সোহরাব রোস্তম – মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী

কিন্তু ভয়ংকর লোমশ প্রাণী সফেদ দেও-এর রক্ত না হলে অন্ধ রাজার চক্ষু ভালো হবে না। মহাবীর রোস্তমের সঙ্গে মহাবলী সফেদ দেও সম্মুখযুদ্ধ শুরু করল। মনে হয় এমন প্রলয়ংকর যুদ্ধ পৃথিবীতে কখনও ঘটেনি এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে না।

দুই বীর যোদ্ধাই যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হলো। অবশেষে মহাবীর রোস্তমের আঘাতে সফেদ দেও-এর কোমর ভেঙে গেল। রোস্তম তলোয়ার দিয়ে সফেদ দেও-এর গলা দ্বিখন্ডিত করলেন। অন্ধ রাজা কায়কাউস দেও-এর রক্তের ফোঁটা পেয়ে দৃষ্টি ফিরে পেলেন। আবার ইরানে শান্তি ফিরে এল।

রোস্তম ফিরে গেলেন জাবুলিস্তানে।

মহাবীর রোস্তম একবার প্রিয় ঘোড়া রুখ্‌শের পিঠে চড়ে বেরিয়েছেন শিকার করতে। ঘুরে ঘুরে তিনি এসে পড়েছেন তুরানের কাছে এক জঙ্গলে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে মনিব এবং অশ্ব দুজনই ক্লান্ত। বড় গাছের নিচে রোস্তম শুয়ে পড়েছেন। প্রগাঢ় ঘুমে তিনি নিমগ্ন। পাশেই প্রিয় রখশ ঘাস খাচ্ছে।

তখন নিশুতি রাত। রুখশ আপন মনে ঘাস খাচ্ছে। সে সময় একদল তুরানি সে পথ দিয়ে যাচ্ছিল। ঘোড়া চুরি করাই তাদের ব্যবসা। রুখ্‌শকে দেখে ওরা লোভ সামলাতে পারল না। ভুলিয়ে ভালিয়ে সে রাতেই ওরা রখশকে নিয়ে তুরান পালিয়ে গেল। কিন্তু ঘোড়াচোররা জানতেও পারল না তারা কার প্রিয় ঘোড়া নিয়ে পলায়ন করছে।

সকালের সূর্যের স্নিগ্ধ আলোয় এবং অরণ্যে পাখির কূজন শুনে মহাবীর রোস্তমের ঘুম ভাঙল। তিনি অভ্যাস মতোই প্রিয় রখ্‌শের নাম ধরে ডাকলেন। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। এমন তো কখনও হয়নি! রোস্তম এখানে সেখানে খুঁজলেন, অবশেষে বনের প্রান্তে ধুলোর মধ্যে রখ্‌শের খুরের দাগ দেখে ঠিকই বুঝলেন তুরানি ঘোড়াচোররা তার প্রিয় রখশকে নিয়ে পালিয়েছে।

খুরের দাগ অনুসরণ করে ক্রোধে উন্মত্ত মহাবীর রোস্তম সামেনগান শহরে উপস্থিত হলেন। মহাবীর

রোস্তমকে চেনে না কে? যারা কোনোদিন চোখে দেখেনি তারাও এই বিশালদেহী মহাবীরকে দেখেই বুঝতে পারল ইনিই ইরানের বীর রোস্তম। বীরের ক্রোধবহ্নি-মিশ্রিত চক্ষু দেখে সকলে প্রাণভয়ে ছুটে পালাল। সামেনগান অধিপতির নিকট সংবাদ গেল তিনি দ্রুত ছুটে এলেন মহামান্য অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে। ইতোমধ্যেই সামেনগান অধিপতি তার নগরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য চতুর্দিকে লোক-লস্কর ছুটিয়ে দিয়েছেন ঘোড়াচোরদের গ্রেফতার করার জন্য।

সামেনগান অধিপতির বিনীতবাক্যে আপাতত তুষ্ট হয়ে রোস্তম এলেন প্রাসাদে রাজ-অতিথি হয়ে। রোস্তমের সম্মানে বিরাট ভোজের আয়োজন হলো। নৈশভোজ শেষ করে পরিতুষ্ট রোস্তম গেলেন রাজশয্যায় বিশ্রাম গ্রহণ করতে।

হাতির দাঁতের পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে রোস্তমের চোখে তন্দ্রার ভাব এসেছে, তখন মনে হলো এক অপরূপ সুন্দরী তাঁর শয্যাপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সুন্দরীর স্নিগ্ধ সরল রূপমাধুর্য দেখে রোস্তম বিমোহিত হলেন। রোস্তমের তন্দ্রা কেটে গেল। তিনি তাড়াতাড়ি শয্যা ত্যাগ করে দেখলেন স্বপ্নে আর বাস্তবে কোনো ভেদ নেই সত্যিই এক অপরূপ সুন্দরী কন্যা তার শিয়রের প্রান্তে দন্ডায়মান। রোস্তম বললেন, কে তুমি রমণী? রমণী সলজ্জ নেত্র তুলে বলল,আমি তহমিনা। সামেনগান অধিপতি আমার পিতা। আপনার বীরত্ব ও শৌর্যের কথা শুনে এতদিন আপনাকে নিয়ে স্বপ্নের মধুর জাল বুনেছি। আপনার বীরত্বকে আমি এতকাল অর্ঘ্য নিবেদন করেছি। সত্যিই যখন আজ আপনি আমাদের মহান অতিথি হয়ে এসেছেন, তখন জানাতে এসেছি আমি এতকাল আপনাকেই স্বামীত্বে বরণ করেছি।

এই কথা বলে হাওয়ার দোলায় ভেসে তহমিনা ঘর ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু ঘরের বাতাস রেখে গেল তার মধুর দোলা এবং মহাবীর রোস্তমের অন্তরে রেখে গেল এক অনাস্বাদিত মধুর ঝংকার।

মহাবীর রোস্তম আর ঘুমাতে পারলেন না। সকালের প্রথম আলো জানালা দিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই রোস্তম ছুটে গেলেন সামেনগান অধিপতির কাছে। রোস্তম নিঃসঙ্কোচে প্রস্তাব করলেন, তিনি তহমিনাকে বিবাহ করবেন। সামেনগান অধিপতি যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলেন। মহাবীর রোস্তম হবে তার জামাতা, এ যে ধারণার অতীত। তিনি সানন্দে রাজি হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মহাসমারোহে বিয়ের আয়োজন করতে ছুটে গেলেন।

মহা উৎসব, বিপুল আয়োজনের মধ্যে জাঁকজমক সহকারে রোস্তমের সঙ্গে তহমিনার বিবাহ হয়ে গেল। রাত্রির চাঁদ বাতায়নে দাঁড়াল। নিশাবসানের পূর্বে মহাবীর রোস্তম প্রিয় স্ত্রীর চিবুক স্পর্শ করে বললেন-যদি আমাদের পুত্রসন্তান হয় তা হলে এই তাবিজটি তার হাতে পরিয়ে দিও, আর যদি কন্যাসন্তান হয় তাহলে এ তাবিজ তার চুলে বেধে দিও। এ তাবিজের ভেতর আমি নিজের নাম স্বাক্ষর করে রেখেছি।

তহমিনা ছলছল চোখে স্বামীর দিকে তাকায়। রোস্তম সেই জলভরা চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি বীরের স্ত্রী, কান্না তোমার শোভা পায় না। আমি আজই ইরান ফিরে যাব, শত্রুরা আবার প্রিয় ইরানের স্বাধীনতা হরণের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে।

তহমিনা বিচ্ছেদ ব্যথায় কাতর হয়ে হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু মহাবীর রোস্তম বাধা দিয়ে বললেন বীরের প্রকৃত স্থান যুদ্ধের ময়দান, যুদ্ধেই তোমার স্বামীর প্রকৃত পরিচয় ফুটে উঠবে।

প্রিয় অশ্ব রখ্‌শের পিঠে চড়ে মহাবীর রোস্তম ইরানের পথে চলে গেলেন। ঝরোকার ওপর চোখ রেখে

হতভাগিনী তহমিনা স্বামীর চলে যাওয়া দেখল। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বামীর মাথার সোনার মুকুট দেখা গেল, তহমিনা অপলক দৃষ্টিতে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর যখন আর কিছুই দেখা গেল না, শুধু অশ্রুধারায় তার দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে এল। তখন স্বামীর ফেলে যাওয়া শয্যায় আছড়ে পড়ে ব্যাকুল ভাবে কাঁদাল। ইরানের অগ্নিদেবতা কি জানতে পেরেছিল তহমিনা কেঁদে কেঁদে বলেছিল-ওগো আমার ভাগ্যদেবতা, আমাকে তুমি পুত্রসন্তানের মা হতে দাও, যেন পুত্রের মুখ দেখে আমি বীর স্বামীকে হারানোর দুঃখ ভুলে থাকতে পারি।

হয়তো তহমিনার করুণ আবেদন সৃষ্টিকর্তা শুনেছিল। যথাসময়ে সুন্দরী তহমিনার কোল আলো করে এক পুত্রসন্তান এল। সকলেই মহাখুশি। সামেনগান অধিপতি নাতির নাম রাখলেন সোহরাব। মহাবীর রোস্তমের পুত্র সোহরাব। কিন্তু মা তহমিনার বুক সেদিন ক্ষণকালের জন্য হলেও কেঁপে উঠেছিল। তহমিনা যদিও ছেলের হাতে রোস্তমের দেয়া তাবিজ পরিয়ে দিলেন কিন্তু রোস্তমের কাছে দূত মারফত সংবাদ পাঠালেন তাদের একটি কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে।

দূতমুখে কন্যার সংবাদ পেয়ে রোস্তম বিমর্ষ হলেন। আশা করেছিলেন তিনি পুত্রের পিতা হবেন।

রোস্তম একরকম জোর করেই তহমিনার কথা ভুলে থাকতে চাইলেন।

পোস্টটি শেয়ার করুন