দেবদাস – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বার
দুই ভাই দ্বিজদাস ও দেবদাস ও গ্রামের অনেকেই জমিদার নারায়ণ মুখুয্যের সৎকার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল। দ্বিজদাস চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া পাগলের মতো হইয়াছে—পাড়ার পাঁচজন তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিতেছে না। আর দেবদাস শান্তভাবে একটা থামের পার্শ্বে বসিয়া আছে। মুখে শব্দ নাই, চোখে এক ফোঁটা জল নাই। কেহ তাহাকে ধরিতেছে না—কেহ সান্ত্বনা দিবার প্রয়াস করিতেছে না। মধুসূদন ঘোষ নিকটে গিয়া একবার বলিতে গিয়াছিল,—তা বাবা কপালে—
দেবদাস হাত দিয়া দ্বিজদাসের দিকটা দেখাইয়া বলিল, ওখানে। ঘোষজা মহাশয় অপ্রতিভ হইয়া—হ্যাঁ, তা উনি—কত বড় লোক, ইত্যাদি বলিতে বলিতে চলিয়া গেল। আর কেহ নিকটে আসিল না। দ্বিপ্রহর অতীত হইলে দেবদাস অর্ধমূর্ছিত জননীর পদপ্রান্তে গিয়া উপবেশন করিল। সেখানে অনেকগুলি স্ত্রীলোক তাঁহাকে ঘিরিয়া বসিয়া আছে। পার্ব্বতীর পিতামহীও উপস্থিত ছিলেন। ভাঙ্গাগলায় সদ্যবিধবা শোকার্ত জননীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বউমা, চেয়ে দেখ মা, দেবদাস এসেচে। দেবদাস ডাকিল, মা।
তিনি একবারমাত্র চাহিয়া বলিলেন, বাবা! তাহার পর নিমীলিত চোখের
কোণ হইতে অজস্র অশ্রু বহিতে লাগিল। স্ত্রীলোকের দল কলস্বরে রৈ-রাই করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। দেবদাস জননীর চরণে কিছুক্ষণ মুখ ঢাকিয়া রহিল; তাহার পর ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল। গেল মৃত পিতার শয়নকক্ষে। চোখে জল নাই, গম্ভীর শান্তমূর্তি। রক্তনেত্র ঊর্ধ্বে স্থাপিত করিয়া ভূমিতলে বসিয়া পড়িল। যে-কেহ সে মূর্তি দেখিতে পাইলে বোধ করি ভীত হইত। কপালের দুই পার্শ্বে উভয় শিরা স্ফীত হইয়া রহিয়াছে, বড় বড় রুক্ষ কেশ ফুলিয়া উঠিয়াছে। তপ্তকাঞ্চনের বর্ণ কালিমাখা হইয়াছে—কলিকাতার জঘন্য অত্যাচারের পর এই দীর্ঘ রাত্রিজাগরণ, তাহার পর পিতার মৃত্যু! এক বৎসর পূর্বে যে-কেহ তাহাকে দেখিয়াছিল—এখন বোধ হয় তাহাকে হঠাৎ সে চিনিতে পারিত না। কিছুক্ষণের পর পার্ব্বতীর জননী সন্ধান করিয়া দ্বার ঠেলিয়া ভিতরে আসিলেন—দেবদাস!
কেন খুড়ীমা?
এমন করলে তো চলবে না বাবা!
দেবদাস তাঁহার মুখপানে চাহিয়া কহিল, কি করেচি খুড়ীমা?
খুড়ীমা তাহা বুঝিলেন, কিন্তু উত্তর দিতে পারিলেন না। দেবদাসের মাথাটা কোলের কাছে টানিয়া লইয়া বলিলেন,— দেব্তা—বাবা!
কেন খুড়ীমা?
দেবতা-চরণ—বাবা—
বুকের কাছে মুখ রাখিয়া দেবদাস এইবার এক ফোঁটা অশ্রুবিসর্জন করিল।
শোকার্ত্ত পরিবারেরও দিন কাটে। ক্রমে প্রভাত হইল, কান্নাকাটি অনেক কমিয়া আসিল। দ্বিজদাস একেবারে প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। তাঁহার জননীও উঠিয়া বসিয়াছেন,—চোখ মুছিতে মুছিতে দিনের কাজ করিতেছেন। দুইদিন পরে দ্বিজদাস দেবদাসকে ডাকিয়া কহিলেন, দেবদাস, পিতার শ্রাদ্ধকার্যে কত ব্যয় করা উচিত?
দেবদাস অগ্রজের মুখপানে চাহিয়া কহিল, যেমন উচিত বিবেচনা করেন।
না ভাই, এখন শুধু আমার বিবেচনায় চলবে না। তুমি বড় হয়েচ, তোমার মত জানা আবশ্যক। দেবদাস জিজ্ঞাসা করিল, কত নগদ টাকা আছে?
বাবার তবিলে দেড় লাখ টাকা জমা আছে। আমার বিবেচনায় হাজার-দশেক টাকা খরচ করলেই যথেষ্ট হবে—কি বল?
আমি কত পাব?
দ্বিজদাস একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, তা তুমিও অর্ধেক পাবে। দশ হাজার খরচ হলে, তোমার সত্তর হাজার ও আমার সত্তর হাজার থাকবে।
মা কি পাবেন?
মা নগদ টাকা কি করবেন? তিনি বাটীর গিন্নী—আমরা প্রতিপালন করব।
দেবদাস একটু চিন্তা করিয়া বলিল, আমার বিবেচনায়, আপনার ভাগের পাঁচ হাজার টাকা খরচ হোক এবং আমার ভাগের পঁচিশ হাজার টাকা খরচ হবে। বাকি পঞ্চাশ হাজারের মধ্যে আমি পঁচিশ হাজার নেব, বাকি পঁচিশ হাজার টাকা মায়ের নামে জমা থাকবে। আপনার কি বিবেচনা হয়?
প্রথমে দ্বিজদাস যেন লজ্জিত হইলেন; পরে কহিলেন, উত্তম কথা। কিন্তু আমার, কি জান,—স্ত্রী, পুত্র, কন্যা আছে; তাদের বিয়ে, পৈতা দেওয়া,—অনেক খরচ। তা এই পরামর্শই ভাল। একটু থামিয়া বলিলেন, তা একটু লিখে দিলেই—লেখাপড়ার প্রয়োজন হবে কি? কাজটা ভাল দেখাবে না। আমার ইচ্ছা, টাকাকড়ির কথা—এ সময়ে গোপনেই হয়।
তা ভাল কথা; কিন্তু কি জানো ভাই—
আচ্ছা, আমি লিখেই দিচ্চি। সেইদিনই দেবদাস লেখাপড়া করিয়া দিল।
পরদিন দ্বিপ্রহরে দেবদাস নীচে নামিতেছিল, সিঁড়ির পার্শ্বে পার্ব্বতীকে দেখিতে পাইয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। পার্ব্বতী মুখপানে চাহিয়াছিল—চিনিতে যেন তাহার ক্লেশ হইতেছিল। দেবদাস গম্ভীর শান্তমুখে কাছে আসিয়া কহিল, কখন এলে পার্ব্বতী?
সেই কণ্ঠস্বর! আজ তিন বৎসর পরে দেখা। অধোমুখে পার্ব্বতী কহিল—সকালবেলা এসেচি।
অনেকদিন দেখা হয়নি। বেশ ভাল ছিলে? পার্ব্বতী মাথা নাড়িল।
চৌধুরীমশায় ভাল আছেন? ছেলেমেয়েরা সব ভাল?
সব ভাল। পার্ব্বতী একটিবার মুখপানে চাহিয়া দেখিল। কিন্তু একটিবার জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না, তিনি কেমন আছেন—কি করিতেছেন। এখন যে কোন প্রশ্নই খাটে না।
দেবদাস কহিল, এখন কিছুদিন আছ তো?
হ্যাঁ।
তবে আর কি—বলিয়া দেবদাস বাহিরে চলিয়া গেল।
শ্রাদ্ধ শেষ হইয়া গেছে। সে কথা বলিতে গেলে অনেক লিখিতে হয়, তাই তাহাতে প্রয়োজন নাই। শ্রাদ্ধের পরদিবস পার্ব্বতী ধর্ম্মদাসকে নিভৃতে ডাকিয়া তাহার হাতে একগাছা সোনার হার দিয়া কহিল, ধর্ম্ম, তোমার মেয়েকে পরতে দিয়ো—
ধর্ম্মদাস মুখপানে চাহিয়া আর্দ্র চক্ষু আরো আর্দ্র করিয়া বলিল, আহা, তোমাকে কতদিন দেখিনি; সব ভাল খবর তো দিদি?
সব ভাল। তোমার ছেলেমেয়ে ভাল আছে?
তা আছে পারু।
তুমি ভাল আছ?
এইবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ধর্ম্মদাস কহিল, কৈ আর ভাল! এইবার যেতে ইচ্ছে করে—কর্তা গেলেন। ধর্ম্মদাস শোকের আবেগে কত কি হয়ত কহিত, কিন্তু তাহাতে পার্ব্বতী বাধা দিল। এ-সব সংবাদ শুনিবার জন্য সে হার দেয় নাই।
পার্ব্বতী কহিয়া উঠিল, সে কি কথা ধর্ম্ম, তুমি গেলে দেবদাদাকে দেখবে কে?
ধর্ম্মদাস কপালে করাঘাত করিয়া কহিল, যখন ছেলেমানুষটি ছিল, তখন দেখেচি। এখন না দেখতে হলেই বাঁচি, পারু।
পার্ব্বতী আরো নিকটে সরিয়া আসিয়া কহিল, ধর্ম্মদাস, একটি কথা সত্য বলবে?
কেন বলব না দিদি!
তবে সত্যি করে বল, দেবদা এখন কি করে? করে আমার মাথা আর মুণ্ডু।
ধর্ম্মদাস, খুলে বল না?
ধর্ম্মদাস পুনরায় কপালে করাঘাত করিয়া বলিল, খুলে আর কি বলব দিদি! এ কি আর বলবার কথা! এবারে কর্তা নাই, দেব্তার হাতে অগাধ টাকা হল; এবারে কি আর রক্ষা থাকবে?
পার্ব্বতী মুখ একেবারে ম্লান হইয়া গেল। সে আভাসে-ইঙ্গিতে কিছু কিছু শুনিয়াছিল। শুষ্ক হইয়া কহিল, বল কি ধর্ম্মদাস? সে মনোরমার পত্রে যখন কতক শুনিয়াছিল, তখন বিশ্বাস করিতে পারে নাই। ধর্ম্মদাস মাথা নাড়িয়া কহিতে লাগিল—আহার নাই, নিদ্রা নাই, শুধু বোতল বোতল মদ। তিনদিন, চারদিন ধরে কোথায় পড়ে থাকে—ঠিকানা নাই। কত টাকা উড়িয়ে দিলে,—শুনতে পাই, কত হাজার টাকার নাকি তাকে গয়না গড়িয়ে দিয়েচে।
পার্ব্বতী আপাদমস্তক কাঁপিয়া উঠিল—ধর্ম্মদাস, এ-সব সত্যি?
ধর্ম্মদাস নিজের মনে কহিতে লাগিল,—তোর কথা হয়ত শুনতে পারে—একবার বারণ করে দে। কি শরীর কি হয়ে গেল—এমনধারা অত্যাচারে ক’টা দিন বা বাঁচবে? কাকেই বা এ কথা বলি? মা, বাপ, ভাই—এদের এ কথা বলা যায় না। ধর্ম্মদাস শিরে পুনঃপুনঃ করাঘাত করিয়া বলিয়া উঠিল, ইচ্ছে করে, মাথা খুঁড়ে মরি পারু, আর বাঁচতে সাধ নেই।
পার্ব্বতী উঠিয়া গেল। নারাণবাবুর মৃত্যু-সংবাদ পাইয়া সে ছুটিয়া আসিয়াছিল। ভাবিয়াছিল, এ বিপদের সময় দেবদাসের কাছে যাওয়া একবার উচিত। কিন্তু, তাহার এত সাধের দেবদাদা এই হইয়াছে! কত কথাই যে মনে পড়িতে লাগিল, তাহার অবধি নাই। যত ধিক্কার সে দেবদাসকে দিল, তাহার সহস্রগুণ আপনাকে দিল; সহস্রবার তাহার মনে হইল, সে থাকিলে কি এমন হইতে পারিত? আগেই সে নিজের পায়ে নিজে কুঠার মারিয়াছিল, কিন্তু, সে কুঠার এখন তাহার মাথায় পড়িল। তাহার দেবদাদা এমন হইয়া যাইতেছে—এমন করিয়া নষ্ট হইতেছে, আর সে পরের সংসার ভাল করিবার জন্য বিব্রত! পরকে আপনার ভাবিয়া সে নিত্য অন্ন বিতরণ করিতেছে, আর তাহার সর্বস্ব,—আজ অনাহারে মরিতেছে! পার্ব্বতী প্রতিজ্ঞা করিল, আজ সে দেবদাসের পায়ে মাথা খুঁড়িয়া মরিবে!
এখনও সন্ধ্যা হইতে কিছু বিলম্ব আছে,—পার্ব্বতী দেবদাসের ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। দেবদাস শয্যায় বসিয়া হিসাব দেখিতেছিল, চাহিয়া দেখিল। পার্ব্বতী ধীরে ধীরে কপাট বন্ধ করিয়া মেঝের উপর বসিল। দেবদাস মুখ তুলিয়া হাসিল। তাহার মুখ বিষণ্ণ, কিন্তু শান্ত। হঠাৎ কৌতুক করিয়া কহিল, যদি অপবাদ দিই?
পার্ব্বতী সলজ্জ, নীলোৎপল চক্ষু দুটি একবার তাহার পানে রাখিয়া, পরক্ষণেই অবনত করিল। মুহূর্তে বুঝাইয়া দিল, এ কথা তাহার বুকের মাঝে চিরদিনের জন্য শেলের মতো বিঁধিয়া আছে। আর কেন? কত কথা বলিতে আসিয়াছিল, সব ভুলিয়া গেল। দেবদাসের কাছে সে কথা কহিতে পারে না।
আবার দেবদাস হাসিয়া উঠিল; কহিল, বুঝেচি রে, বুঝেচি! লজ্জা হচ্ছে, না?
তবুও পার্ব্বতী কথা কহিতে পারিল না। দেবদাস কহিতে লাগিল, তাতে আর লজ্জা কি? দু’জনে মিলেমিশে একটা ছেলেমানুষী করে ফেলে—এই দেখ্ দেখি——মাঝে থেকে কি গোলমাল হয়ে গেল। রাগ করে তুই যা ইচ্ছে তাই বললি; আমিও কপালের ওপর ঐ দাগ দিয়ে দিলাম। কেমন হয়েচে!
দেবদাসের কথার ভিতর শ্লেষ বা বিদ্রূপের লেশমাত্র ছিল না; প্রসন্ন হাসি-হাসি মুখে অতীতের দুঃখের কাহিনী। পার্ব্বতীর কিন্তু বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। মুখে কাপড় দিয়া, নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া মনে মনে বলিল, দেবদাদা, ঐ দাগই আমার সান্ত্বনা, ঐ আমার সম্বল। তুমি আমাকে ভালবাসিতে—তাই দয়া করে, আমাদের বাল্য-ইতিহাস ললাটে লিখে দিয়েচ। ও আমার লজ্জা নয়, কলঙ্ক নয়, আমার গৌরবের সামগ্রী।
পারু!
মুখ হইতে অঞ্চল না খুলিয়া পার্ব্বতী কহিল, কি?
তোর উপর আমার বড় রাগ হয়—
এইবার দেবদাসের কণ্ঠস্বর বিকৃত হইতে লাগিল—বাবা নাই, আজ আমার কি দুঃখের দিন; কিন্তু তুই থাকলে কি ভাবনা ছিল! বড়বৌকে জানিস ত, দাদার স্বভাবও কিছু তোর কাছে লুকানো নেই; বল্ দেখি, মাকে নিয়ে এ সময়ে কি করি! আর আমারই বা যে কি হবে, কিছুই বুঝে পাই না। তুই থাকলে নিশ্চিন্ত হয়ে—সব তোর হাতে ফেলে দিয়ে—ও কি রে পারু!
পার্ব্বতী ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। দেবদাস কহিল, কাঁদছিস বুঝি? তবে আর বলা হল না।
পার্ব্বতী চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, বল।
দেবদাস মুহূর্তে কণ্ঠস্বর পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিল, পারু, তুই নাকি খুব পাকা গিন্নী হয়েচিস রে?
ভিতরে ভিতরে পার্ব্বতী চাপিয়া অধর দংশন করিল; মনে মনে বলিল, ছাই গৃহিণী! শিমুলফুল দেবসেবায় লাগে কি?
দেবদাস হাসিয়া উঠিল; হাসিয়া কহিল—বড় হাসি পায়! ছিলি তুই এতটুকু—কত বড় হলি। বড় বাড়ি, বড় জমিদারি, বড় বড় ছেলেমেয়ে—আর চৌধুরীমশাই, সবাই বড়—কি রে পারু!
চৌধুরীমশাই পার্ব্বতীর বড় আমোদের জিনিস; তাঁকে মনে হইলেই তাহার হাসি পাইত। এত কষ্টেও তাই তার হাসি আসিল।
দেবদাস কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সহিত কহিল, একটা উপকার করতে পারিস?
পার্ব্বতী মুখ তুলিয়া কহিল, কি?
তোদের দেশে ভাল মেয়ে পাওয়া যায়?
পার্ব্বতী ঢোক গিলিয়া, কাশিয়া বলিল—ভাল মেয়ে? কি করবে?
পেলে বিয়ে করি। একবার সংসারী হতে সাধ হয়।
পার্ব্বতী ভালমানুষটির মতো কহিল, খুব সুন্দরী তো?
হাঁ, তোর মতো।
আর খুব ভালমানুষ?
না, খুব ভালমানুষে কাজ নেই—বরং একটু দুষ্টু,—তোর মতো আমার সঙ্গে যে ঝগড়া করতে পারবে।
পার্ব্বতী মনে মনে কহিল, সে তো কেউ পারবে না দেবদাদা; কেননা তাতে আমার মতো ভালবাসতে পারা চাই। মুখে কহিল, পোড়ার মুখ আমার, আমার মতো কত হাজার তোমার পায়ে আসতে পেলে ধন্য হয়।
দেবদাস কৌতুক করিয়া হাসিয়া বলিল, একটি আপাততঃ দিতে পারিস দিদি?
দেবদাদা, সত্যি বিয়ে করবে?
এই যে বললাম। শুধু এইটি সে খুলিয়া বলিল না যে, তাকে ভিন্ন এ জীবনে অন্য স্ত্রীলোকে তার প্রবৃত্তি হইবে না।
দেবদাদা, একটি কথা বলব?
কি?
পার্ব্বতী আপনাকে একটু সামলাইয়া লইয়া কহিল, তুমি মদ খেতে শিখলে কেন?
দেবদাস হাসিয়া উঠিল; কহিল, খেতে কি কোন জিনিস শিখতে হয়?
তা নয়, অভ্যাস করলে কেন?
কে বলেচে, ধর্ম্মদাস?
যেই বলুক, কথাটা কি সত্যি?
দেবদাস প্রতারণা করিল না; কহিল, কতকটা বটে।
পার্ব্বতী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আর কত হাজার টাকার গয়না গড়িয়ে দিয়েচ, না?
দেবদাস হাসিয়া কহিল, দিইনি, গড়িয়ে রেখেচি। তুই নিবি?
পার্ব্বতী হাত পাতিয়া বলিল, দাও। এই দেখ, আমার একটিও গয়না নেই।
চৌধুরীমশাই তোকে দেননি?
দিয়েছিলেন; আমি সমস্ত তাঁর বড়মেয়েকে দিয়ে দিয়েচি।
তোর বুঝি দরকার নেই?
পার্ব্বতী মাথা নাড়িয়া মুখ নিচু করিল।
এইবার সত্যই দেবদাসের চোখে জল আসিতেছিল। দেবদাস অন্তরে বুঝিতে পারিয়াছিল, কম দুঃখে আর স্ত্রীলোকে নিজের গহনা খুলিয়া বিলাইয়া দেয় না। কিন্তু চোখের জল চাপিয়া ধীরে ধীরে বলিল, মিছে কথা, পারু। কোন স্ত্রীলোককেই আমি ভালবাসিনি, কাউকেই গয়না দিইনি।
পার্ব্বতী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে কহিল, তাই আমি বিশ্বাস করি।
অনেকক্ষণ দুইজনেই চুপ করিয়া রহিল। তাহার পর পার্ব্বতী কহিল, কিন্তু, প্রতিজ্ঞা কর—আর মদ খাবে না!
তা পারিনে। তুমি কি প্রতিজ্ঞা করতে পার, আমাকে আর একটিবারও মনে করবে না? পার্ব্বতী কথা কহিল না। এই সময়ে বাহিরে সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি হইল। দেবদাস চকিত হইয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া কহিল, সন্ধ্যা হল, এখন বাড়ি যা পারু!
আমি যাব না। তুমি প্রতিজ্ঞা কর।
আমি পারিনে।
কেন পার না?
সবাই কি সব কাজ পারে?
ইচ্ছে করলে নিশ্চয় পারে।
তুমি আজ রাত্রে আমার সঙ্গে পালিয়ে যেতে পার?
পার্ব্বতীর সহসা যেন হৃৎস্পন্দন রুদ্ধ হইয়া গেল। অজ্ঞাতসারে অস্ফুটে মুখ দিয়া বাহির হইয়া গেল, তা কি হয়?
দেবদাস শয্যার উপর একটু সরিয়া বসিয়া কহিল, পার্ব্বতী, দোর খুলে দাও।
পার্ব্বতী সরিয়া আসিয়া, দ্বারে পিঠ দিয়া ভাল করিয়া বসিয়া বলিল, প্রতিজ্ঞা কর!
দেবদাস উঠিয়া দাঁড়াইয়া ধীরভাবে কহিতে লাগিল— পারু, জোর করিয়ে প্রতিজ্ঞা করানটা কি ভাল, না, তাতে বিশেষ লাভ আছে? আজকার প্রতিজ্ঞা কাল হয়ত থাকবে না— কেন আমাকে আর মিথ্যাবাদী করবি?
আবার বহুক্ষণ নিঃশব্দে অতিবাহিত হইল। এমনি সময়ে কোথায় কোন্ ঘরের ঘড়িতে টং টং করিয়া নয়টা বাজিয়া গেল। দেবদাস ব্যস্ত হইয়া পড়িল; কহিল, ওরে পারু, দোর খুলে দে—
পার্ব্বতী কথা কহে না।
ও পারু—
আমি কিছুতেই যাব না, বলিয়া পার্ব্বতী অকস্মাৎ রুদ্ধ—আবেগে সেইখানেই লুটাইয়া পড়িল—বহুক্ষণ ধরিয়া বড় কান্না কাঁদিতে লাগিল। ঘরের ভিতর এখন গাঢ় অন্ধকার—কিছুই দেখা যায় না। দেবদাস শুধু অনুমান করিয়া বুঝিল, পার্ব্বতী মাটিতে পড়িয়া কাঁদিতেছে। ধীরে ধীরে ডাকিল—পারু!
পার্ব্বতী কাঁদিয়া উত্তর দিল, দেবদা, আমার যে বড় কষ্ট!
দেবদাস কাছে সরিয়া আসিল। তাহার চক্ষেও জল—কিন্তু, স্বর বিকৃত হইতে পায় নাই। কহিল, তা কি আর জানিনে রে? দেবদা, আমি যে মরে যাচ্ছি। কখনো তোমার সেবা করতে পেলাম না—আমার যে আজন্মের সাধ—
অন্ধকারে চোখ মুছিয়া দেবদাস কহিল—তারও তো সময় আছে।
তবে আমার কাছে চল; এখানে তোমাকে দেখবার যে কেউ নেই!
তোর বাড়ি গেলে খুব যত্ন করবি?
আমার ছেলেবেলার সাধ! স্বর্গের ঠাকুর! আমার এ সাধটি পূর্ণ করে দাও! তারপর মরি—তাতেও দুঃখ নেই।
এবার দেবদাসের চোখেও জল আসিয়া পড়িল।
পার্ব্বতী পুনরায় কহিল, দেবদা, আমার বাড়ি চল।
দেবদাস চোখ মুছিয়া বলিল, আচ্ছা যাব।
আমাকে ছুঁয়ে বল, যাবে?
দেবদাস অনুমান করিয়া পার্ব্বতীর পদপ্রান্ত স্পর্শ করিয়া বলিল, এ কথা কখনও ভুলব না। আমাকে যত্ন করলে যদি—তোমার দুঃখ ঘোচে—আমি যাব। মরবার আগেও আমার এ কথা স্মরণ থাকবে।