একটা আষাঢ়ে গল্প – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তাসের রাজ্যে এতদিন কোনাে উপদ্রব ছিল না। এই প্রথম গােলযােগের সূত্রপাত হইল।

এতদিন পরে প্রথম এই একটা তর্ক উঠিল— এই-যে তিনটে লােক হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলায় সমুদ্র হইতে উঠিয়া আসিল, ইহাদিগকে কোন শ্রেণীতে ফেলা যাইবে।

প্রথমত, ইহারা কোন্ জাতি- টেক্কা, সাহেব, গােলাম না দহলা-নহলা ? দ্বিতীয়ত, ইহারা কোন্ গােত্র- ইস্কাবন, চিড়েতন, হর্‌তন, অথবা রুহিতন ?

এ-সমস্ত স্থির না হইলে ইহাদের সহিত কোনােরূপ ব্যবহার করাই কঠিন। ইহারা কাহার অন্ন খাইবে, কাহার সহিত বাস করিবে—ইহাদের মধ্যে অধিকারভেদে কেই বা বায়ুকোণে, কেই বা নৈঋতকোণে, কেই বা ঈশানকোণে মাথা রাখিয়া এবং কেই বা দণ্ডায়মান হইয়া নিদ্রা দিবে, তাহার কিছুই স্থির হয় না।

এ রাজ্যে এত বড় বিষম দুশ্চিন্তার কারণ ইতিপূর্বে আর-কখনাে ঘটে নাই।

কিন্তু, ক্ষুধাকাতর বিদেশী বন্ধু তিনটির এ-সকল গুরুতর বিষয়ে তিলমাত্র চিন্তা নাই। তাহারা কোনাে গতিকে আহার পাইলে বাঁচে। যখন দেখিল তাহাদের আহারাদি দিতে সকলে ইতস্তত করিতে লাগিল এবং বিধান খুঁজিবার জন্য টেক্কা বিরাট সভা আহ্বান করিল, তখন তাহারা যে যেখানে যে খাদ্য পাইল খাইতে আরম্ভ করিয়া দিল।

এই ব্যবহারে দুরি তিরি পর্যন্ত অবাক। তিরি কহিল, “ভাই দুরি, ইহাদের বাচবিচার কিছুই নাই।”

দুরি কহিল, “ভাই তিরি, বেশ দেখিতেছি ইহারা আমাদের অপেক্ষাও নীচজাতীয়।”

আহারাদি করিয়া ঠাণ্ডা হইয়া তিন বন্ধু দেখিল, এখানকার মানুষগুলা কিছু নূতন রকমের। যেন জগতে ইহাদের কোথাও মূল নাই। যেন ইহাদের টিকি ধরিয়া কে উৎপাটন করিয়া লইয়াছে, ইহারা একপ্রকার হতবুদ্ধিভাবে সংসারের স্পর্শ পরিত্যাগ করিয়া দুলিয়া দুলিয়া বেড়াইতেছে। যাহা-কিছু করিতেছে তাহা যেন আর-একজন কে করাইতেছে। ঠিক যেন পুংলাবাজির দোদুল্যমান পুতুলগুলির মতাে। তাই কাহারও মুখে ভাব নাই, ভাবনা নাই, সকলেই নিরতিশয় গম্ভীর চালে যথানিয়মে চলাফেরা করিতেছে। অথচ সবসুদ্ধ ভারি অদ্ভুত দেখাইতেছে।

চারি দিকে এই জীবন্ত নির্জীবতার পরমগম্ভীর রকম-সকম দেখিয়া রাজপুত্র আকাশে মুখ তুলিয়া হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিল। এই আন্তরিক কৌতুকের উচ্চ হাস্যধ্বনি তাসরাজ্যের কলরবহীন রাজপথে ভারি বিচিত্র শুনাইল। এখানে সকলই এমনি একান্ত যথাযথ, এমনি পরিপাটি, এমনি প্রাচীন, এমনি সুগম্ভীর যে, কৌতুক আপনার অকস্মাৎ-উচ্ছ্বসিত উচ্ছৃঙ্খল শব্দে আপনি চকিত হইয়া, ম্লান হইয়া, নির্বাপিত হইয়া গেল— চারি দিকের লােকপ্রবাহ পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ স্তব্ধ গম্ভীর অনুভূত হইল।

কোটালের পুত্র এবং সদাগরের পুত্র ব্যাকুল হইয়া রাজপুত্রকে কহিল, “ভাই সাঙাত, এই নিরানন্দ ভূমিতে আর এক দণ্ড নয়। এখানে আর দুই দিন থাকিলে মাঝে মাঝে আপনাকে স্পর্শ করিয়া দেখিতে হইবে জীবিত আছি কিনা।”

রাজপুত্র কহিল, “না ভাই, আমার কৌতূহল হইতেছে। ইহারা মানুষের মতাে দেখিতে— ইহাদের মধ্যে এক-ফোটা জীবন্ত পদার্থ আছে কিনা একবার নাড়া দিয়া দেখিতে হইবে।”

এমনি তাে কিছুকাল যায়। কিন্তু, এই তিনটে বিদেশী যুবক কোনো নিয়মের মধ্যেই ধরা দেয় না। যেখানে যখন ওঠা, বসা, মুখ ফেরানাে, উপুড় হওয়া, চিৎ হওয়া, মাথা নাড়া, ডিগবাজি খাওয়া উচিত, ইহারা তাহার কিছুই করে না; বরং সকৌতুকে নিরীক্ষণ করে এবং হাসে। এই-সমস্ত যথাবিহিত অশেষ ক্রিয়াকলাপের মধ্যে যে-একটি দিগগজ গাম্ভীর্য আছে ইহারা তাদ্বারা অভিভূত হয় না।

একদিন টেক্কা সাহেব গােলাম আসিয়া রাজপুত্র, কোটালের পুত্র এবং সদাগরের পুত্রকে হাঁড়ির মতাে গলা করিয়া অবিচলিত গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাসা করিল, “তােমরা বিধানমতে চলিতেছ না কেন।”

তিন বন্ধু উত্তর করিল, “আমাদের ইচ্ছা।”

হাঁড়ির মতাে গলা করিয়া তাসরাজ্যের তিন অধিনায়ক স্বপ্নাভিভূতের মতাে বলিল, “ইচ্ছা? সে বেটা কে।”

ইচ্ছা কী সেদিন বুঝিল না, কিন্তু ক্রমে ক্রমে বুঝিল। প্রতিদিন দেখিতে লাগিল, এমন করিয়া না চলিয়া অমন করিয়া চলাও সম্ভব, যেমন এ দিক আছে তেমনি ও দিকও আছে- বিদেশ হইতে তিনটে জীবন্ত দৃষ্টান্ত আসিয়া জানাইয়া দিল, বিধানের মধ্যেই মানবের সমস্ত স্বাধীনতার সীমা নহে। এমনি করিয়া তাহারা ইচ্ছনামক একটা রাজশক্তির প্রভাব অস্পষ্ট ভাবে অনুভব করিতে লাগিল।

ওই সেটি যেমনি অনুভব করা অমনি তাসরাজ্যের আগাগােড়া অল্প অল্প করিয়া আন্দোলিত হইতে আরম্ভ হইল- গতনিদ্র প্রকাণ্ড অজগরসর্পের অনেক গুলা কুণ্ডলীর মধ্যে জাগরণ যেমন অত্যন্ত মন্দগতিতে সঞ্চলন করিতে থাকে সেইরূপ।

পোস্টটি শেয়ার করতে ক্লিক করুন
Scroll to Top