সোহরাব রোস্তম – মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী

দুই বীর তাঁবুতে ফিরে গেলেন। রোস্তম ভাবেন, কে এই বালক? তার বাহুতে এত শক্তি কোথা থেকে এল? আর সোহরাব ভাবে-কীজন্য এলাম যুদ্ধ করতে যদি আমার বাবা জাবুলিস্তানেই থেকে গেল?

পরের দিন আবার সেই নির্জন স্থানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সোহরাব পুনরায় জিজ্ঞেস করল, অনুগ্রহ করে বলুন আপনি কী সত্যি মহাবীর রোস্তম নন? যদি রোস্তম হন তাহলে আমি আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করব না।

রোস্তম তখন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে সোহরাবকে উত্তেজিত করছেন: ওহে মুষিকপ্রবর, রোস্তমের সঙ্গে যুদ্ধ করা দুগ্ধপোষ্য বালকের কাজ নয়। আগে আমাকে পরাজিত করো, তাহলেই রোস্তমের সঙ্গে যুদ্ধ করার আস্পর্ধা করো।

সোহরাব এবার উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে রোস্তমকে প্রচন্ড শক্তিতে আঘাত করল। রোস্তম সে আঘাত সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেলেন সোহরাব তার বুকের ওপর বসে অস্ত্রের আঘাত করতে উদ্যত হয়েছে। রোস্তম কৌশল করে বললেন, এ তোমার কোন বীরত্বের রীতি? শত্রুকে পরপর দুবার পরাজিত না করলে তাকে প্রাণে বধ করা যায় না। ইরানের এই যুদ্ধরীতিকে তুমি অস্বীকার করতে চাও?

সোহরাব রোস্তমকে ছেড়ে দিল। সেদিনের মতো সন্ধি, আবার আগামীকাল যুদ্ধ।

তৃতীয় দিন আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সোহরাব দেখছে রোস্তমকে। একবার নয়, দুবার নয়, বারবার সে দেখছে রোস্তমের দিকে। রোস্তমের আজ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি সামান্য এক বালকের হাতে

পরাজয়ের  গ্লানি বহন করতে রাজি নন।

প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে। কিন্তু আনমনা সোহরাবকে আজ রোস্তম ধরাশায়ী করে ফেললেন।

সোহরাবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রথম সুযোগে রোস্তম তীক্ষ্মধার তলোয়ার বের করে সোহরাবের বুকে ঢুকিয়ে দিলেন। সোহরাবের তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।

কোথায় গেল ইরানের যুদ্ধের নিয়ম, কোথায় গেল মহাবীর রোস্তমের বীরত্ব। সোহরাব যন্ত্রণায় এবং ক্ষোভে ক্রন্দন করে বলল, শোনো ইরানি কাপুরুষ। তুমি অন্যায় যুদ্ধে প্রথম পরাজয়ে আমাকে প্রাণে বধ করলে। কিন্তু এ সংবাদ যখন আমার বাবা জানতে পারবেন তখন তুমি সাগরের অতলেই থাকো, কিংবা আকাশে নক্ষত্রের মধ্যে পলায়ন করো তিনি তোমাকে ক্ষমা করবেন না।

রোস্তম বলল, কে তোমার বাবা?

সোহরাবের বুক থেকে তখন রক্তের স্রোত গড়িয়ে পড়ছে। ক্লান্ত অবসন্ন সোহরাব বলল, মহাবীর রোস্তম আমার বাবা, আর সামেনগানের অধিপতির কন্যা তহমিনা আমার মা।

সহস্র বজ্রপাতের মতো মহাবীর রোস্তমের কানে সোহরাবের শেষ কথাগুলো শেলবিদ্ধ হলো। রোস্তম আর্তনাদ করে বলল, মিথ্যা কথা, ওরে বালক মিথ্যা কথা! আমার কোনো পুত্রসন্তান নেই। তহমিনা আমাকে সংবাদ দিয়েছে, আমার কন্যাসন্তান হয়েছে।

সোহরাব শেষবারের মতো চক্ষু মেলে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে তার হাত তুলে দেখাল, সেখানে একটি তাবিজ বাঁধা আছে। সোহরাব বলল, বাবা আমার আর কোনো দুঃখ নেই। সোহরাবের চোখ বন্ধ হয়ে গেল।

সোহরাবের নিস্পন্দ দেহ পিতার বক্ষে আশ্রয় লাভ করল।

তখন নির্জন গিরিপথে কোনো প্রাণী ছিল না, আকাশের সূর্য এসে সোহরাবের মুখে পড়েনি, কোনো বিদায় রাগিণী বেজে উঠে সেই বিদায় দৃশ্যকে বিহবল করেনি। তবু রোস্তমের বুকফাটা হাহাকার ফিরে আয় মানিক। প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে এসে বারবার বলছিল, নেই সোহরাব নেই।

দিবসের শেষ সূর্য যখন পর্বতের ওপারে ঢলে পড়ল, তখনও হতভাগ্য মহাবীর রোস্তম ছেলের প্রাণহীন দেহ বক্ষে ধারণ করে বার বার বলছে: আয় সোহরাব ফিরে আয়।


পোস্টটি শেয়ার করুন