটা চিঠিপত্র লিখতে পারলে, দু’ছত্র রামায়ণ-মহাভারত পড়তে শিখলেই ঢের। পারু কি তোমার জজিয়তি করবে, না উকিল হবে?
বৌমা অগত্যা চুপ করিয়া রহিল। সেদিন দেবদাস বড় ভয়ে-ভয়েই বাড়িতে প্রবেশ করিল। পার্ব্বতী যে ইতিমধ্যে সমস্তই বলিয়া দিয়াছে, তাহাতে তাহার আর কিছুমাত্র সংশয় ছিল না। কিন্তু বাড়ি আসিয়া যখন তাহার অণুমাত্র আভাসও প্রকাশ পাইল না, বরঞ্চ মায়ের কাছে শুনিতে পাইল—আজ গোবিন্দ পণ্ডিত পার্ব্বতীকেও অত্যন্ত প্রহার করিয়াছে, তাই আর সে পাঠশালায় যাইবে না—তখন আনন্দের আতিশয্যে তাহার ভাল করিয়া আহার করাই হইল না; কোনমতে নাকে-মুখে গুঁজিয়া পার্ব্বতীর কাছে ছুটিয়া আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, তুই আর পাঠশালে যাবিনে?
না।
কি ক’রে হ’ল রে?
আমি বললুম, পণ্ডিতমশায় মেরেচে।
দেবদাস খুব একগাল হাসিয়া, তাহার পিঠ ঠুকিয়া দিয়া, মত প্রকাশ করিল যে, তাহার মতো বুদ্ধিমতী এ পৃথিবীতে আর নাই। তাহার পর ধীরে ধীরে সে পার্ব্বতীর গালের নীল দাগগুলি সযত্নে পরীক্ষা করিয়া নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল, আহা!
পার্ব্বতী একটু হাসিয়া মুখপানে চাহিয়া বলিল, কি?
বড় লেগেচে, না রে পারু?
পার্ব্বতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হুঁ।
আহা, কেন অমন করিস, তাই তো রাগ হয়—তাই তো মারি।
পার্ব্বতী চোখে জল আসিল; মনে ভাবিল—জিজ্ঞাসা করে, কি করি? কিন্তু পারিল না।
দেবদাস তাহার মাথায় হাত রাখিয়া বলিল, আর অমন করো না, কেমন?
পার্ব্বতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না।
দেবদাস আর একবার তাহার পিঠ ঠুকিয়া দিয়া কহিল, আচ্ছা—আর কখনও তোকে আমি মারব না।