কতটা জমি দরকার – লিও টলস্টয়
নয়
কোনােদিকে না তাকিয়ে পাখম সােজা পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলেছে-কিন্তু হাঁটতে বড় কষ্ট পাচ্ছে সে। একে তাে ভীষণ গরম, তারপর খালিপায়ে হাঁটতে গিয়ে নানা জিনিশের সঙ্গে হোঁচট খেতে-খেতে কেটে-ছিড়ে খুবই যন্ত্রণা করছে। পা দুটো যেন আর দেহের ভার বইতে পারছে না। একটু বিশ্রাম করতে দারুণ ইচ্ছে তার অথচ সামান্য বিশ্রাম নিলেও পাখম সূর্য ডােবার আগে পাহাড়ে পৌছাতে পারবে না। সূর্য কারাে মুখ চেয়ে দাড়িয়ে থাকে না। ডুববার সময় হলে সে ডুবতেই থাকে।
পাখমের মনে হতে লাগল, কে যেন গাড়ির চালকের মতাে তাকে চাবুক মেরে মেরে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। টলতে টলতে সে এগুতে লাগল।
মনে তার ভাবনা এল, তবে কি হিশেবে আমার কোনও ভুল হয়ে গেছে! এখনাে কত পথ পড়ে রয়েছে, অথচ শরীর মরে যাচ্ছে। তবে কি আমার সব অর্থ, পরিশ্রম, আকাক্ষা বৃথা হবে? হায় ঈশ্বর! বেশি করে জমি নিতে চেয়ে কী ভুলই না করেছি আমি। এখন পাহাড়ে পৌঁছতে দেরি হলে আমার কী উপায় হবে ?
পাখম একবার তাকায় সূর্যের দিকে, একবার পাহাড়ের দিকে। এখনাে অনেক দূরে পড়ে আছে সে। মনে একটু জোর তৈরি করে সে দৌড়াতে শুরু করল। পা ছিড়ে রক্ত ঝরছে তবু সে দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে, প্রাণপণ শক্তিতে সে দৌড়াচ্ছে। গায়ের কোট জামা জুতাে খুলে সে ছুড়ে ফেলে দিল। ফেলে দিল পানির বােতল এবং মাথার টুপি। ‘হায়, সবকিছু দেখে আমি কত খুশিই না হয়েছিলাম। এখন বেশি পেতে চেয়ে সবই যে হারালাম! সূর্যাস্তের আগে কিছুতেই আমি পৌছাতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। হায়, হায় আমার কী উপায় হবে?
দারুণরকম ভয় পাওয়ার ফলে তার দমও ফুরিয়ে গেল। তবু হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়াল পাখম। তার জামা-পাজামা ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে সেঁটে গেছে। মুখের ভেতরটা গেছে শুকিয়ে। কে যেন বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে। পা দুটো আর একেবারেই দেহের ভার সইছে না, মনে হচ্ছে ওদুটো তার নিজের পা নয়। মনে হচ্ছে, মৃত্যু যেন ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু মৃত্যু ঘনিয়ে এলেও তাে পাখমের উপায় নেই। এতদূর এসে থামলে সবাই তাকে বােকা বলবে!
অতএব দৌড়ানাে দরকার। পাখম দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে পাখম হঠাং বাসকিরদের চিৎকার শুনতে পেল। ওদের চিৎকার শুনে পাখমের শরীর উত্তেজিত হয়ে উঠল। শেষ শক্তিটুকু একত্র করে সে দৌড়াতে থাকে সামনে -আরাে সামনে!
সূর্য তখন অনেক নেমে গেছে। আর তার রং হয়েছে টকটকে লাল।
সূর্য যেমন ডুববে-ডুববে করছে—পাহাড়টাও তেমনি অনেক কাছে এসে গেছে। দেখতে পেল পাখ-পাহাড়ের উপর থেকে লােকজন হাত নেড়ে নেড়ে তাকে ডাকছে। তাকে অভ্যর্থনা দেয়ার জন্য সবাই উত্তেজিতভাবে আনন্দ প্রকাশ করছে। মাটিতে দেখতে পেল সেই টুপি। টুপির পাশেই সর্দার বসে আছেন। হঠাৎ পাখমের মনে পড়ে গেল সেই স্বপ্নের কথা।
পাখম ভাবল, অন্তত এখন আর আমার জমির অভাব নেই। কিন্তু ঈশ্বর কি আমাকে জমি ভােগ করার সুযােগ দেবেন? আমি-যে আর একটুও পারছি না।
পাখম শেষবারের মতাে তাকাল সূর্যের দিকে। প্রকাণ্ড বড় সূর্যটা মাটি স্পর্শ করেছে বলে মনে হল। সুর্যের নিচের দিকে অনেকখানি ডুবে গেছে এরি মধ্যে। সে সামনের দিকে ঝুঁকে ছুটতে লাগল। পাহাড়ে গিয়ে পৌছাতেই সব যেন আঁধার হয়ে গেল। সূর্য ডুবে গেছে! পাখম এবার চিৎকার করে উঠল, আহ আমার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল।
গভীর হতাশায় সে থামতে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে পড়ল, নিচ থেকে যদিও তার মনে হচ্ছে সূর্য ডুবে গেছে কিন্তু পাহাড়ের উঁচুতে যারা রয়েছে তাদের কাছে সূর্য হয়তাে এখনাে অস্ত যায়নি। সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে পাহাড়টাকে আঁকড়ে ধরে উপরে উঠতেই পাখম দেখতে পেল টুপিটাকে। সর্দার বসে আছেন টুপির সামনে। তিনি কোমরে দুহাত রেখে তেমনি হাসছেন। দেখেই আবার সেই স্বপ্নের কথা পাখমের মনে পড়ল। চিৎকার করে উঠল পাখম। পাদুটো তার একেবারে অবশ হয়ে গেছে। হঠাৎ সে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। পড়তে পড়তেও একবার দুহাত বাড়িয়ে দিল টুপিটার দিকে—টুপিটা সে ছুঁতে পেরেছে!
তখনি সর্দার চিৎকার করে উঠলেন, ‘শাবাশ বেটা, অনেক জমি তুমি পেয়েছ!’ পাখমের চাকর-ছেলেটা দৌড়ে এল। মনিবকে তুলতে চেষ্টা করল। পাখমকে কিছুতেই ওঠানাে গেল না। সে দেখল পাখমের মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরে পড়ছে। পাখম মরে গেছে!
ভয়ে চিৎকার করে উঠল চাকর-ছেলেটা। তখনাে সর্দার মাটিতে বসে, দুহাত বুলিয়ে আগের মতােই হাসছিলেন। অন্য বাসকিরদের চোখেমুখে বিষাদের ছায়া।
খানিক পরেই সর্দার উঠে দাড়িয়ে বললেন, ‘ওকে কবর দাও।’ পাখমের চাকর কোদাল তুলে নিয়ে একটা কবর খুঁড়ল। আর তাকে শুইয়ে দেয়া হল সেই কবরে। পাখমের মাথা থেকে পা অবধি কবরে শােয়াতে প্রয়ােজন হল মাত্র ছ-ফুট জমি !