কতটা জমি দরকার – লিও টলস্টয়

তিন

এভাবে পাখমের দিনকাল বেশ সুখেই কাটছিল। আর কাটতও চিরকাল যদি-না চারদিকের কৃষকেরা তার উপর উৎপাত শুরু না করত। মেষপালকের মেষের দল ঢুকে পড়ে তার বাগানে, রাতের বেলায় তাদের ঘােড়া ফসলের ক্ষেতে ঢুকে নষ্ট করে পাখমের সােনার ফসল। কতবার সে তাদের শান্তভাবে সাবধান হতে বলেছে। কিন্তু কে শােনে কার কথা। একসময় তার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল। পাখম জেলা আদালতে গিয়ে নালিশ দিয়ে এল। সে জানত, ছােট চাষীরা জমির অভাবেই এ কাজ করে, তার ক্ষতি করবার জন্য নয়। কিন্তু কতদিন আর এই অবস্থা চলতে দেয়া যায়। মাঠের ফসল খেয়ে ওরা-যে সব তছনছ করে দিল। একটা শিক্ষা অন্তত রাখালদের দেয়া উচিত।

এই ভেবে সে প্রথমে তাদের একজনের বিরুদ্ধে কোটে নালিশ দিয়ে এল। জরিমানা হল তার। তারপর আরাে একজনের জরিমানা দিতে হল। কিন্তু ফল হল উল্টো। সবাই পাখমের উপর চটে গেল এবং প্রতিবেশীরা এবার ইচ্ছে করেই তার ফসল চুরি করতে আরম্ভ করল। একরাত্রে কে যেন বাগানে ঢুকে প্রায় দশটার মতাে লিন্ডেন গাছ গােড়াসুদ্ধ উপড়ে রেখে চলে গেল। পরদিন বাগানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ব্যাপারটা দেখে কালাে হয়ে গেল পাখমের মুখ। আরাে কাছে গিয়ে দেখে, একটা ঝােপের সবকটা গাছ শেকড়-সমেত উপড়ানাে, একটা গাছ যদিওবা খাড়া হয়ে আছে কিন্তু তার সব ডালপালা ছাঁটা। পাখম তাে রেগে আগুন। সে মনে মনে বলল, উহ্! যদি জানতে পারতাম কে এ কাজ করেছে একবার দেখে নিতাম তাকে।

সেই থেকে পাখম ভাবতে লাগল, লােকটা কে হতে পারে। একসময় তার মনে পড়ল সাইমনের কথা। সাইমন ছাড়া এ-কাজ কেউ করতে পারে না। তখন সে গেল সাইমনের কাছে কিন্তু গাছের কোনও চিহ্ন তার বাড়িতে পাওয়া গেল না। বৃথাই ঝগড়া করে পাখম ফিরে এল। ঘরে এসে তার স্পষ্ট ধারণা জন্মাল যে এ কাজ সাইমনেরই। তার বিরুদ্ধে পাখম মামলা ঠুকে দিল।

বিচার হল, কিন্তু সাইমনের বিরুদ্ধে সঠিক প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গেল সে। ফলে আরাে রেগে গেল পাখম। তার মনে হল সবাই মিলে পাখমের ওপর অবিচার করতে শুরু করেছে। ভয়ানক রেগে সে হাকিমকে বলল, “বাবুরা, আপনাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই চোরদের যােগসাজশ আছে। নইলে কখ্খনাে এভাবে সাইমনকে ছেড়ে দিতে পারতেন না।”

এভাবে হাকিম থেকে শুরু করে আশপাশের সবার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে পাখম একা একা নিজের জমিতে বাস করতে লাগল। আগে সবাই তাকে ভালােবাসত। এখন সে অনেক জমির মালিক। তবু মানুষ আগের মতাে তাকে আর ভালােবাসে না।

সেইসময় চারদিকে শােনা গেল, অনেক চাষী রাশিয়ার এই অঞ্চল ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে। পাখম ভাবল, জমি ফেলে আমার কোথাও যাবার দরকার নেই। যদি অন্যেরা যায়, ভালােই তাে, আমার আরাে জমি হবে। তাদের জমিগুলাে আমি কিনে নিতে পারব। তখন চারদিকে সবই হবে আমার জমি। আমি আরাে আরামে থাকতে পারব। এতটুকু জমির মধ্যে বড় আঁটাআঁটিতে বাস করতে হচ্ছে আমাকে।

বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। পাখম তখন বাড়িতে, এমন সময় একজন পথিক কৃষক এসে হাজির হল। কৃষকটির বাড়ি অন্য গ্রামে। পাখম তাকে রাতের জন্য আশ্রয় দিল, খেতেও দিল। রাত্রে তার সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছিল। পাখম জিজ্ঞেস করল, সে কোথেকে এসেছে? জবাবে লােকটি বলল, “আমি এসেছি ভলগা নদীর ওপার থেকে। সেখানে আমি কাজ করি।”

লােকটা আবার বলল, ‘সেখানে নতুন একটি বসতি গড়ে উঠছে। যেকেউ গিয়ে সমিতিতে নাম লেখালেই তাকে ওরা বিশ একর করে জমি দিচ্ছে। আর সে-জমিও এত ভালাে যে ফসল বুনতে-না-বুনতেই তা ঘােড়ার মতাে বড় হয়ে ওঠে। একবার এক গরিব চাষী সেখানে গেল, সে এত গরিব যে খেটে খাবার দু-খান হাত ছাড়া তার আর কোনাে সম্বল ছিল না। অথচ এবার সে একশাে একর জমিতে শুধু গমই ফলিয়েছে। গত একবছরে একমাত্র গম বেচেই লােকটি পাঁচহাজার রুবল পেয়েছে।’

শুনে পাখমের মন উতলা হয়ে উঠল। ভাবল, এমন আয়-রােজগার যদি সেখানে করতে পারি, তাহলে এখানে এমন গরিবের মতাে কুঁকড়ে পড়ে থাকি কেন? জমি বাড়ি সব বিক্রি করে আমিও সেই দেশে যাব। সেখানে নতুন বাড়ি বানাব, আর চাষের জমি করব অনেক। এখানে তাে দুঃখকষ্ট লেগেই আছে। অবশ্য জায়গা-জমি বেচার আগে সেই জায়গাটা দেখে আসতে হবে আমাকে।

একটু-একটু গরম পড়তেই পাখম সেই নতুন দেশ দেখতে বেরিয়ে পড়ল। প্রথমে জাহাজে চড়ে ভলগা নদী দিয়ে সে পৌছুল সামারা অঞ্চলে। তারপর সেখান থেকে তিনশাে মাইল পথ পায়ে হেঁটে পাখম পৌছুল সেই নতুন দেশে।

লােকটি যা বলেছিল তার সবই সত্যি। সমিতি প্রত্যেককে বিশ একর করে জমি বিলি করছে। সেজমিও অতি চমৎকার। সমিতি তাকে আরাে খবর দিল যে বিশ একর জমি ছাড়াও কেউ ইচ্ছা করলে অল্পদামে যত খুশি জমি কিনতে পারে। জমির দাম একরপ্রতি মাত্র তিন রুবল।

সবকিছু জেনে পাখম বাড়ি ফিরে এল হেমন্তকালে। এসেই সব বিক্রি শুরু করল। জমি, বাড়ি, ফসল সবই পাখম ভালাে দামে বেচতে পারল। তারপর বসন্তকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে একদিন সবাইকে নিয়ে নতুন দেশে রওনা হয়ে গেল।

পোস্টটি শেয়ার করুন