॥ ৩ ॥
সুজন এই ঘটনার পর আর সময় নষ্ট না করে প্রাসাদে তার ঘরে ফিরে এসেছিল। পরদিন সকালে একজন কর্মচারী এসে তাকে রাজার সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে গেল। রাজা এখনো সভায় যাননি। আগে তাঁর মেয়েকে শোনাবেন সুজনের পাখি আর জানোয়ারের ডাক, তারপর রাজকার্য। সুজন বুঝল মেয়ের উপর রাজার কত টান।
এদিকে রাজকন্যা শ্রীমতী কাল রাত্রেই শুনেছে সুজনের কথা—কী ভাবে বাঘের ডাক ডেকে সে জঙ্গলে বাঘ আছে প্রমাণ করে দিয়েছিল। শ্ৰীমতী এক বেড়াল ছাড়া কোনোদিন কোনো জানোয়ারের ডাক শোনেনি। পাখি যখন ছিল শহরে—আজ থেকে পাঁচ বছর আগে—তখনও সে তার হীরামন ছাড়া কোনো পাখির ডাক শোনেনি। ঘর থেকে সে বাইরেই বেরোত না, শুনবে কি করে? সে যে অসূর্যম্পশ্যা। যে সূর্যকে দেখেনি, তার ত প্রকৃতির সঙ্গে চোখের দেখাই হয় নি। অবিশ্যি বই পড়ে সে অনেক কিছুই জেনেছে, কিন্তু বইয়ে আর কত জানা যায়? চোখে দেখা আর কানে শোনায় যা হয়, শুধু বই পড়ে কি তা হয়? বাংলার পাখির নাম শ্রীমতীর মুখস্থ, কিন্তু সে সব পাখি কেমন ডাক ডাকে, কেমন গান গায়, তা সে কানে শোনেনি কখনো।
সুজন যখন গিয়ে অন্দর মহলের আঙিনায় পৌঁছাল, তখন শ্রীমতী তার ঘর থেকে আরেকটা ঘরে এসে বসেছে। এঘরে একটা খোলা জানালা আছে, তাই দিয়ে আঙিনায় কোনো গান বাজনা হলে তার আওয়াজ শোনা যায়। সেই আঙিনাতেই এই হরবোলা তার কারসাজি দেখাবে।
দেউড়িতে আটটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই রাজামশাই সুজনকে বললেন, ‘কই, শুরু কর এবার তোর খেলা! আমার মেয়ে উপরে বসে আছে, সে শুনতে পাবে।’
কালটা বসন্ত, তাই সুজন পাপিয়া আর দোয়েলের ডাক দিয়ে শুরু করল। মানুষের গলায় এমন আশ্চর্য পাখির ডাক কেউ শোনেনি কখনো। পাঁচ বছর পরে এই প্রথম জবরনগরে পাখির ডাক শোনা গেল।
শুরুতেই রাজকন্যার চোখে জল এসে গেছে। চাপা স্বরে বলল শ্ৰীমতী, ‘আহা কী সুন্দর! পাখি এমন করে ডাকে? আর এই পাখিরা সব গেছে সেই রাক্ষসের পেটে? কী অন্যায়! কী অন্যায়!’
সুজন একটার পর একটা ডাক শুনিয়ে চলল। রাজার বুক গর্বে ভরে উঠল, আর রাজকন্যার প্রাণ ছটফট করতে লাগল। এমন যার ক্ষমতা, তাকে একবার চোখে দেখা যায় না?
ঘরের বাইরে বারান্দা, সে বারান্দা বাহারের কাপড় দিয়ে ঢাকা। সেই কাপড়ের এক পাশ ফাঁক করলে তবে নীচে দেখা যেতে পারে। রাজকন্যার পাশে তার সখী বসা, তাকে একবার ঘর থেকে সরানো দরকার। ‘সুরধুনী, আমার জলতেষ্টা পেয়েছে. একটু খাবার জল এনে দে,’ বলল রাজকন্যা।
জল আনতে সেই শোবার ঘরে যেতে হবে, তাতে কিছুটা সময় যাবে।
সুরধুনী চলে গেল।
শ্ৰীমতী এক ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে এসে কাপড় ফাঁক করে দেখে নিল সেই ছেলেটিকে। সে এখন ফটিক-জলের ডাক ডাকছে। শ্ৰীমতীর দেখে বেশ ভালো লাগল ছেলেটিকে; তবে এটা সে বুঝল ছেলেটির পোষাকে যে সে গরিব।
সুরধুনী জল নিয়ে আসার আগেই শ্ৰীমতী তার জায়গায় ফিরে এসেছে।
এক ঘণ্টা চলল সুজনের হরবোলার খেলা। এমন খেলা জবরনগরের রাজবাড়িতে কেউ কোনোদিন দেখেনি। আর রাজকন্যা ত এমন সব ডাক শোনেইনি; তার চোখের সামনে একটা নতুন জগৎ খুলে গেছে—প্রকৃতির জগৎ, যার সঙ্গে এই ষোল বছরে তার কোনোদিন পরিচয়ই হয়নি। এই গরীব ঘরের ছেলেটি তার জীবনে একটা নতুন প্রাণ এনে দিয়েছে।
এই সব ভাবতে ভাবতেই শ্রীমতীর মনে পড়ল যে আসছে মাসে তার বিয়ে। যাকে সে বিয়ে করবে, সেই যুবরাজ রণবীর কথা দিয়েছে যে শ্রীমতীর পড়াশুনার ব্যবস্থা তার বাড়িতেও হবে। আর তার জন্য অন্দর মহলের ভিতরে একটা ঘর রাখবে যাতে সূর্যের আলো কখনো প্রবেশ না করে। আলো লেগে রাজকন্যার রং যদি কালো হয়ে যায়!
সুজন কিন্তু রাজকন্যাকে দেখতে পায়নি। রাজা তাকে একটা হাতে আঁকা ছবি দেখিয়ে বলেছেন, ‘এই দেখ আমার মেয়ের চেহারা।’ ছবি দেখেই সুজনের মনে হয়েছে এ যেন স্বর্গের অপ্সরী। তারপর সুজন যখন শুনল যে রাজকন্যা তার হরবোলার ডাক শুনে মোহিত হয়ে গেছে, তখন গর্বে তার বুকটা ভরে উঠল। আর তাছাড়া রাজামশাই ইনামও দিয়েছেন ভালো; একটা হীরের আংটি আর একশত স্বর্ণমুদ্রা। সুজন জানে, এই টাকায় তাদের বাকী জীবনটা স্বচ্ছন্দে চলে যাবে।
কেবল একটা কথা ভেবে তার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ওই রাক্ষসটাকে যদি সায়েস্তা করা যেত!