উনিশ শ’ একাত্তর – ইমদাদুল হক মিলন

সুবলদের বাড়িতে বিশাল তিনটা ঘর। বাড়ির পেছনে ফলফলারির গহীন বাগান। একটা বাঁধানো পুকুর। তার উপর কাছে পিঠে কোনো বাড়ি নেই। এই রকম একটা বাড়িতে দীনু একলা। সারাদিন কিছু খায়নি। তবুও খিদে টের পায় না। চোখ বন্ধ করে খোলা জানালার পাশে পড়ে থাকে দীনু।

শেষরাতে একটুখানি চাঁদ উঠেছিল বলে, জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না এসে ঘরে ঢুকেছিল বলে রক্ষে। রাতটা দীনুর কেটে যায়। নয়তো কি যে হতো, দীনু হয় তো সেদিন….

পরদিন বাজারে গিয়ে জমির চাচাকে ধরে দীনু। জমির বাজারের কোণে বসে ভিক্ষে করে। ভালো মানুষ। তবুও লোকে বলে জমির পাগলা। দীনু ডাকে জমির চাচা।

সেই জমির চাচাকে পটিয়ে এলো দীনু। তোমার তো কোথাও থাকার জায়গা নেই, আজ থেকে তুমি আমার সঙ্গে সুবলদের বাংলাঘরে থাকবে। সুবলেরা কেউ বাড়ি নেই। আমি এখন সুবলদের বাড়ির মালিক।

সুবলদের চলে যাওয়ার কথা, দেশে গন্ডগোল, মিলিটারিদের কথা আর সুবলের দিদিমার মুখে শোনা স্বাধীনতার কথা সবই জমির চাচাকে বলে দীনু। জমির চাচা চমৎকার লোক। দীনুর কথায় রাজি না হয়ে কী পারে।

সেই থেকে জমির চাচা আর দীনু। দুজনে সুবলদের বাংলা ঘরে থাকে। রাতের বেলা, দিনের বেলাটা দীনুর কাটে এ বাড়ি ও বাড়ি করে।

জমির চাচা থাকে বাজারে। সুবলের দিদিমা বলে গিয়েছিলেন, ‘ঘরে চাল ডাল সব আছে। রান্না করে খাস দীনু। তোর ছয় মাস যাবে।’

কিন্তু দীনু বড় ঘরটা খোলেনি। দীনু রান্না করতে জানে না। চাল ডাল তেমনি আছে। আজ দুমাস। কিন্তু আজই আবার দীনুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল।

দুপুরের দিকে দশ দিন পরে রোদ উঠেছে দেখে দীনুর খুব ফুর্তি। লাফাতে লাফাতে গেছে খোকনদের বাড়ি। খোকনকে নিয়ে আজ খালের জলে খুব সাঁতার কাটবে ভেবেছে। কিন্তু খোকনদের বাড়ি গিয়েই মনটা খারাপ হয়ে গেল।

খোকনদের বাড়িতে কেমন একটা সাজ সাজ রব। খোকনের সব ভাইবোন জামাকাপড় পরে ছুটোছুটি করছে। খোকনের মা এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছেন, একে এক কথা বলছেন ওকে আরেক কথা। খোকনদের বাড়ির সঙ্গেই খাল, সেখানে একটা বড় ছইঅলা নৌকা বাঁধা। মাঝিরা খোকনদের সব বোচকা-বুচকি নৌকায় তুলছে। কি ব্যাপার, খোকনেরা সব যায় কোথা?

দীনু অবাক হয়ে খোকনের মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘খালা কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’

খোকনের মা দুঃখী গলায় বললেন, ‘বকুলতলী যাচ্ছিরে দীনু। আমার বড় ভাইয়ের বাড়ি।’

‘কেন’?

‘ওমা তুই জানিস না, শহরে মিলিটারি এসে গেছে। সবাই শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। মিলিটারি সব লোকজন মেরে ফেলবে।’

দীনু ভয় পেয়ে বলল, ‘তাই নাকি, কবে এসেছে?’

‘কাল সন্ধ্যায়। হাই স্কুলে ক্যাম্প করেছে। বৃষ্টি-বাদলা ছিল বলে বেরোয়নি। আজ রোদ উঠেছে, দেখবি খানিক বাদেই, বেরুবে। তারপর যাকে পাবে তাকেই মারবে। তুইও চলে যা কোথাও।’

দীনু অবাক হয়ে বলল ‘আমি কোথায় যাব? এই শহরের বাইরে আমার কোনো চেনা মানুষ নেই। কার কাছে যাব।’

খোকনের মা একটু রাগী। এই শহরে এই একজন মানুষ, দীনু যাকে খুব ভয় পায়। তবুও এই মুহূর্তে সাহস করে বলল, ‘খালা আমাকে তোমাদের সঙ্গে নেবে?’

‘কোথায়?’

‘বকুলতলী’।

শুনে খোকনের মা একটু গম্ভীর হয়ে যান। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘বাবা দীনু, আমার ভাই খুব গরিব মানুষ। বাড়িতে একটা ঘর। তার বড় সংসার, ঘরে জায়গা হয় না। তার উপর আমরা এতোগুলো লোক। কোথায় থাকব, কেমন করে থাকব জানি না। এই অবস্থায় তোকে কেমন করে নেব বাপ।’

খোকনের মা আঁচলে চোখ মোছেন। দেখে দীনুরও চোখ ভরে আসে জলে।

খোকনের মা দীনুর মাথায় হাত রাখেন। ‘মন খারাপ করিস নে বাপ। আমি দোয়া করি, তোর কিচ্ছু হবে না। এত সুন্দর ছেলে তুই, এত ভালো। তোর গায়ে কেউ হাত দেবে না।’

তারপর নৌকায় গিয়ে ওঠেন। খোকনেরা সব আগেই নৌকায় উঠে বসেছিল, মা উঠার সঙ্গে সঙ্গেই মাঝিরা বৈঠা ফেলল খালের জলে। বিষণ্ন দীনু মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল খালপাড়ে সাদা বেলে মাটির ওপর।

তখন সেই মফস্বল শহরে চমৎকার রোদ। চারদিকের শূন্য বাড়িঘর রোদের আলোয় ঝকমক করছে। খালের জলে, বর্ষার ধানী মাঠে রোদ আর হাওয়ার খেলা। কাছে কোথাও কোনো ধানী মাঠের ভেতর নেমেছে কোড়া পাখি। তার কুরকুর একটানা ডাক শোনা যায়। খালপাড়ে দাঁড়িয়ে দীনু ভাবে- সবারই কোথাও না কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে। কেবল তার নেই।

বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে দীনুর। তারপর মন খারাপ করে খালপাড় ধরে একাকি হাঁটতে থাকে। কোথাও কোনো লোকজনের চিহ্ন নেই, সাড়া নেই। দিনের বেলাটাকে মনে হয় রাত দুপুর। সবাই ঘুমুচ্ছে। কিন্তু দীনু এখন কোথায় যাবে?

তখন জমির চাচার কথা মনে পড়ে দীনুর। জমির চাচা সকালবেলা বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে গেছে। এখন নিশ্চয়ই বাজারের কোণে বসে ভিক্ষা করছে। দীনু ভাবে, জমির চাচাকে গিয়ে মিলিটারির কথা বলবে। তারপর জমির চাচার সঙ্গে কোথাও চলে যাব। জমির চাচার নিশ্চয় কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে। আর জমির চাচা যদি যায়, দীনুকে ফেলে যেতে পারবে না।

কিন্তু তারপরই দীনুর মনে হয়, শহরের কোথাও কোনো লোক নেই আজ। বাজার কী বসেছে? সবাই পালালে দোকানিরাও পালাবে। আর দোকানিরা পালালে জমির চাচাও পালাবে। কিন্তু দীনুকে ফেলে কী জমির চাচা পালাতে পারে? দুমাস ধরে এক সঙ্গে আছে।

দীনুর মাথার ভেতর ছোটখাট একটা গিট লেগে যায়।

খালের ওপারেই হাই স্কুল জমির চাচার কথা ভাবতে ভাবতে স্কুলের কাছাকাছি এসে গেছে, তখন ঠিক তখনি মিলিটারির মধ্যে একজন তার নিশানা ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য খালের ওপার থেকে দীনুকে তাক করে। অটোমেটিক রাইফেলে কিছু বুঝে উঠার আগেই দীনু দেখে একের পর এক আগুনের মৌমাছি ছুটে আসছে তার দিকে। আর মাথার ওপর সারা শহরের কাক কা কা করছে।

দুহাতে বুক চেপে ধরে দীনু। দেখে দশ আঙ্গুলের ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে জোয়ারের জলের মতো নেমে যাচ্ছে রক্ত। খালপাড়ের সাদা মাটি লাল হয়ে যাচ্ছে।

আস্তে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দীনু। চোখ দুটো ভীষণ টানছিল তার। তখুনি দৃশ্যটা দেখতে পায় ও। তার বুকের রক্তে তৈরি হয়েছে বিশাল লম্বা এক খাল। সেই খাল বেয়ে ফিরে আসছে হাজার হাজার ছইঅলা নৌকা। প্রথম নৌকায় সুবলেরা। সুবলের বুড়ি দিদিমা বসে আছেন ছইয়ের ভেতর। তার পেছনের নৌকায় খোকনেরা। প্রতিটি নৌকা থেকে ভেসে আসছে উল্লাসের শব্দ। দেখে দীনুর যে কী খুশি। সবাই ফিরে আসছে। তাহলে এই কী স্বাধীনতা ! সুবলের দিদিমা বলেছিলেন।

স্বাধীনতার কথা ভেবে দীনুর ঠোঁটে বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো সুন্দর এক টুকরো হাসি ফুটেছিল। কেউ তা দেখেনি।


পোস্টটি শেয়ার করুন