দুই মুসাফির – শওকত ওসমান

উভয়ের সারা বদনে দৃষ্টি বুলিয়ে তিনি দ্বিতীয় পথিককে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী বলছিলেন?

-এই আগান-বাগান ইমারত সব আমার।

-আপনার নাম কী?

সোবহান জোয়ার্দার। 

ঐ ব্যক্তি একচোট হো-হো শব্দে খুব হেসে নিলেন, তারপর বেশ রুক্ষ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, জোয়ার্দার? বাপের নামটা ঠিক মনে আছে তো?

-নিশ্চয় আছে। গোলাম রহমান জোয়ার্দার।

লোকটা আবার হাসতে লাগলেন। কিন্তু এবার হাসি হঠাৎ থামিয়ে বেশ তিরিক্ষি মেজাজে বললেন, আপনার মাথা ঠিক আছে তো?

বিস্ময়ে দ্বিতীয় মুসাফির পাল্টা প্রশ্ন করেন, – কেন? 

-মাথা ঠিক আছে বলে তো মনে হয় না। জোয়ার্দার বলে এই গায়ে কোনো গাধা পর্যন্ত নেই। মানুষ তো দূরের কথা।

-মিথ্যে কথা। এ সব আমার। সব আমার। তুমি কে হে?

-মুখ সামলে ভদ্রলোকের মতো কথা বল। আপনি থেকে তুমি? আমার নাম সোলেমান মল্লিক। এই সব জমি-জিরাত, ইমারত-কোঠা, যা কিছু দেখছ সব আমার।

-এ সব আমার। চুপ চোর-জোচ্চোর কোথাকার।

-কী ! আমার জিনিস, আর আমি চোর-জোচ্চোর?

– যা ব্যাটা । এখনও তোর গায়ে হাত তুলিনি, তোর বাপের নসিব। যা মানে মানে পালা। না হলে জুতো খাবি, আবার পুলিশের হাতকড়া পর্যন্ত হাতে উঠবে। 

– তুমি ঝুট কথা বলছ। দ্বিতীয় মুসাফিরের মুখ থেকে এই প্রশ্ন বেরুনো মাত্র ঐ লোকটা এক থাপড় তুলে এগিয়ে এল। এবার প্রথম মুসাফির মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার সৌম্য মুখের দুদিকে চেয়ে সোবহান মল্লিক হাত নামিয়ে নিল।

দ্বিতীয় পথিক অর্থাৎ জোয়ার্দার চিৎকার করে ওঠে,-না, এ জমি জায়গা আমার।

মল্লিক আবার থাপড় তুলে শাসায়। মাঝখানে প্রথম মুসাফির। এই গোলমাল শুনে কয়েকজন লাঠি নিয়ে ছুটে এল। একজন বলল, বড়মিয়া সাহেব, আপনার গলা শুনে ছুটে এলাম। কী ব্যাপার?

আঙুল বাড়িয়ে মল্লিক জবাব দিল, ঐ ফকিরের পেছনে ওই যে দাঁড়িয়ে আছে, জোয়ার্দার না ফোয়ার্দার নাম কেউ এলাকায় কোনোদিন শোনেনি, ব্যাটা বলে- এসব জমি-জায়গা, বাগান-দিঘি ওর। ব্যাটার আস্পর্ধা দ্যাখ।

-একবার হুকুম দিন না। মাথাটা একদম বাইন-মাছ ছেচা করে দিই। সমস্বরের মধ্যে অন্যান্য আদেশ প্রার্থনার বুলি তলিয়ে গেল। 

জোয়ার্দার তখন অবস্থার আঁচ পেয়ে আর মুখ খোলেন না। মুখ খুললেন ফকির নামে সম্বোধিত প্রথম মুসাফির। তিনি বললেন, ভাই ইনি আমার সঙ্গী। আপনাদের জমি-জিরাতের মামলা সেটা আদালতে ইনসাফ হতে পারে। ও নিয়ে বিবাদ ভালো নয়। ওকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। তার আগে আপনাদের একটি গান শুনিয়ে দিই। মল্লিক শান্ত হয়ে এসেছে এই প্রস্তাবে। বলল, জনাব ফকির সাহেব, একটা ডাব খেয়ে নিন। আপনি ক্লান্ত বেশ বোঝা যাচ্ছে। পরে গান করুন।

-না ভাই, আমি ক্লান্ত নই। আমার অত ভুক-পিপাস ঘন ঘন লাগে না।

-তবে বসুন। 

না, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাইতে আনন্দ পাই।

গান শুরু হল :

মানুষ রে দেখরে ভাই দিব্যজ্ঞানে।
পাবিরে অমূল্য নিধি, এই বর্তমানে।।
ম’লে পাব বেহেস্তখানা, 
তা শুনে আর মন মানে না।
লালন কয় বাকির লোভে নগদ পাওনা 
কে ছেড়েছে এই ভুবনে।।

পড়ন্ত দুপুর। রৌদ্রের রিম ঝিম উত্তাপ সুরের মোচড়ে মূর্ঘনার সঙ্গ অভিলাষী। বায়ু তরঙ্গ সকলের বক্ষ-সৈকতে সুরাবেশে বারবার আছড়ে পড়ে।

অনেক লোক জমেছে ইত্যবসরে। সুরের ইন্দ্রজালে কাজ ফেলে এসেছে কতজন। ছোটখাট জমায়েৎ পাড়ের ওপর। তম্ভিত শ্রোতাদল।

সোলেমান মল্লিক গান থামার পর জিজ্ঞেস করে, জনাব আমার বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনার নাম?

-আমার নাম লালন ফকির।

-কুষ্টিয়ার লালন ফকির?

-হ্যা ভাই।

গ্রামের জমায়েত লোকদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। একজন চিৎকার দিয়ে গ্রামের দিকে ছুটতে লাগল-ওরে কে কোথায় 

আছিস, লালন ফকির ফিরে এসেছেন, ওরে আয় । গান শুনবি। আয়, চোখ সার্থক করবি-আয় আয়। 

বিলম্ব হয় না। দলে দলে লোক ছুটতে লাগল। ফকির বিস্মিত। একজন এগিয়ে এসে বলল, জনাব, দাদা- পরদাদার কাছে আপনার নাম শুনেছি, গান শুনেছি। আপনাকে ছেড়ে দেব না। এখানে জায়গা কম। চলুন দশ মিনিটের পথ গঞ্জ। গঞ্জে চত্বরে হাজার হাজার লোক ধরে, সেখানে আপনাকে যেতে হবে। 

– চলুন।

ফকির এইটুকু উচ্চারণ করেন মাত্র। তারপরই কয়েকজন তাঁকে কাঁধে তুলে নিল। ফকিরকে পায়ে হাঁটতে দেবে না। তাঁর হাজার অনুরোধ আর কেউ কানে নেয় না। ছোট জনস্রোত নানাদিক থেকে ছুটে আসছে। লালন ফকির বললেন, আমার সঙ্গী যেন হারিয়ে না যান। এতক্ষণে জোয়ার্দারের দিকে সকলের চোখ পড়ে। তিনি ফকিরের পাশেই আছেন।

হাজার হাজার জনতা গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে এসে জুটছে। সকলের মুখে মুখে সেই অপূর্ব কাহিনীর গুঞ্জন, কবি লালন ফকির আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন। লোকারণ্য বিস্তৃত হতে থাকে গঞ্জের চত্বরে, চতুর্দিকে।

মাঝখানে গানের আসর। গেরুয়াবসন কবির কণ্ঠ ও একতারা নিনাদিত। অভিনয় সহকারে বাউল ফকির মেতে উঠেছেন। স্তব্ধ জনতা। নির্বাক পৃথিবী। সুর আর সুধার পার্থক্য কতটুকু?

।। ২।। 

জোয়ার্দার : কবি।। 

লালন : কী ভাই? 

জোয়ার্দার : আমি ভেবেছিলাম, আজ রাত্রি কেন, বহু রাত্রি তোমাকে বন্দি থাকতে হবে এখানে।

লালন : তা তো থাকার যো নেই। আমি বলে এসেছি, ইহলোকে একদিন থাকব। আজ ভোরেই নিজের ঠিকানায় পৌঁছব। বাইরে আসার নাম করে, চলে এলাম। ওই শুকতারা উঠছে। চল, বাতাসে মিলিয়ে যাই।

জোয়ার্দার : আমিও তো একদিনের ছুটি নিয়ে পৃথিবী দেখতে এসেছিলাম।

লালন : কী দেখলে?

জোয়ার্দার : আমাকে কেউ চেনে না, নাম পর্যন্ত জানে না।

লালন : আর কী দেখলে?

জোয়ার্দার : আর কিছু না।

লালন : যুগে যুগে তোমাদের এই আর এক দোষ।

জোয়ার্দার : কী?

লালন : দেখলে না কিছু? 

জোয়ার্দার : কী দেখলে?

লালন : দেখলে না? দেখলে না, একদিন তোমার কত কী, কত কে ছিল, আমার কিছুই ছিল না। আজ আমার সব আছে- অথচ তোমার কিছুই নেই। 


পোস্টটি শেয়ার করুন