শিশুর সরলতা – লিও টলস্টয়

শিশুর সরলতা
– লিও টলস্টয়

সেবার বড়দিন পর্ব বেশ আগে শুরু হয়েছে। বাগানে তখনও তুষার জমে, গ্রামের রাস্তায় তুষার গলে পানির স্রোত বয়ে যায়। 

দুটি বাড়ির মধ্যে সরু একটি গলি। সেখানে দেখা হল দুবাড়ির দুটি মেয়ের। বাড়ির ময়লা পানি জমে ছোট একটা ডোবার মতো হয়েছে গলিটায়। একটা মেয়ে খুবই ছোট, আর আরেকটি একটু বড়। দুজনার মা-ই বেশ নতুন জামা-কাপড় পরিয়ে দিয়েছে তাদের। ছোট মেয়েটির কাপড়ের রং নীল, বড়টির হলদে। এ ছাড়া দুজনার মাথায় জড়ানো লাল রুমাল। এইমাত্র তারা গির্জা থেকে ফিরেছে। প্রথমে একে অপরকে তারা নিজের জামা-কাপড় দেখাল, তারপর শুরু করল খেলতে। একটু পরেই তাদের ইচ্ছে হল পানি ছিটাছিটি করবে। ছোটমেয়েটি তো জামাকাপড় আর জুতো পরেই নেমে যাচ্ছিল, তাকে থামাল বড়মেয়েটি। সে বলল, অমন করে পানিতে নেমো না মালাশা, তোমার মা রাগ করবেন। আমি আমার জুতো-মোজা খুলে রাখছি, তোমারটাও তুমি খুলে ফ্যালো। 

তাই হল, জুতো-মোজা খুলে পানিতে গিয়ে নামল তারা হাটু অবধি ঘাগরা উচু করে। পানিতে হেঁটে একজন অন্যজনের দিকে যেতে লাগল। মালাশার পা অবধি পানিতে ডুবে গেছে। সে বলে উঠল, আমার ভয় করছে আকুলিয়া; পানি মনে হয় অনেক। 

আকুলিয়া বলল, চলে এসো না! ভয় নেই। এর চেয়ে বেশি পানি কোথাও নেই। 

তারা যখন অনেকটা কাছাকাছি এসেছে তখন আকুলিয়া বলল, সাবধান মালাশা, পানি ছিটিও না যেন! সাবধানে হেঁটো। 

তার কথা যেই শেষ হয়েছে অমনি মালাশার পা-টা এত জোরে পড়েছে যে খানিকটা পানি ছিটকে গিয়ে আকুলিয়ার জামা কাপড়ে তো লেগেছেই, মুখে-চোখেও লেগেছে। 

জামা-কাপড়ের এ দুরবস্থা দেখে রেগে সে মারতে গেল মালাশাকে। মালাশা দেখল, মহা মুশকিল! ভয় পেয়ে সেও ওখান থেকে উঠে দৌড়াতে লাগল বাড়ির দিকে। 

ঠিক সে সময়ে আকুলিয়ার মা সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। মেয়ের কাপড়-জামায় ময়লা পানির দাগ দেখে সে রেগে উঠল, লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে, কাপড়-জামার এরকম ছিরি করলি কী করে? 

মেয়ে বলল, মালাশা ইচ্ছে করে এরকম করে দিয়েছে। 

আকুলিয়ার মা একথা শুনেই মালাশাকে ধরে এনে এক থাপ্পড় মেরে দিল তার ঘাড়ে। মালাশাও এমন জোরে কেঁদে উঠল যে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশ অবধি তার চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল। তখন মালাশার মা-ও এল রাস্তায় বেরিয়ে। এসেই সে বলে উঠল, ‘আমার মেয়েটাকে মেরেছ কেন গো?’ বলেই চেঁচামেচি শুরু করল। দেখতে দেখতে তুমুলভাবে বেধে উঠল ঝগড়া। বাড়ির পুরুষরাও দৌড়ে এসে জমায়েত হল রাস্তায়। সবাই কথা বলছে প্রাণপণ চিৎকার করে, কারো কথা কেউ শুনছে না। ঝগড়া চলতেই লাগল। একজন আরেক জনের গায়ে একটু ধাক্কা দিতেই মারামারি শুরু হয় আর কী! এমন সময় বেরিয়ে এল আকুলিয়ার বুড়ো দাদি। সবাইকে শান্ত হবার উপদেশ দিয়ে বুড়ি বলল, তোমরা এ কী শুরু করেছ বাছারা! এরকম করা কি ঠিক হচ্ছে, বিশেষ করে আজকের মতো ইস্টারের দিনে? পরব আসে আনন্দ করবার জন্যে, ঝগড়া করবার জন্যে তো নয়। 

বুড়ির কথা তখন কে শুনবে? তাদের ধাক্কায় বুড়ি প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। ঝগড়া থামাবে এমন সাধ্যই ছিল না বুড়ির।

অবশেষে সে ঝগড়া আবার থামল মালাশা আর আকুলিয়ার কারণেই। মায়েরা তখনও গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করছিল একে অন্যের সঙ্গে। সেই সুযোগে আকুলিয়া জামার ময়লা ধুয়ে আবার গিয়ে ডোবায় নেমেছে। সরু মাথঅয়ালা এক টুকরো পাথর নিয়ে সে মাটি খুঁড়ছিল ডোবার পানি রাস্তায় গড়িয়ে আনবে আশায়। তাই দেখে মালাশাও ওর সঙ্গে এসে যোগ দিল। ছোট একখানা লাঠি নিয়ে সে মাটি-খোড়ার কাজে আকূলিয়াকে সাহায্য করতে লাগল। লোকগুলো যখন মারামারি শুরু করতে যাচ্ছে ঠিক এমনি সময় পানি এসে রাস্তায় পড়ল। ঠিক যেখানে দাড়িয়েছিল তারা, আর বুড়ি যেখানে দাড়িয়ে তাদের ভেতর মিটমাটের চেষ্টা করছিল সেখান অবধি এল পানি। মালাশা তার হাতের লাঠিখানা ফেলে দিয়েছে স্রোতের মুখে। স্রোতের দুপাড় দিয়ে চলছে মেয়েদুটি সেই লাঠির পিছু পিছু।

আকুলিয়া চিৎকার করছে, ধরো মালাশা, লাঠিটা ধরো।

মালাশাও এমন হাসি হাসছিল যে, হাসির চোটে কথা বলতে পারছিল না। 

আনন্দে আত্মহারা হয়ে তারা লাঠির পিছনে ছুটতে ছুটতে লোকগুলোর কাছেই এসে পড়ল। তাই দেখে বুড়ি লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাদের কি এতটুকুও লজ্জা করছে না? তোমরা ঝগড়া করছ যাদের নিয়ে তারা কিনা দিব্যি সব ভুলে গিয়ে আবার মনের আনন্দে খেলায় মেতেছে। আহা সোনার চাঁদ বাছারা, বড়দের চেয়ে তোদের জ্ঞানবুদ্ধিই না- জানি বেশি। 

লোকগুলো মেয়েদুটির দিকে চেয়ে লজ্জিত হল। তারা তখন হাসাহাসি করতে করতে চলে গেল যে যার ঘরের দিকে।

শিশুর মতো সরল যে হতে পারবে না, তার ঠাই কখনো স্বর্গে হবে না। 


পোস্টটি শেয়ার করুন