মার্চেন্ট অব ভেনিস – উইলিয়াম শেক্সপিয়ার

বিয়ের শর্তানুযায়ী প্রাথমিক বাছাইকৃত যুবক তিনজনকে পৃথক পৃকভাবে একটি সুসজ্জিত কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে পাশাপাশি তিনটি পেটিকা ছিল। একটি সোনার আর একটি রূপার এবং সর্বশেষটি সীসার। একটা পেটিকার মধ্যে ছিল পোর্শিয়ার নিজের ছবি। ছবিসহ পেটিকা যে নির্বাচন করতে পারবে সে-ই বিজয়ী হবে এবং পোর্শিয়ার সাথে অগাধ ধনরত্নের উত্তরাধিকারী হবে। এই ব্যাপারটি বাবার উপদেশ অনুযায়ীই স্থির করেছিল পোর্শিয়া।

প্রথমে মরক্কোর রাজপুত্র ঘরের মধ্যে এলেন। পেটিকা তিনটির মধ্যে স্বর্ণেরটাই তিনি বাছাই করলেন। এর গায়ে কারুকার্যের সাথে খোদাই করা ছিল : যে আমাকে বাছাই করবে সে বহুগুণ বাঞ্ছিত ধন পাবে। কিন্তু খুলে দেখা গেল এতে পোর্শিয়ার ছবি নেই। পরিবর্তে আছে মড়ার মাথার খুলি আর উপদেশবাণী লেখা। একখানা চিরকুট। তাতে লেখা-

চকচক করিলেই সোনা নাহি হয়
বহু লোক এ কথাটি শুনেছে নিশ্চয়,
বহু লোক লোভে করে জীবনের ক্ষয়
শুধু দেখে বাহিরের চাকচিক্যের জয়।

মরক্কোর রাজকুমার মনে অফুরন্ত হতাশা আর হাহাকার নিয়ে বিদায় হলেন। এবার আরাগনের যুবরাজের পালা। তিনি রৌপ্য পেটিকা উত্তোলন করলেন। এই পেটিকার গায়ে খোদাই করা ছিল : যে আমাকে পছন্দ করবে সে তার প্রাপ্য পাবে। কিন্তু বাক্সটি খুলে তিনি হতাশ হলেন। দেখলেন পোর্শিয়ার ছবির পরিবর্তে ভেতরে রয়েছে একটা বোকার ছবি আর একখানা চিরকুট। তাতে লেখা-

সাতবার রৌপ্য-পাত্র হয় অগ্নিদদ্ধ
বারবার পোড় খেলে বুদ্ধি পরিশুদ্ধ
আমি যথা ঢাকা ছিনু রূপোর মায়ায়
ফিরে যাও ঘরে তুমি, তোমাকে বিদায়।

যুবরাজ লজ্জিত হয়ে ফিরে গেলেন। এবার বাসানিও। কম্পিত চোখে পেটিকা তিনটির গায়ের লেখা পড়লেন। দেখলেন, সীসার কৌটার গায়ে লেখা রয়েছে : আমাকে যে পছন্দ করবে তাকে তার যথাসর্বস্ব ঝুঁকি নিতে হবে। অনেক চিন্তা করে এই সাধারণ জৌলুশহীন পেটিকাই নির্বাচন করলেন তিনি। কম্পিত হস্তে ঢাকনা খুলতেই যুবতী পোর্শিয়ার হাসিমাখা ছবি পেলেন এবং একখানা চিরকুট তাতে, লেখা-

করোনি বাচাই তারে দেখে চেকনাই
অনুকূল তব ভাগ্য সন্দেহ তো নাই
যবে হলো করায়ত্ত সৌভাগ্য তোমার
এতেই তুষ্ট থেকো, চেয়ো নাকো আর।

পোর্শিয়া তাকে স্বাগতম জানাল। উভয়ের বিয়ে হয়ে গেল।

এদিকে পোর্শিয়ার চাকরানি সুন্দরী নেরিসাকে দেখে বাসানিওর চাকর গ্রাসিয়ানো মুগ্ধ হয়ে গেল। পোর্শিয়ার মধ্যস্থতায় তারাও দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হয়ে পড়ল।

কিন্তু এত সুখের মধ্যেও একটি মর্মন্তুদ দুর্ঘটনার খবর বয়ে আনল একখানা চিঠি। চিঠিখানা অ্যান্টনিও লিখেছে, তার সবগুলো জাহাজ ঝড়ে সাগরবক্ষে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। শাইলক টাকার জন্য আদালতে নালিশ করেছে। চিঠি বহনকারী সালারিও আরও জানাল, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে-ইহুদি শয়তানটা টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কারণ দলিলের শর্ত মোতাবেক ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ইতিমধ্যেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন সে অ্যান্টনিওর গায়ের এক পাউন্ড মাংস চায়।

এর মধ্যে আরও এক বিষয় ঘটে পেছে। শাইলকের একমাত্র মেয়ে জেসিকা খ্রিস্টান যুবক লরেঞ্জোর কুমন্ত্রণায় পড়ে পালিয়ে গেছে। লরেঞ্জো অ্যান্টনিওর বন্ধুপুত্র। তাই গোটা খ্রিস্টান জাতির ওপর শাইলক এখন বীতশ্রদ্ধ। এখন আইনে যখন আটকানো গেছে তখন অ্যান্টনিওকে ক্ষমার আর কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

খবরটিতে পোর্শিয়া হায় হায় করে উঠল এবং স্বামীই যে এ সবের মূল-তাও জানতে পারল। দশগুণ অর্থ দিয়ে বাসানিওকে তাড়াতাড়ি ভেনিসের আদালতে পাঠাল সে- সেখানে বিচার হবে মহামতি অ্যান্টনিওর।

স্বামীকে পাঠিয়ে বুদ্ধিমতী পোর্শিয়াও বসে থাকল না। পরিচারিকা নেরিসাকে সঙ্গে করে পুরুষের ছদ্মবেশে সেও ভেসিসের উদ্দেশে যাত্রা করল।

আদালতে তখন বিচার শুরু হয়ে গেছে। বিচারক অ্যান্টনিওকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কোনো উকিল আছে? অ্যান্টনিও সংক্ষেপে জবাব দিল, না ধর্মাবতার, আমার কোনো উকিলের আবশ্যকতা নেই।

অবশেষে বিচারক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আপনার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত আপনাকে এমন একজন পাষাণ হৃদয়, মানুষ নামধারী জঘন্যতম জীবের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে, যার মধ্যে মানবিক করুণার সামান্যতম ছিটেফোঁটাও নেই। তারপর শাইলকের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ইচ্ছে করলে অবশ্য তাকে ক্ষমা করতে পারেন।

শাইলক ক্রোদ্ধস্বরে বলল, ‘ধর্মাবতার, এখানে ক্ষমার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি তো চুক্তিনামার বাস্তবায়ন চাচ্ছি মাত্র। আপনি যদি আমার প্রাপ্য দিতে অস্বীকার করেন তাহলে বুঝব আইনের অপমৃত্যু ঘটেছে।’

পোস্টটি শেয়ার করুন