রসগোল্লা – সৈয়দ মুজতবা আলী
রসগোল্লা
– সৈয়দ মুজতবা আলী
আমার এক বন্ধু প্রায়ই ইউরোপ-আমেরিকায় যান। এতই বেশি যাওয়া আসা করেন যে তার সঙ্গে কোথাও দেখা হলে বলবার উপায় নেই, তিনি বিদেশে যাচ্ছেন না ফিরে আসছেন।
ঝান্ডুদা ব্যবসায়ী লোক। তিনি নেমেছেন ইতালির ভেনিস বন্দরে জাহাজ থেকে। চুঙ্গিঘরের যাবতীয় প্রশ্নের সদুত্তর দিয়ে শেষটায় লিখেছেন, এক টিন ভ্যাকুয়াম প্যান্ড মিষ্টান্ন। মূল্য দশ টাকা।
ঝান্ডুদার বাক্স-পেঁটরায় এত সব জাত-বেজাত হোটেলের লেবেল লাগানো থাকত যে, অগ ও বুঝতে পারত এগুলোর মালিক বাতুভিটার তোয়াক্কা করে না। তার জীবন কাটে হোটেলে হোটেলে। আন্ত লা কিন্তু সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে আরমভ করলে, প্রথম ভাগের ছেলে যে-রকম বানান ভুল করে করে বই পড়ে। লোকটার চেহারাও বদখত। টিঙটিঙে রোগা, গাল দুটো ভাঙা।
চুঙ্গিওলা শুধালে, ওই টিনটার ভেতর কী?
– সুইটস।
– ওটা খুলুন।
– সে কী করে হয়? ওটা আমি নিয়ে যাব লন্ডনে। খুললে বরবাদ হয়ে যাবে যে! চুঙ্গিওলা যেভাবে ঝান্ডুদার দিকে তাকালেন তাতে যা টিন খোলার হুকুম হল, পাঁচশ টেরা পিটিয়ে কোনো বাদশাও ওরকম দুকুমজারি করতে পারতেন না।
ঝান্ডুদা মরিয়া হয়ে কাতর নয়নে বললেন, ‘ব্রাদার, এ টিনটা আমি নিয়ে যাচ্ছি আমার এক বন্ধুর মেয়ের জন্য লন্ডনে, এটা খুললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এবার চুঙ্গিওলা যেভাবে তাকালে, তাতে আমি হাজার স্ট্র্যাটরার শব্দ শুনতে পেলুম।
বিরাট-লাশ ঝান্ডুদা পিঁপড়ের মতো নয়ন করে সকাতরে বললেন, ‘তাহলে ওটা ডাকে করে লন্ডন পাঠিয়ে দাও, আমি ওটাকে সেখানেই খালাস করব।’
কিন্তু আশ্চর্য, চুঙ্গিওলা তাতেও রাজি হয় না। আমরা সবাই কাইটাকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম, ঝান্ডুদার প্রস্তাবটি
অতিশয় সমীচীন এবং আইনসঙ্গতও বটে। চুঙ্গিওলার ভাবখানা সে পৃথিবীর কোনো ভাষাই বোঝে না।
ঝান্ডুদা তখন চটেছেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘তবে খুলছি। কিন্তু ব্যাটা তোমাকে না খাইয়ে ছাড়ছি নে।’
তারপর ইংরেজিতে বললেন, ‘কিন্তু তোমাকে ওটা নিজে খেয়ে পরখ করে দেখতে হবে।’ ওটা সত্যি সুইটিস কিনা।
শয়তানটা চট করে কাউন্টারের নিচ থেকে টিন-কাটার বের করে দিল। ঝান্ডুদা টিন-কাটার হাতে নিয়ে ফের চুঙ্গিওলাকে বললেন, ‘তোমাকে কিন্তু ওই মিষ্টি পরখ করতে হবে নিজে, আবার বলছি।’
চুঙ্গিওলা একটু শুকনো হাসি হাসল। শীতে বেজায় ঠোঁট ফাটলে আমরা যেরকম হেসে থাকি।
ঝান্ডুদা টিন কাটলেন।
কী আর বেরুবে? বেরুল রসগোল্লা। কাঁটাচামচের তোয়াক্কা না করে রসগোল্লা হাত দিয়ে তুলে প্রথমেই বিতরণ করলেন বাঙালিদের। তারপর যাবতীয় ভারতীয়দের, তারপর সবাইকে অর্থাৎ ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, এবং স্পাইনিয়ার্ডদের।
তামাম চুঙ্গিঘর তখন রসগোল্লা গিলছে। আকাশে বাতাসে রসগোল্লা। চুঙ্গিঘরের পুলিশ বরকন্দাজ চাপরাশি সকলেরই হাতে রসগোল্লা।
ওদিকে দেখি, ঝান্ডুদা আপন ভূঁড়িটি কাউন্টারের ওপর চেপে ধরে চুঙ্গিওলার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলছেন বাংলাতে ‘একটা খেয়ে দেখ।’ হাতে তার একটি সরেস রসগোল্লা।
চুঙ্গিওলা ঘাড়টা একটু পেছনের দিকে হটিয়ে গভীর রূপ ধারণ করেছে। ঝান্ডুদা নাছোড়বান্দা। সামনের দিকে আর একটু এগিয়ে বললেন, “দেখছ তো, সবাই খাচ্ছে। চেখে দেখ, এ বস্তু কী?
চুঙ্গিওলা ঘাড়টা আরও পিছিয়ে নিল। লোকটা অতি পাষণ্ড। একবারের তরে ‘সরি-টরি’ও বলল না।
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, ঝান্ডুদা তামাম হুঁড়িখানা কাউন্টারের ওপর চেপে ধরে ক্যাঁক করে পাকড়ালেন চুঙ্গিওলার কলার বাঁ হাতে, আর ডান হাতে থেবড়ে দিলেন একটা রসগোল্লা ওর নাকের ওপর। আর সঙ্গে সঙ্গে মোটা গলায় বললেন, ‘তুমি খাবে না? তোমার গুষ্টি খাবে। ব্যাটা, তুমি মস্করা পেয়েছ? পইপই করে বললুম, রসগোল্লাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে, তা তুমি শুনবে না!’
ততক্ষণে কিন্তু তাবৎ চুঙ্গিঘরে লেগে গেছে ধুধমার। আর চিঙ্কার চেঁচামেচি হবেই না কেন? এ যে রীতিমতো বেআইনী কর্ম। কর্মটির জন্য আকছারই জেলে যেতে হয়।
ঝান্ডুদার কোমর জাবড়ে ধরে আমরা জনাপাঁচেক তাকে কাউন্টার থেকে টেনে নামাবার চেষ্টা করছি। তিনি পর্দার পর পর্দা চড়াচ্ছেন, ‘খাবিনি, ও পরান আমার, খাবিনি ব্যাটা।’ চুঙ্গিওলা ক্ষীণকষ্ঠে পুলিশকে ডাকছে। কিন্তু কোথায় পুলিশ? চুঙ্গিঘরের পাইক, বরকন্দাজ, ডাণ্ডাবরদার, আসসরদার বেবাক চাকর-নফর বিলকুল বেমালুম গায়েব। এ কি ভানুমতী, এ কি ইন্দ্রজাল।।
ইতোমধ্যে ঝান্ডুদাকে বহকষ্টে কাউন্টারের এদিকে নামানো হয়েছে। চুঙ্গিওলা রুমাল দিয়ে রসগোল্লার থ্যাবড়া মুছতে যাচ্ছে দেখে তিনি চেঁচিয়ে বললেন, ‘ওটা মুছিসনি, আদালতে সাক্ষী দেবে।’
কে একজন ঝান্ডুদাকে সদুপদেশ দিল, ‘পুলিশ ফের এসে যাবে। ততক্ষণে আপনি কেটে পড়ুন।’
তিনি বললেন, ‘না, ওই যে লোকটা ফোন করছে। আসুক না ওদের বড়কর্তা।’
তিন মিনিটের ভেতর বড়কর্তা ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন। ঝান্ডুদা বড় সাহেবের সামনে গিয়ে বললেন, ‘সিন্নোর, বিফো ইউ প্রসিড, অর্থাৎ কিনা ময়না তদন্ত আরম্ভ হওয়ার পুর্বে আপনি একটি সুইটস চেখে দেখুন।’ বলে নিজে মুখে তুললেন একটি, আমাদের সবাইকে আরেক প্রস্থ বিতরণ করলেন। বড়কর্তা একটি মুখে তুলেই চোখ বন্ধ করে রইলেন আড়াই মিনিট। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই আবার হাত বাড়িয়ে দিলেন। ফের আবার।
টিন তখন ভোঁ ভোঁ ।
চুঙ্গিওলা তার ফরিয়াদ জানাল।
কর্তা বললেন, ‘টিন খুলেছ তো বেশ করেছ, না হলে খাওয়া যেত কী করে?’ আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখানে দাড়িয়ে আছেন কী করতে? আরও রসগোল্লা নিয়ে আসুন।’ আমরা সুড়সুড় করে বেরিয়ে যাবার সময় শুনতে পেলুম। বড়কর্তা চুঙ্গিওলাকে বলছেন, ‘তুমিও তো একটা আস্ত গাড়ল। টিন খুললে আর এই সরেস মাল চেখে দেখলে না?’
আমি গাইলুম,
রসের গোলক, এত রস কেন তুমি ধরেছিলে হায়।
ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়।