অলক্ষুণে জুতো – মোহাম্মদ নাসির আলী

আর যায় কোথায়? টানতে টানতে তারা বেচারা আলী আবুকে হাজির করলো কাজির দরবারে। কাজি রেগে বললেন, এক্ষুনি ওর পিঠে দশ দোররা মারো। মেরে নিয়ে যাও কয়েদখানায়। হাজার দিনার জরিমানা দিলে তবে ওর মুক্তি।

ব্যাপারটা যে ভুলবশত: হয়ে গেছে আবু তা বোঝাতে বারবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কে শুনবে তখন তার কথা। অবশেষে কেবল এক হাজার দিনার জরিমানা দিয়ে আলী আবু সে যাত্রা রক্ষা পেল।

বাড়ি ফিরে আসতে আসতে সে ভাবল, যে অপয়া জুতোর জন্য এতটা হয়রানি আর বেইজ্জতি, তার মুখ আর জীবনে দেখতে চাইনে। আজ বাড়ি গিয়ে ও-দুটোকে শেষ করতে হবে।

এই ভেবে আবু বাড়ি ফিরে তার নাগরাই জোড়া নিয়ে এলো নদীর তীরে। তারপর বাড়ি থেকে বেশ খানিক দূরে একটা পুলের ওপর দাঁড়িয়ে এক এক করে দু-পাটি জুতোই ছুঁড়ে ফেলল নদীতে।

কিন্তু সেদিন বিকালে ঘটল এক কান্ড। এক জেলে এসে নদীতে জাল ফেলতেই মাছের পরিবর্তে সশরীরে উঠে এল আবুর সেই বিখ্যাত নাগরাই জোড়া। হরেক রকমের চামড়ার তালি লাগানো জুতো চিনতে জেলের দেরি হলো না। সেবারের খ্যাপে জালে মাছ না উঠলেও সে কিন্তু মনে মনে খুশিই হলো। বাড়ি ফিরে বউকে বললো, আলী আবু ধনী মানুষ- এতদিনের জুতোজোড়া ফেরত পেলে কম করেও দু-দিনার বকশিশ নিশ্চয় দেবে।

দুঃখের বিষয়, জেলে যখন আলী আবুর বাড়ি জুতো নিয়ে হাজির হলো, তখন বাড়িতে কেউ ছিল না। ঘরের দরজাগুলো সব বন্ধ। শুধু একটা জানালা খোলা ছিল। তাও ছিল অনেক উঁচুতে। জেলে মনে মনে বললো, এই নিয়ে আর তকলিফ করে ফিরে যাওয়া যাবে না। তার চেয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে দিলেই আবু এসে তার জুতো পেয়ে খুশি হবে। পরে যখন দেখা হবে, তখন বললেই হবে যে, আমি পেয়েছিলাম ওটা। বকশিশটাও তখন চেয়ে নেয়া যাবে।

এই বলে জানালা দিয়ে জুতো দু-খানা ছুড়ে মারতেই সেগুলো গিয়ে পড়ল গোলাপজলের শিশির ওপর। তার ফলে তাকের সবগুলো শিশি মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল।

রাতে বাড়ি ফিরে আবুর তো চক্ষু চড়কগাছ। মাথা চাপড়ে সে কেঁদে উঠলো। আবার সেই অপয়া জুতোর কীর্তি। কী বদনসিবই হয়েছে আমার। আজই, এক্ষুনিই, এ অলক্ষুণে জুতোর হাত থেকে যে করেই হোক রেহাই পেতে হবে।

এই বলে বাগানের একপাশে দেয়ালের ধারে গিয়ে সে মাটি খুঁড়তে লাগলো। আঁধারে তখন কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু কাল ভোর অবধি অপেক্ষা করবার মতন মনের অবস্থা আবুর মোটেই নেই। চোর যেমন আঁধারে সিঁধ কাটে আবুও তেমনি আঁধারেই মাটি খুঁড়তে লাগল।

দেয়ালের পাশে শব্দ শুনে পাশের বাড়ির লোকেরা এলো আলো নিয়ে। এসে দেখল আবুর কান্ড। তারা বলল, এই তোমার কীর্তি! আঁধারে বসে দেয়ালের তলায় সুড়ঙ্গ কেটে আমাদের সর্বস্ব চুরি করার মতলব? চলো এক্ষুনি কাজির কাছে।

এবার কাজি তাকে দেখেই বলে উঠলেন, আবার চুরি ! কদিন আগে আমার জুতো চুরি করে জরিমানা দিয়েছ। এবার বুঝি বড় রকমের দাঁও মারবার মতলবে ছিলে?

এই বলে আবুকে কথা বলবার সুযোগ না দিয়েই কাজি তাকে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দিলেন।

বাড়ি এসে সে ভাবল-দু-বার দু-হাজার দিনার জরিমানা দিয়ে জেল খাটার হাত থেকে রেহাই পেলাম। কিন্তু জুতোর হাত থেকে রেহাই না পেলে চলবে না। এই অলক্ষুণে জুতো বাড়ির বার করতেই হবে।

অনেক ভেবেচিন্তে এবার সে জুতোজোড়া ফেলে এলো নর্দমায়। বাড়ি ফিরে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো, এতদিনে সত্যিই রেহাই পেলাম। নর্দমায় কেউ জাল ফেলতে আসবে না।

পরের দিন ভোরে ঝাড়ুদার এলো নর্দমা পরিষ্কার করতে। এসে দেখলো একজোড়া ছেঁড়া জুতো আটকে নর্দমা বন্ধ হয়ে আছে। বলা বাহুল্য, জুতোর মালিককে চিনতে বেগ পেতে হলো না। ময়লা জুতোজোড়া সে আবুর বাড়ির দরজায় রেখে চলে গেল।

আবুর ঘুম ভাঙতে বাইরে এসে দেখলো, আবার সেই জুতো। আবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এবার কী করবে তাই বসে সে ভাবতে লাগলো।

রাস্তা দিয়ে এক কুকুর যাচ্ছিল ছুটে। হঠাৎ আবুর বাড়ির কাছে এসেই থেমে পড়ল। তারপর মাটি শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে এলো জুতোর কাছে। এসেই একপাটি জুতো মুখে নিয়ে দে-ছুট।

অগত্যা আবুও ছুটল কুকুরকে তাড়া করে। ছুটতে ছুটতে সামনে পড়ল একটা দেয়াল। কুকুর দেয়াল টপকে যেতেই জুতোটা ফস্কে গিয়ে পড়ল দেয়ালের ওপাশে একটা ছোট ছেলের মাথায়। আবুর ভারী জুতোর ঘায়ে ছেলে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। বাড়িতে হইচই পড়ে গেল। সবাই এলো ছুটে।

তারপর আবার সেই কাজির দরবার। আবুকে দেখে কাজি রেগে উঠে বললেন, ছেলেটার চিকিৎসার সব টাকা তো দিতেই হবে, তাছাড়া সমপরিমাণ টাকা খেসারতও দিতে হবে।

বেচারা এবার কেঁদেই ফেলল। দুবার জরিমানা আর শিশির কারবারে লোকসান দিয়ে আবুর হাতে নগদ টাকা-পয়সা কিছুই ছিল না। তাই এবার তাকে ধাক্কা সামলাতে হলো বন্ধুবান্ধবের কাছে ধার করে।

এ ঘটনার দিন-দুই পরে আবু এসে হাজির হলো কাজির দরবারে। কাজি তো তাকে দেখেই অবাক। সেদিকে লক্ষ না করে তালি দেয়া জুতোজোড়া কাজির সামনে রেখে আবু বলল, এবার আমার ফরিয়াদ রাখতে হবে হুজুর। আমার এই জুতোজোড়ার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ। এ অলক্ষুণে জুতোর কারণে আমার যা-কিছু দুর্ভোগ ঘটেছে, তা শুনে হক ইনসাফ কর, করে দোষীর সাজা দিন।

কাজি অবাক হয়ে চেয়ে রইল। লোকটা তামাশা করছে না কি! আবু আবার বলতে লাগলো, আমি সত্যি বলছি হুজুর। আমার বুড়োবয়সে সবকিছু দুর্ভোগের মূল ওই ছেঁড়া জুতোজোড়া। এ দুটোকে এমনভাবে কয়েদ করে রাখুন যাতে আমার নজরে আর না পড়ে।

এই বলে সে একে একে কাজিকে সব কথা খুলে বলল।

আবুর দুর্ভোগের কথা শুনে কাজির ভীষণ হাসি পেল। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, সত্যিই তুমি জুতোর বদৌলতে কষ্ট ভোগ করছ দেখতে পাচ্ছি। যাও তোমার জরিমানার টাকা সব ফেরত দেবার হুকুম দিলাম। তাছাড়া এ জুতো আর তোমাকে দেখতে হবে না।

কাজি সত্যিই দয়ালু ছিলেন। তিনি আবুর দু-হাজার দিনার সাথে সাথে ফেরত দিয়ে দিলেন। জুতোজোড়ার ভাগ্যে কী ঘটেছিল কেউ বলতে পারে না। কিন্তু আবুর পায়ে সেগুলোকে আর দেখা যায়নি।


পোস্টটি শেয়ার করুন