দেবদাস – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

পাঁচ

 পার্ব্বতী এই তের বছরে পা দিয়াছে—ঠাকুরমাতা এই কথা বলেন। এই বয়সে শারীরিক সৌন্দর্য অকস্মাৎ যেন কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া কিশোরীর সর্বাঙ্গ ছাইয়া ফেলে। আত্মীয়-স্বজন হঠাৎ একদিন চমকিত হইয়া দেখিতে পান যে, তাঁহাদের ছোট মেয়েটি বড় হইয়াছে। তখন পাত্রস্থা করিবার জন্য বড় তাড়াহুড়া পড়িয়া যায়। চক্রবর্তী-বাড়িতে আজ কয়েক দিবস হইতেই সেই কথার আলোচনা হইতেছে। জননী বড় বিষণ্ণ; কথায় কথায় স্বামীকে শুনাইয়া বলেন, তাইত, পারুকে আর তো রাখা যায় না। তাঁহারা বড়লোক নহেন; তবে ভরসা এই যে, মেয়েটি অতিশয় সুশ্রী। জগতে রূপের যদি মর্যাদা থাকে, তো পার্ব্বতীর জন্য ভাবিতে হইবে না। আরও একটা কথা আছে—সেটা এইখানেই বলিয়া রাখি। চক্রবর্তী-পরিবারে ইতিপূর্বে কন্যার বিবাহে এতটুকু চিন্তা করিতে হইত না, পুত্রের বিবাহে করিতে হইত। কন্যার বিবাহে পণ গ্রহণ করিতেন এবং পুত্রের বিবাহে পণ দিয়া মেয়ে ঘরে আনিতেন। নীলকণ্ঠের পিতাও তাঁহার কন্যার বিবাহে অর্থ গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু নীলকণ্ঠ স্বয়ং এ-প্রথাটাকে ঘৃণা করিতেন। তাঁহার আদৌ ইচ্ছা ছিল না যে, পার্ব্বতীকে বিক্রয় করিয়া অর্থ লাভ করিবেন। পার্ব্বতীর জননী এ-কথা জানিতেন; তাই স্বামীকে কন্যার জন্য তাগাদা করিতেন। ইতিপূর্বে পার্ব্বতীর জননী মনে মনে একটা দুরাশাকে স্থান দিয়াছিলেন—ভাবিয়াছিলেন, দেবদাসের সহিত যদি কোন সূত্রে কন্যার বিবাহ ঘটাইতে পারেন। এ আশা যে নিতান্ত অসম্ভব, তাহা মনে হইত না। ভাবিলেন, দেবদাসকে অনুরোধ করিলে বোধ হয় কোন সুরাহা হইতে পারে। তাই বোধ হয় নীলকণ্ঠের জননী কথায় কথায় দেবদাসের মাতার কাছে কথাটা এইরূপে পাড়িয়াছিলেন—আহা বৌমা, দেবদাসে আর আমার পারুতে কি ভাব! এমনটি কৈ, কোথাও তো দেখা যায় না!

 দেবদাসের জননী বলিলেন, তা আর হবে না খুড়ী, দু’জনে ভাই-বোনের মতোই যে একসঙ্গে মানুষ হয়ে এসেচে।

 হাঁ মা হাঁ—তাইত মনে হয়, যদি দু’জনের—এই দেখ না কেন বৌমা, দেবদাস যখন কলকাতায় গেল, বাছা তখন সবে আট বছরের; সেই বয়সেই ভেবে ভেবে যেন কাঠ হয়ে গেল। দেবদাসের একখানা চিঠি এলে, সেখানা যেন একবারে ওর জপমালা হয়ে উঠত। আমরা সবাই তো তা জানি!

 দেবদাসের জননী মনে মনে সমস্ত বুঝিলেন। একটু হাসিলেন। এ হাসিতে বিদ্রূপ কতটুকু প্রচ্ছন্ন ছিল জানি না, কিন্তু বেদনা অনেকখানি ছিল। তিনিও সব কথা জানিতেন, পার্ব্বতীকে ভালও বাসিতেন। কিন্তু বেচা-কেনা ঘরের মেয়ে যে! তার ওপর আবার ঘরের পাশে কুটুম্ব! ছি ছি! বলিলেন, খুড়ী, কর্তার তো একেবারে ইচ্ছা নয় এই ছেলেবেলায়, বিশেষ পড়াশুনার সময়ে দেবদাসের বিয়ে দেন। তাই তো কর্তা আমাকে এখনও বলেন, বড় ছেলে দ্বিজদাসের ছেলেবেলায় বিয়ে দিয়ে কি সর্বনাশটাই করলে। লেখাপড়া একেবারেই হলো না।

 পার্ব্বতীর ঠাকুরমা একেবারে অপ্রতিভ হইয়া পড়িলেন। তবুও কহিলেন, তা তো সব জানি বৌমা, কিন্তু কি জান—পারু, ষেটের বাছা একটু অমনি বেড়েচেও বটে, আর বাড়ন্ত গড়নও বটে, তাইতে—তাইতে—যদি নারাণের অমত—

 দেবদাসের জননী বাধা দিলেন; বলিলেন, না খুড়ী, এ কথা আমি তাঁকে বলতে পারব না। দেবদাসের এ-সময়ে বিয়ের কথা পাড়লে, তিনি কি আমার মুখ দেখবেন!

 কথাটা এইখানেই চাপা পড়িয়া গেল। কিন্তু স্ত্রীলোকের পেটে কথা থাকে না। দেবদাসের জননী কর্ত্তা র খাবার সময় কথাটা পাড়িয়া বলিলেন, পারুর ঠাকুমা আজ তার বিয়ের কথা পেড়েছিলেন।

 কর্ত্তা মুখ তুলিলেন; বলিলেন, হাঁ, পারুর বয়স হলো বটে; শীঘ্র বিবাহ দেওয়াই কর্ত্তব্য।

 তাইতে তো আজ কথা পেড়েছিলেন। বললেন, দেবদাসের সঙ্গে যদি—

 স্বামী ভ্রূ কুঞ্চিত করিলেন, তুমি কি বললে?

 আমি আর কি বলব! দু’জনের বড় ভাব; কিন্তু তাই বলে কি বেচা-কেনা, চক্রবর্তী-ঘরের মেয়ে আনতে পারি? তাতে আবার বাড়ির পাশে কুটুম্ব—ছি ছি!

 কর্ত্তা সন্তুষ্ট হইলেন; কহিলেন, ঠিক তাই। কুলের কি মুখ হাসাব? এ-সব কথায় কান দিও না।

 গৃহিণী শুষ্কহাসি হাসিয়া কহিলেন, না—আমি কান দিইনে; কিন্তু তুমিও যেন ভুলে যেয়ো না।

 কর্ত্তা গম্ভীরমুখে ভাতের গ্রাস তুলিয়া বলিলেন, তা হলে এত বড় জমিদারি কোন্‌কালে উড়ে যেত!

 জমিদারি তাঁহার চিরদিন থাকুক, তাহাতে আপত্তি নাই; কিন্তু পার্ব্বতীর দুঃখের কথাটা বলি। যখন এই প্রস্তাবটা নিতান্ত অগ্রাহ্য হইয়া নীলকণ্ঠের কানে গেল, তখন তিনি মাকে ডাকিয়া তিরস্কার করিয়া বলিলেন, মা, কেন এমন কথা বলতে গিয়েছিলে? মা চুপ করিয়া রহিলেন।

 নীলকণ্ঠ কহিতে লাগিলেন, মেয়ের বিয়ে দিতে আমাদের পায়ে ধরে বেড়াতে হয় না, বরং অনেকেই আমার পায়ে ধরবে। মেয়ে আমার কুৎসিত নয়। দেখো, তোমাদের বলে রাখলুম—এক হপ্তার মধ্যেই আমি সম্বন্ধ স্থির করে ফেলবো। বিয়ের ভাবনা কি?

 কিন্তু যাহার জন্য পিতা এতবড় কথাটা বলিলেন, তাহার যে মাথায় বাজ ভাঙ্গিয়া পড়িল। ছোটবেলা হইতে তাহার একটা ধারণা ছিল যে, দেবদাদার উপর তাহার একটু অধিকার আছে। অধিকার কেহ যে হাতে তুলিয়া দিয়াছে, তাহা নয়। প্রথম সে নিজেও ঠিকমতো কিছুই বুঝিতে পারে নাই,—অজ্ঞাতসারে, অশান্ত মন দিনে দিনে এই অধিকারটি এমন নিঃশব্দে অথচ এতই দৃঢ় করিয়া প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইয়াছিল যে, বাহিরে যদিও একটা বাহ্য আকৃতি তাহার এতদিন চোখে পড়ে নাই, কিন্তু, আজ এই হারানোর কথা উঠিতেই তাহার সমস্ত হৃদয় ভরিয়া একটা ভয়ানক তুফান উঠিতে লাগিল।

 কিন্তু দেবদাসের সম্বন্ধে এই কথাটা ঠিক খাটানো যায় না। ছেলেবেলায় যখন সে পার্ব্বতীর উপর দখল পাইয়াছিল, তখন তাহা সে পরিপূর্ণভাবেই উপভোগ করিয়াছিল। কিন্তু কলিকাতায় গিয়া কর্মের উৎসাহে ও অন্যান্য আমোদ-আহ্লাদের মধ্যে পার্ব্বতীকে সে অনেকটা ছাড়িয়াই দিয়াছিল। কিন্তু সে জানিত না যে, পার্ব্বতী তাহার সেই একঘেয়ে গ্রাম্য-জীবনের মধ্যে নিশিদিন শুধু তাহাকেই ধ্যান করিয়া আসিয়াছে। শুধু তাই নয়। সে ভাবিত, ছেলেবেলা হইতে যাহাকে নিতান্ত আপনার বলিয়াই জানিয়াছিল, ন্যায়-অন্যায় সমস্ত আবদারই এতদিন যাহার উপর খাটাইয়া লইয়াছে, যৌবনের প্রথম ধাপটিতে পা দিয়াই তাহা হইতে এমন অকস্মাৎ পিছলাইয়া পড়িতে হইবে না। কিন্তু তখন কে ভাবিত বিবাহের কথা?কে জানিত সেই কিশোর-বন্ধন বিবাহ ব্যতীত কোনমতেই চিরস্থায়ী করিয়া রাখা যায় না! ‘বিবাহ হইতে পারে না’, এই সংবাদটা পার্ব্বতীর হৃদয়ের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা তাহার বুকের ভিতর হইতে যেন ছিঁড়িয়া ফেলিবার জন্য টানাটানি করিতে লাগিল। কিন্তু দেবদাসকে সকালবেলাটায় পড়াশুনা করিতে হয়; দুপুরবেলায় বড় গরম, ঘরের বাহির হওয়া যায় না, শুধু বিকেলবেলাটাতেই ইচ্ছা করিলে একটু বাহির হইতে পারা যায়। এই সময়টাতেই কোনদিন বা সে জামাজোড়া পরিয়া, ভাল জুতা পায়ে দিয়া ছড়ি হাতে ময়দানে বাহির হইত। যাইবার সময় চক্রবর্তীদের বাড়ির পাশ দিয়াই যাইত,—পার্বতী উপরে জানালা হইতে চক্ষু মুছিতে মুছিতে তাহা দেখিত। কত কথা মনে পড়িত। মনে পড়িত, দু’জনেই বড় হইয়াছে,—দীর্ঘ প্রবাসের পর পরের মতো এখন পরস্পরকে বড় লজ্জা করে। দেবদাস সেদিন অমনি চলিয়া গিয়াছিল; লজ্জা করিতেছিল, তাই ভাল করিয়া কথাই কহিতে পারে নাই। এটুকু পার্ব্বতীর বুঝিতে বাকী ছিল না।

 দেবদাসও প্রায় এমনি করিয়াই ভাবে। মাঝে মাঝে তাহার সহিত কথা কহিতে, তাহাকে ভাল করিয়া দেখিতে ইচ্ছা হয়; কিন্তু অমনি মনে হয়, ইহা কি ভাল দেখাইবে?

 এখানে কলিকাতার সেই কোলাহল নাই, আমোদ-আহ্লাদ, থিয়েটার, গান-বাজনা নাই—তাই কেবলই তাহার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, সেই পার্ব্বতী এই পার্ব্বতী হইয়াছে! পার্ব্বতী মনে করে, সেই দেবদাস—এখন এই দেবদাসবাবু হইয়াছে! দেবদাস এখন প্রায়ই চক্রবর্তীদের বাটীতে যায় না। কোনদিন যদি-বা সন্ধ্যার সময় উঠানে দাঁড়াইয়া ডাকে, খুড়ীমা, কি হচ্ছে?

 খুড়ীমা বলেন, এসো বাবা, বোস।

 দেবদাস অমনি কহে—না থাক খুড়ীমা, একটু ঘুরে আসি।

 তখন পার্ব্বতী কোনদিন বা উপরে থাকে, কোনদিন বা সামনে পড়িয়া যায়। দেবদাস খুড়ীমার সহিত কথা কহে, পার্ব্বতী ধীরে ধীরে সরিয়া যায়। রাত্রে দেবদাসের ঘরে আলো জ্বলে। গ্রীষ্মকালের খোলা জানালা দিয়া পার্ব্বতী সেদিকে বহুক্ষণ হয়ত চাহিয়া থাকে—আর কিছুই দেখা যায় না। পার্ব্বতী চিরদিন অভিমানিনী। সে যে ক্লেশ সহ্য করিতেছে, ঘূণাগ্রে এ কথা কেহ না বুঝিতে পারে, পার্ব্বতীর ইহা কায়মন চেষ্টা। আর জানাইয়াই বা লাভ কি?

সহানুভূতি সহ্য হইবে না, আর তিরস্কার-লাঞ্ছনা?—তা তার চেয়ে তো মরণ ভাল। মনোরমার গত বৎসর বিবাহ হইয়াছে। এখনও সে শ্বশুরবাড়ি যায় নাই, তাই মাঝে মাঝে বেড়াইতে আসে। পূর্বে দুই সখীতে মিলিয়া মাঝে মাঝে এইসব কথাবার্তা হইত, এখনও হয়; কিন্তু পার্ব্বতী আর যোগ দেয় না—হয় চুপ করিয়া থাকে, না হয় কথা উলটাইয়া দেয়।

পার্ব্বতী পিতা কাল রাত্রে বাটী ফিরিয়াছেন। এ কয়দিন তিনি পাত্র স্থির করিতে বাহিরে গিয়াছিলেন। এখন বিবাহের সমস্ত স্থির করিয়া ঘরে আসিয়াছেন। প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ক্রোশ দূরে বর্ধমান জেলায় হাতীপোতা গ্রামের জমিদারই পাত্র। তাঁহার অবস্থা ভাল, বয়স চল্লিশের নীচেই—গত বৎসর স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছে, তাই আবার বিবাহ করিবেন। সংবাদটা যে বাটীর সকলেরই চিত্তরঞ্জন করিয়াছিল, তাহা নহে, বরং দুঃখের কারণই হইয়াছিল; তবে একটা কথা এই যে, ভুবন চৌধুরীর নিকট হইতে সর্বরকমে প্রায় দু’তিন হাজার টাকা ঘরে আসিবে। তাই মেয়েরা চুপ করিয়া ছিলেন।

 একদিন দুপুরবেলা দেবদাস আহারে বসিয়াছিল। মা কাছে বসিয়া কহিলেন, পারুর যে বিয়ে।

 দেবদাস মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কবে?

 এই মাসেই। কাল মেয়ে দেখে গেছে। বর নিজেই এসেছিল।

 দেবদাস কিছু বিস্মিত হইল,—কৈ, আমি তো কিছু জানিনে মা!

 তুমি আর কি করে জানবে? বর দোজবরে—বয়স হয়েচে; তবে বেশ টাকাকড়ি নাকি আছে, পারু সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে।

 দেবদাস মুখ নিচু করিয়া আহার করিতে লাগিল। তাহার জননী পুনরায় কহিতে লাগিলেন, ওদের ইচ্ছা ছিল এই বাড়িতে বিয়ে দেয়।

 দেবদাস মুখ তুলিল—তারপর?

 জননী হাসিলেন—ছিঃ, তা কি হয়! একে বেচা-কেনা ছোটঘর, তাতে আবার ঘরের পাশে বিয়ে, ছি ছি—বলিয়া মা ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিলেন। দেবদাস তাহা দেখিতে পাইল।

 কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া মা পুনরায় কহিলেন, কর্তাকে আমি বলেছিলাম।

 দেবদাস মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবা কি বললেন?

 কি আর বলবেন! এতবড় বংশের মুখ হাসাতে পারবেন না,—তাই আমাকে শুনিয়ে দিলেন।

 দেবদাস আর কথা কহিল না।

 সেইদিন দ্বিপ্রহরে মনোরমা ও পার্ব্বতীতে কথোপকথন হইতেছিল। পার্ব্বতীর চোখে জল,—মনোরমা বোধ করি এইমাত্র মুছিয়াছে। মনোরমা কহিল,—তবে উপায় বোন? পার্ব্বতী চোখ মুছিয়া কহিল, উপায় আর কি? তোমার বরকে তুমি পছন্দ করে বিয়ে করেছিলে?

 আমার কথা আলাদা। আমার পছন্দ ছিল না, অপছন্দও হয়নি; তাই আমার কোন কষ্টই ভোগ করতে হয় না। কিন্তু তুমি যে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মেরেচ বোন!

 পার্ব্বতী জবাব দিল না,—ভাবিতে লাগিল।

 মনোরমা কি ভাবিয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিল, পারু, বরটির বয়স কত?

 কার বরটির?

 তোর।

 পার্ব্বতী একটু হিসাব করিয়া বলিল, বোধ হয় উনিশ।

 মনোরমা অতিশয় বিস্মিত হইল; কহিল, সে কি, এই যে শুনলুম প্রায় চল্লিশ!

 এবারে পার্ব্বতীও একটু হাসিল; কহিল, মনোদিদি, কত লোকের বয়স চল্লিশ থাকে, আমি কি তার হিসাব রাখি? আমার বরের বয়স উনিশ-কুড়ি এই পর্যন্ত জানি।

 মুখপানে চাহিয়া মনোরমা জিজ্ঞাসা করিল, কি নাম রে?

 পার্ব্বতী আবার হাসিয়া উঠিল—এতদিনে বুঝি তাও জানো না!

 কি করে জানব!

 জান না? আচ্ছা বলে দিই। একটু হাসিয়া, একটু গম্ভীর হইয়া পার্ব্বতী তাহার কানের কাছে মুখ আনিয়া বলিল, জানিস নে—শ্রীদেবদাস—

 মনোরমা প্রথমে একটু চমকাইয়া উঠিল। পরে ঠেলিয়া দিয়া বলিল, আর ঠাট্টায় কাজ নেই। নাম কি, এই বেলা বল্‌, আর তো বলতে পাবিনে—

 এই ত বললুম।

 মনোরমা রাগ করিয়া কহিল, যদি দেবদাস নাম—তবে কান্নাকাটি করে মরচিস কেন?

 পার্ব্বতী সহসা মলিন হইয়া গেল। কি যেন একটু ভাবিয়া বলিল, তা বটে। আর তো কান্নাকাটি করব না—

 পারু। কি?

 সব কথা খুলে বল্‌ না বোন! আমি কিছুই বুঝতে পারলুম না।

 পার্ব্বতী কহিল, যা বলবার সবই তো বললুম।

 কিন্তু কিছুই যে বোঝা গেল না রে!

 যাবেও না। বলিয়া পার্ব্বতী আর-একদিকে মুখ ফিরাইয়া রহিল।

 মনোরমা ভাবিল, পার্ব্বতী কথা লুকাইতেছে,—তাহার মনের কথা কহিবার ইচ্ছা নাই। বড় অভিমান হইল; দুঃখিত হইয়া কহিল, পারু, তোর যাতে দুঃখ, আমারও তো তাতে তাই বোন। তুই সুখী হ, এই তো আমার আন্তরিক প্রার্থনা। যদি কিছু তোর লুকোন কথা থাকে, আমাকে বলতে না চাস্‌, বলিস নে। কিন্তু এমন করে আমাকে তামাশা করিস নে।

 পার্ব্বতীও দুঃখিতা হইল, কহিল, ঠাট্টা করিনি দিদি। যতদূর নিজে জানি, ততদূর তোমাকেও বলেচি। আমি জানি, আমার স্বামীর নাম দেবদাস; বয়স উনিশ-কুড়ি—সেই কথাই তো তোমাকে বলেচি।

 কিন্তু এই যে শুনলুম, তোর আর-কোথায় সম্বন্ধ স্থির হয়েচে!

 স্থির আর কি! ঠাকুরমার সঙ্গে তো আর বিয়ে হবে না, হলে আমারই সঙ্গে হবে; আমি তো কৈ এ খবর শুনিনি!

 মনোরমা যাহা শুনিয়াছিল, তাহা এখন বলিতে গেল। পার্ব্বতী তাহাতে বাধা দিয়া বলিল, ও-সব শুনেচি।

 তবে? দেবদাস তোকে—

 কি আমাকে?

 মনোরমা হাসি চাপিয়া বলিল, তবে স্বয়ম্বরা বুঝি? লুকিয়ে লুকিয়ে পাকা বন্দোবস্ত করা হয়ে গেছে?

 কাঁচা-পাকা এখনও কিছুই হয়নি।

 মনোরমা ব্যথিত-স্বরে কহিল, তুই কি বলিস পারু, কিছুই তো বুঝতে পারিনে।

 পার্ব্বতী কহিল, তা হলে দেবদাসকে জিজ্ঞাসা করে তোমায় বুঝিয়ে দেব।

 কি জিজ্ঞাসা করবে? সে বিয়ে করবে কি না, তাই? পার্ব্বতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ, তাই।

 মনোরমা ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া কহিল, বলিস কি পারু? তুই নিজে একথা জিজ্ঞাসা করবি?

 দোষ কি দিদি?

 মনোরমা একেবারে অবাক হইয়া গেল—বলিস কি রে? নিজে?

 নিজেই। নইলে আমার হয়ে আর কে জিজ্ঞাসা করবে দিদি?

 লজ্জা করবে না?

 লজ্জা কি? তোমাকে বলতে লজ্জা করলুম?

 আমি মেয়েমানুষ—তোর সই, কিন্তু সে যে পুরুষমানুষ পারু।

 এবার পার্ব্বতী হাসিয়া উঠিল; কহিল, তুমি সই, তুমি আপনার—কিন্তু তিনি কি পর? যে কথা তোমাকে বলতে পারি, সে কথা কি তাঁকে বলা যায় না?

 মনোরমা অবাক হইয়া মুখপানে চাহিয়া রহিল।

 পার্ব্বতী হাসিমুখে কহিল, মনোদিদি, তুই মিছামিছি মাথায় সিঁদুর পরিস। কাকে স্বামী বলে তাই জানিস নে। তিনি আমার স্বামী না হলে, আমার সমস্ত লজ্জা-শরমের অতীত না হলে, আমি এমন করে মরতে বসতুম না। তা ছাড়া দিদি, মানুষ যখন মরতে বসে, তখন সে কি ভেবে দেখে, বিষটা তেতো কি মিষ্টি! তাঁর কাছে আমার কোন লজ্জা নেই।

 মনোরমা মুখপানে চাহিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পরে বলিল, তাঁকে কি বলবি? বলবি যে পায়ে স্থান দাও?

 পার্ব্বতী মাথা নাড়িয়া বলিল, ঠিক তাই বলবো দিদি।

 আর যদি সে স্থান না দেয়?

 এবার পার্ব্বতী বহুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পর কহিল, তখনকার কথা জানিনে দিদি।

 বাটী ফিরিবার সময় মনোরমা ভাবিল, ধন্য সাহস! ধন্য বুকের পাটা! আমি যদি মরেও যাই তো এমন কথা মুখে আনতে পারিনে।

 কথাটা সত্য। তাই তো পার্ব্বতী বলিয়াছিল, ইহারা অনর্থক মাথায় সিন্দূর পরে, হাতে নোয়া দেয়!

পোস্টটি শেয়ার করুন