॥ ৫ ॥
পরদিন সুজনের যেতে হল মরকতপুর। সেখানের রাজা হরবোলার ডাকে খুশি হয়ে সুজনকে ভালো বকশিস দিলেন। সুজন জবরনগরে ফিরে এল। শ্ৰীমতীর ফরমাশ মতো একবার রোজ তাকে পাখির ডাক শোনাতে হয়, আর রাজা রোজ তাকে বকশিস দেন।
এদিকে রাজার মনে গভীর চিন্তা। তার মেয়ে বেঁকে বসেছে, যে রাক্ষসকে মারতে পারবে তাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না। আজবপুরের যুবরাজ রণবীর তাই কালই সকালে আসছে জবরনগর। তাকে একা যেতে হবে আকাশীর গুহায়। সে সফল হলে তবেই শ্ৰীমতীকে বিয়ে করতে পারবে। সাহসী যোদ্ধা হিসেবে রণবীরের নামডাক আছে, তাই জবরনগরের রাজার ভরসা আছে সে হয়ত এই পরীক্ষায় সফল হবে।
এদিকে সুজন মনে মনে ভাবছে—যা ডাক শুনেছি রাক্ষসের, সে ত কোনদিন ভুলতে পারব না। এমন যার ডাক, তার চেহারা না জানি কেমন, আর শরীরের শক্তিই বা না জানি কেমন! আজবপুরের রাজকুমার কি পারবে মারতে এই রাক্ষসকে?
পরদিন সকালে সূর্য ওঠার কিছু পরেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে আজবপুরের যুবরাজ জবরনগর এসে হাজির হল। তার গায়ে বর্ম, কোমরে তলোয়ার, পিঠে তূণ, হাতে ধনুক। তাছাড়া ঘোড়ার পাশে খাপের মধ্যে ঢোকানো রয়েছে একটা বল্লম।
এছাড়া রাজকুমারের সঙ্গে ছিল দুইজন অশ্বারোহী, যারা জালে করে শ্মশান থেকে ধরে এনেছিল তিনটে শকুনি। জাল সমেত এই শকুনিগুলোকে ফেলা হবে গুহার মুখে, তাহলেই রাক্ষস বেরোবে—এই ছিল তাদের মতলব।
জবরনগরের বেশ কিছু লোকও গুহার উল্টোদিকে সমতল ভূমিতে জড়ো হয়েছিল এই যুদ্ধ দেখার জন্য। জবরনগরের রাজা নিজে না এলেও, দূত পাঠিয়েছিলেন সংগ্রামের ফলাফল জানার জন্য।
যুবরাজ রণবীর এখন তৈরি। এইবার তার দুজন সহচর জাল সমেত শকুনিগুলিকে গুহার সামনে ফেলে শিঙায় ফু দিয়ে জানিয়ে দিল যে তারা উপস্থিত। তারপর তারা দুইজন সরে গেল, শুধু ঘোড়ার পিঠে রইল রণবীর।
দর্শকের ভীড়ের মধ্যে যারা ছিল তাদের একজনের আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। সে হল সুজন হরবোলা। খবর পেয়ে সে সবার আগেই গিয়ে হাজির হয়েছে গুহার সামনে। কিন্তু কেন সে জানে না, তার মন বলছে যুবরাজ সফল না হলেই ভালো।
কিন্তু কই? রাক্ষস বার হয় না কেন? তার জন্যে এমন টোপ ফেলা হয়েছে, তবুও কেন সে গুহার মধ্যে বসে?
এদিকে যুবরাজের ঘোড়া অস্থির হয়ে ছটফটানি শুরু করেছে। এবার যুবরাজ সাহস করে গুহার দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শিঙাও বেজে উঠল তিনবার, আর তার পরেই সকলের রক্ত হিম করে দিয়ে শোনা গেল এক বিকট হুঙ্কার, যার ফলে যুবরাজের ঘোড়া সামনের পা দুটো আকাশে তুলে যুবরাজকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে উল্টো মুখে দিল ছুট। তখন যুবরাজকেও ছুটতে হল ঘোড়ার পিছনে। বোঝাই গেল সে রাক্ষসের কাছে হার স্বীকার করেছে; যার এমন গর্জন তার সঙ্গে যুদ্ধ করার সাহস যুবরাজের নেই।
ভীড় করে যারা এসেছিল তারাও যে যেদিকে পারে চম্পট দিল। কেবল একজন—সুজন হরবোলা—মুখ গম্ভীর করে কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ, তারপর ধীরপদে ফিরতি পথ ধরল।
রণবীরের পর আরও সাতটি দেশের সাতটি যুবরাজ বিহঙ্গভুক্কে মারতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তার ডাক শুনে পালিয়ে বাঁচল, আর সেই সঙ্গে রাজকন্যার বিয়েও পিছিয়ে যেতে লাগল, রাজার কপালেও দুশ্চিন্তার রেখা দিনে দিনে বাড়তে লাগল।
এই আটজন যুবরাজের শোচনীয় অবস্থা সুজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে; দানবের হুঙ্কারে শুধু ঘোড়ার নয়, ঘোড়সওয়ারের মনেও যে ত্রাসের সঞ্চার হয়েছে সেটা সুজন নিজের চোখে দেখেছে।
এই আটজন হার মানার ফলে আর কোনো দেশের কোনো রাজপুত্র সাহস করে জবরনগরের এই দানব সংহারে এগোতে পারল না।
ন’ দিনের দিন সকাল বেলা রাজা মন্দির থেকে পূজো সেরে যেই বেরিয়েছেন অমনি দেখলেন সুজন হরবোলা তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। রাজার মন খুব খারাপ, তাই গম্ভীর ভাবেই বললেন, ‘কী সুজন, তোর আবার কী প্রয়োজন?’
সুজন বলল, ‘মহারাজ, আমাকে একটা বল্লম দিতে পারেন?’
রাজা হবাক হয়ে বললেন, ‘কেন, কী হবে বল্লম দিয়ে?’
‘আমি বিহঙ্গভুক্কে মারার একটা চেষ্টা দেখব।’
‘তোমার কি মতিভ্রম হল নাকি?’
‘একবার দেখিই না চেষ্টা করে, মহারাজ। সে যখন প্রাণী, তখন তার প্রাণ আছে, আর প্রাণ যদি থাকে তাহলে তার কলিজা আছে। সেই কলিজায় যদি বল্লমটা গেঁথে দিতে পারি ত সে নির্ঘাৎ মরবে।’
‘কিন্তু সে ত গুহা থেকে বারই হয় না।’
‘ধরুন যদি আজ বেরোয়! তার মতিগতি ত কেউ জানে না।’
রাজা একটু ভাবলেন সুজনের দিকে চেয়ে। তার স্বাস্থ্যটা যে ভাল, শরীরে যে শক্তি থাকার সম্ভাবনা, সেটা তাকে দেখলে বোঝা যায়।
অবশেষে রাজা বললেন, ‘ঠিক আছে, বল্লমের অভাব নেই। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তোর হাবভাবে মনে হয় তুই এ কাজটা না করে ছাড়বি না।’
বল্লম জোগাড় হল অল্পক্ষণের মধ্যেই। এবার সুজন ঘোড়াশাল থেকে একটা ঘোড়া নিয়ে বল্লম হাতে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে আকাশীর দিকে রওনা দিল।
এদিকে রাজার সুজনের উপর একটা মমতা পড়ে গেছে; ছেলেটার কী হয় দেখবার জন্য তিনিও ব্যস্ত হয়ে একটা ঘোড়ায় চড়ে চললেন পাহাড়ের দিকে।
সুজন গুহার সামনে পৌঁছনর আগেই ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিল। সে জানে সে যদি ঘোড়ার পিঠে থাকে তাহলে ঘোড়া ভয় পেয়ে ছুট দিলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে পালাতে হবে।
গুহার ভিতরে দিনের বেলা রাতের মতো অন্ধকার, কারণ গুহাটা উত্তরমুখী।
ইতিমধ্যে রাজাও পৌঁছে গেছেন; তিনি একটু দূর থেকে ঘোড়ার পিঠে চেপেই ঘটনাটা দেখবেন। আজ লোকের ভিড় নেই, কারণ শহরে ঢ্যাঁড়া পড়ে গেছে যে আর কোনো রাজপুত্র রাক্ষসকে মারতে আসবে না।
সুজন হাতে বল্লম নিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল গুহার দিকে। চারিদিক নিস্তব্ধ। পাখি নেই, তাই এই অবস্থা, না হলে সকালে পাখি না ডেকে পারে না।
এবার সুজন ঠাকুরের নাম জপ করে একবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে বিরাট একটা দম নিয়ে সেই দম ছাড়ার সময় তার সমস্ত শক্তি দিয়ে এই নদিনে শেখা একটা ভয়ঙ্কর ডাক ছাড়ল। এই ডাকে রাজার ঘোড়া ভড়কে গিয়ে লাফ দিয়ে উঠেছিল, কিন্তু রাজা কোনো মতে তাকে সামলালেন।
এইবার এল সেই হুঙ্কারের জবাব—আর সেই সঙ্গে গুহা থেকে এক লাফে বাইরে রোদে এসে পড়ল যে প্রাণীটা সেটা মানুষ না রাক্ষস না জানোয়ার তা কেউই সঠিক বলতে পারবে না। বরং বলা চলে তিনে মিশে এক কিম্ভূত কিমাকার প্রাণী যাকে দেখলে মানুষের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়।
সুজন হরবোলা কিন্তু আর কিচ্ছু দেখল না, দেখল শুধু প্রাণীটার যেখানে কলিজাটা থাকার কথা সেই জায়গাটা। সেটার দিকে তাগ করে সে প্রাণপণে চালিয়ে দিল তার হাতের বল্লমটা। তারপর আর তার কিছু মনে নেই।
জ্ঞান হয়ে চোখ খুলে সুজন প্রথমেই দেখতে পেল সেই মুখটা যেটা আঁকা ছবিতে দেখে তার মনটা নেচে উঠেছিল।
শ্রীমতীর পাশেই রাজা দাঁড়িয়ে; বললেন; ‘রাক্ষস মরেছে, তাই তোমার হাতেই দিলাম আমার মেয়েকে। আজ থেকে সাতদিন পরে বিয়ের লগ্ন। তোমার বাপ-মাকে খবর দিতে লোক যাবে ক্ষীরা গ্রামে। তারাও এখানেই থাকবে বিয়ের পর, আর তুমিও থাকবে।
‘আর আমার লেখাপড়া?’
শ্ৰীমতী হেসে বলল, ‘আমি বলেছি সে ভার আমার। পাঁচের নামতা দিয়ে শুরু—বিয়ের পর দিন থেকেই। আর যদ্দিন না দেশে পাখি আসছে তদ্দিন তুমি আমাকে পাখির ডাক শোনাবে।’
‘তাহলে একটা কথা বলি?’
‘বলো।’
‘তুমি আর ঘরের মধ্যে বন্দী থেকো না।’
‘না, আর কোনোদিন না।’
‘আর তোমার হীরামনটাকে ছেড়ে দাও। খাঁচায় পাখি রাখতে নেই। ওরা আকাশে উড়তে পারে না; ওদের বড় কষ্ট হয়।’
শ্ৰীমতী মাথা নেড়ে বলল, ‘বেশ, তাই হবে।’