একজন ক্রীতদাস – হুমায়ূন আহমেদ
একজন ক্রীতদাস
– হুমায়ূন আহমেদ
কথা ছিল পারুল নটার মধ্যে আসবে।
কিন্তু এল না। বারােটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম একা একা । চোখে জল আসবার মতাে কষ্ট হতে লাগল আমার। মেয়েগুলি বড় খেয়ালী হয়।
বাসায় এসে দেখি ছােট্ট চিরকুট লিখে ফেলে গেছে। সন্ধ্যায় ৬৯৭৬২১ নম্বরে ফোন করাে—পারুল।”
তাদের পাশের বাড়ির ফোন। আগেও অনেকবার ব্যবহার করেছি। কিন্তু আজ তাকে ফোনে ডাকতে হবে কেন? অনেক আলাপআলােচনা করেই কি ঠিক করা হয় নি আজ সােমবার বেলা দশটায় দুজন টাঙ্গাইল চলে যাব। সেখানে হারুনের বাসায় আমাদের বিয়ে হবে।
সারা দুপুর শুয়ে রইলাম। হােটেল থেকে ভাত এনেছিল । সেগুলি স্পর্শও করলাম না। ছােটবেলায় যেরকম রাগ করে ভাত না-খেয়ে থেকেছি আজও যেন রাগ করবার মতাে সেরকম একটি ছেলেমানুষি ব্যাপার হয়েছে। পারুলের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়েছে’— এই ভাবতে-ভাবতে নিজেকে খুব তুচ্ছ ও সামান্য মনে হতে লাগল। সন্ধ্যাবেলা টেলিফোন করবার জন্যে যখন বেরিয়েছি তখন অভিমানে আমার ঠোট ফুলে রয়েছে। গ্রিন ফার্মেসির মালিক আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, ‘অসুখ নাকি ভাই?’
আমি শুকনাে গলায় বললাম, ‘একটা টেলিফোন করব।’
পারুল আশেপাশেই ছিল। রিনরিনে ছয়-সাত বছর বয়েসের ছেলেদের মতাে গলা যা শুনলে বুকের মধ্যে সুখের মতাে ব্যথা বােধ হয়।
‘হ্যালাে শোন, কিন্ডারগার্টেনের মাস্টারিটা পেয়েছি। শুনতে পাচ্ছ আমার কথা? বড় ডিস্টার্ব হচ্ছে লাইনে।’
পারুলের উফুল্ল সতেজ গলা শুনে আমি ভয়ানক অবাক হয়ে গেলাম। তােতলাতে তােতলাতে কোনােরকমে বললাম, ‘আজ ন’টার সময় তােমার আসবার কথা ছিল…।’
‘মনে আছে, মনে আছে। শেন তারিখটা একটু পিছিয়ে দাও। এখন তাে আর সে রকম ইমার্জেন্সি নেই। তা ছাড়া…’
‘তা ছাড়া কী?’
‘তােমার ব্যবসার এখন যা অবস্থা বিয়ে করলে দুজনকেই একবেলা খেয়ে থাকতে হবে।’
হড়বড় করে আরাে কী কী যেন সে বলল । হাসির শব্দও শুনলাম একবার। আমি বুঝতে পারলাম পারুল আর কখনােই আমাকে বিয়ে করতে আসবে না। কাল তাকে নিয়ে ঘর সাজাবার জিনিসপত্র কিনেছি। সারা নিউমার্কেট ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সে কেনাকাটা করেছে। দোকানিকে ডবল বেডশিট দেখাতে বলে সে লজ্জায় মুখ লাল করেছে। এবং আজ সন্ধ্যাতেই খুব সহজ সুরে বলছে, ‘তােমার ব্যবসার এখন যা অবস্থা।’ আঘাতটি আমার জন্যে খুব তীব্র ছিল। আমার সাহস কম, নয়তাে সে রাতেই আমি বিষ খেয়ে ফেলতাম কিংবা তিনতলা থেকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়তাম । আমি বড় অভিমানী হয়ে জন্মেছি।
সে বৎসর আরাে অনেকগুলি দুর্ঘটনা ঘটল। ইরফানের কাছে আমার চার হাজার টাকা জমা ছিল। সে হঠাৎ মারা গেল। রামগঞ্জে এক ওয়াগন লবণ বুক করেছিলাম। সেই ওয়াগনটি একেবারে উধাও হয়ে গেল। পাথরকুঁচি সাপ্লাইয়ের কাজটায় বড় রকমের লোকসান দিলাম। ভদ্রভাবে থাকবার মতাে পয়সাতেও শেষপর্যন্ত টান পড়ল। মেয়েরা বেশ ভালাে আন্দাজ করে। পারুল সত্যি-সত্যি আমার ভবিষ্যণ্টা দেখে ফেলেছিল। পারুলের সঙ্গে যােগাযােগ কমে গেল। আমি নিজে কখনাে যেতাম না তার কাছে। তবু তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যেত । হয়তাে বাসস্টপে দু’জন একসঙ্গে এসে দাঁড়িয়েছি। পারুল আমাকে দেখামাত্রই আন্তরিক সুরে বলেছে, কী আশ্চর্য, তুমি! একী স্বাস্থ্য হয়েছে তােমার? ব্যবসাপত্র কেমন চলছে?
‘চলছে ভালােই।’
‘ইশ বড় রােগা হয়ে গেছ তুমি। চা খাবে এক কাপ? এস তােমাকে চা খাওয়াব।’
দুপুরবেলা সিনেমা হলের সামনে একদিন দেখা হয় গেল। আমি তাকে দেখতে পাই নি এরকম একটা ভান করে রাস্তায় নেমে পড়লাম। কিন্তু সে পেছন থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘এই এই। সিনেমা দেখতে এসেছিলে নাকি?’
‘না।’
‘শােন, একটা কথা শুনে যাও।’
‘কী?’
‘আমার এক বান্ধবীর ছেলের আজ জন্মদিন। প্লিজ একটা উপহার আমাকে চয়েস করে দাও। চল আমার সাথে ।’
পারুলকে যতবার দেখি ততবারই অবাক লাগে। তিনশ টাকার স্কুল মাস্টারি তাকে কেমন করে এতটা আত্মবিশ্বাসী আর অহংকারী করে তুলেছে, ভেবে পাই না। ভুলেও সে আমাদের প্রসঙ্গ তুলে না । এক সােমবারে আমরা যে একটি বিয়ের দিন ঠিক করেছিলাম তা যেন বান্ধবীর ছেলের জন্মদিনের চেয়েও অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার। তার উজ্জ্বল চোখ, দ্রুত কথাবলার ভঙ্গি স্পষ্টই বুঝিয়ে দেয় জীবন অনেক অর্থবহ ও সুরভিত হয়ে হাত বাড়িয়েছে তার দিকে।