মহাপতঙ্গ – আবু ইসহাক

– এতেও সাধ মেটেনি। এবার মহাপতঙ্গের পেটের মধ্যে জায়গা করেছে। দল বেঁধে ওর পেটের মধ্যে বসে এখন মহানন্দে আকাশে পাড়ি জমাতে শুরু করেছে।

স্ত্রী চড়ুই বলে, এবার দোপেয়ে দৈত্যরা কিন্তু ভারি বিপদে পড়েছিল। মহাপতঙ্গাকে পোষ মানিয়েছিল তাই রক্ষা।

কিছুদিন পরে পানি শুকিয়ে যায়। দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল যে সব দোপেয়ে দৈত্য তারা দেশে ফিরে আসে। কিন্তু দেশে খাবার নেই। খেতের ফসল ভেসে গেছে বন্যায়। চারদিকে হাহাকার। চড়ুই পাখি দুটোরও দুর্দশার অন্ত নেই। বন্যার সময় দোপেয়ে দৈত্যরা বাড়ির ছাদে যেসব খাদ্যশস্য ফেলে গিয়েছিল তাই কাড়াকাড়ি করে খেয়ে এতদিন চলেছে। কিন্তু এখন দুটো ঘাসের দানাও কুড়িয়ে পাওয়া যায় না। এই দুর্দিনে আবার পেটে দুরন্ত ক্ষুধা নিয়ে দুটো নতুন ঠোঁটের আবির্ভাব হয়েছে। ক্ষুধার জ্বালায় সেগুলো খালি ট্যাঁও ট্যাঁও করে। বাসায় ঢুকবার সাথে সাথে ঠোঁট ফাঁক করে এগিয়ে আসে আ-দে-দে-দে।

চড়ুই পাখি দুটো মাঠে খাবার সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। এমন দিনে আবার শব্দ শোনা যায়, বোঁ-বোঁ-বোঁ।

মহাপতঙ্গ এসে মাঠে নামে। দোপেয়ে দৈত্যরা তার পেট থেকে বস্তা বস্তা কী সব নামিয়ে নেয়। এটা উড়ে চলে গেলে আর একটা মহাপতঙ্গ আসে। তারপর আরেকটা- আরও কয়েকটা । সবগুলোই বস্তা বস্তা কী সব দিয়ে চলে যায়। চড়ুই দুটোর কৌতুহল জাগে। ফুড়ুৎ লাফ দিয়ে ওরা এগিয়ে যায়। কাছাকাছি গিয়ে দেখে ওদের স্বজাতি কয়েকটা গিয়ে হাজির হয়েছে ওখানে। খুঁটে খুঁটে কী যেন খাচ্ছে।

ফুড়ুৎ করে উড়ে ওরাও ছুটে যায়। কী আশ্চর্য! খাবার দিয়ে গেছে মহাপতঙ্গ ক্ষুধার খাবার। আনন্দ। আনন্দ! কী আনন্দ! বস্তা থেকে ঝরে পড়ছে কত খাবার।

দুটো ঠেসে পেট পুরে খায়। বাসায় ফিরে বাচ্চা দুটোকে খাওয়ায়। আঃ কী শান্তি!

অনেক দিন পরে আজ চড়ুই দম্পতি খোশ মেজাজে গল্প করে। গল্প ঠিক নয়। দোপেয়ে দৈত্যের গুণকীর্তন।

পুরুষ চড়ুই বলে, দোপেয়ে দৈত্য সমস্ত দুঃখ-শান্তি দূর করতে পারে। ওরা ইচ্ছে করলে আরও সুন্দর করতে পারে পৃথিবীকে। 

– হ্যা, তা পারে। ওরা যদি করে পণ, করে দুঃখ বিমোচন। স্ত্রী চড়ুইটা কৃতজ্ঞতায় গানই জুড়ে দেয়। ওর সঙ্গীও যোগ দেয় সে গানে। ছানা দুটো মুগ্ধ হয়ে শোনে।

মহাপতঙ্গ যে খাদ্যশস্য দিয়ে যায়, সেগুলো দোপেয়ে দৈত্যদের ঘরে ঘরে আসে। দেয়ালের ফোকরে আবার চড়ুই দম্পতির সুখের ঘরকন্না চলে। স্ত্রী চড়ুই জোড়া ডিম পাড়ে। দুটিতে পালা করে তা দেয়। জোড়া জোড়া বাচ্চা ফোটে। সারাদিন ধরে শস্যকণা কীট-পতঙ্গ কুড়িয়ে এনে বাচ্চাদের ঠোঁটে ঢুকিয়ে খাওয়ায়। ওরা বড় হয়ে ওঠে। ওদের কাছে ছোঁ- রাক্ষস, ম্যাও-খোক্ষস, কুণ্ডলী-ফোঁস ফোঁস ও রাক্ষসের কেচ্ছা বলে। এসব রাক্ষস-খোক্ষস ও দেও-দুরাচারের কেচ্ছা শুনে বাচ্চাগুলো মুষড়ে পড়ে। তখন ওরা সুন্দর পৃথিবীর গল্প শুরু করে দেয়। রং-রসের বৈচিত্র্যে প্রাণবন্ত এ পৃথিবী। পানি আর বাতাসের প্রাচুর্যে প্রাণবন্ত পৃথিবী। ফুল-ফল-শস্যের সম্ভারে সমৃদ্ধ এ পৃথিবী। দুঃখের তুলনায় অনেক সুখ এখানে। গল্পে গল্পে দোপেয়ে দৈত্যের প্রসঙ্গ এসে যায়। এদের বুদ্ধি, কৌশল ও গুণ হেকমতের অনেক গল্প চলে। তারপর চলে মহাপতঙ্গের গল্প। বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময় কত মহান কাজ করেছে এগুলো।

এভাবে দিন যায়। মাস পেরোয়। বছর ঘোরে। একদিন ভোর বেলা। উড়ু উড়ু বাচ্চা দুটোকে খেলার ছলে আত্মরক্ষার নানা কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছিল পাখি দুটো। হঠাৎ স্ত্রী চড়ুই বলে ওঠে , ঐ যে শব্দ । মহাপতঙ্গ আসছে।

-হ্যা, তাই তো! মহাপতঙ্গই আসছে। পুরুষ চড়ুই বলে, এবার আবার কী নিয়ে এল?

-নিশ্চয়ই ভালো খাবার-টাবার নিয়ে এসেছে। চল না দেখে আসি।

-আমরাও যাব, মা। ছানা দুটো আবদার করে।

-না রে, না। তোরা এখনও ভালো করে উড়তে পারিসনে। আমরা গিয়ে দেখে আসি।

-আমাদের ভয় করবে যে। মাদি ছানাটা বলে।

-ভয়! দিনে-দুপুরে আবার কিসের ভয়? 

ম্যাও-খোক্ষস আসে যদি?

-দূর বোকা! ম্যাও-খোক্ষস এ দেয়াল বেয়ে উঠতেই পারবে না।

-কুণ্ডলী-ফোস ফোস যদি আসে?

উহু, কুণ্ডলী-ফোঁস ফোঁস এ খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠতে পারবে না। তোরা বড় হয়ে এরকম জায়গা বেছে নিয়ে বাসা বাঁধবি। এ রকম জায়গায় যদি আসে তো কা-ভক্ষুস পারে।

-কা-ভক্ষুস!

বাচ্চা দুটো ভয়ে শিউরে ওঠে। ওদের মা বুঝতে পেরে বলে, থাক সে কথা, আমি ওদের কাছে থাকি। তুমিই গিয়ে দেখে এসো।

-আচ্ছা, তুমি থাক ওদের নিয়ে। আমি গিয়ে দেখে আসি। মহাপতঙ্গ খাবার নিয়ে এলে তোমাদের জন্য টোপলা ভরে নিয়ে আসব। পুরুষ চড়ুই ঢেউয়ের তালে নাচতে নাচতে উড়ে যায়।

মহাপতঙ্গ ঠিকই। আর এসেছে একটা নয়, এক জোড়া নয়, পাঁচ জোড়া। চড়ুই খুশি হয়। অনেক খাবার নিয়ে এসেছে নিশ্চয়।

চোওঁ করে একটা মহাপতঙ্গ নেমে যায় অনেক নিচে।

একি! ছোঁ মারবে নাকি? ঐ তো উপর দিকে উঠছে আবার, কিন্তু ওটার পেট থেকে পড়ছে কী ও?

চড়ুই ভাবে, নিশ্চয়ই ডিম। বা রে বা, বড় পাখির বড় রং, আন্ডা পাড়ার দেখ ঢং।

বুম- ম্- ম্-

প্রচণ্ড শব্দে মূছা যায় চড়ুই পাখি। ঘুরতে ঘুরতে সে একটা ঝোপের ওপর পড়ে। 

বেলা যখন গড়িয়ে যায় তখন জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু শরীরে এতটুকু বল নেই। সে চোখ মেলে। ঝোপের ওপর কাত হয়ে শুয়েই সে মিটমিট করে তাকায় এদিক-ওদিক। 

এ কোথায় সে? কেমন করে সে এল এখানে, এই ঝোপের ওপর? কী হয়েছিল তার?

চড়ুইটি প্রথমে কিছুই মনে করতে পারে না। 

অনেকক্ষণ ধরে ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করে সে। তারপর আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে আর বিস্ময় জাগে- ডিমটা বুঝি ফেটেই গেছে। তাই তো এমন শব্দ। বড় পাখির বড় ডিম। এরকম শব্দ তো হবেই। চড়ুই ভাবে কিন্তু এভাবে ডিম পেড়ে লাভটা কী? মাটিতে পড়ে ফেটেই তো গেল, তা দিয়ে বাচ্চা ফোটাতে পারল না আমাদের মতো। 

বাচ্চা ফোটানোর কথা ভাবতে গিয়ে নিজের বাচ্চা দুটোর কথা মনে পড়ে যায় তার। বাচ্চা দুটো নিয়ে স্ত্রী সেই সকাল থেকে ওর পথ চেয়ে বসে আছে। ক্ষুধার জ্বালায় কত না জানি কষ্ট পাচ্ছে ওরা। কিন্তু একটা দানাও যে যোগাড় হয়নি। কী ব্যাপারটাই না ঘটে গেল। ওরা কি শুনতে পেয়েছে ডিম ফাটার শব্দ?

চড়ুই কোনোরকমে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। ফুড়ুৎ করে সে উড়াল দেয়। হঠাৎ নিচে চোখ পড়ে চড়ুই পাখির। পথ ভুল হল নাকি। চড়ই চমকে ওঠে, কোন পথে এল সে? এরকম দেখাচ্ছে কেন? না, পথ ভুল হবার কথা তো নয়।

তালগাছ ডানে রেখে দুই আমগাছের ফাঁক দিয়েই তো এসেছে সে। কিন্তু আন্ডা রঙের উঁচ বাড়িটা কোথায় গেল? দিকে নারকেলের গাছটা তো ঠিকই আছে।

চড়ুই উড়ে যায় দুদিকে নিশানা ঠিক রেখে। কিন্তু সব নিশানা পাওয়া যাচ্ছে না। ঐ যে তেঁতুল গাছ। কিন্তু ওটার এমন ছিন্ন-ভিন্ন চেহারা কেন? কিছু ভেবে পায় না চড়ুই। যাকগে, আর একটু গেলেই কাউন রঙের বাড়িটা।

কিন্তু কোথায় সে কাউন রঙের বাড়ি?

চড়ুই পাখির বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে। নিচে চেয়ে দেখে ধ্বংসস্তূপ। লণ্ডভণ্ড সব। সে চিল্কার করে ওঠে। স্ত্রীর নাম ধরে ডাকে। বাচ্চা দুটোর নাম ধরে ডাকে। কিন্তু সে ডাক ফিরে আসে প্রতিধ্বনি হয়ে।

ইটের ফাঁকে ফাঁকে খোঁজে চড়ুইটি। কিন্তু কোনো চিহ্ন নেই তার স্ত্রী আর বাচ্চা দুটোর। শুধু এক জায়গায় মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বাড়ির বাসিন্দা দোপেয়ে দৈত্য।

ব্যথায় ছটফট করে চড়ুই। ডানা ঝাপটায়। ঠোঁট দিয়ে বুকের পালক কাটে। বিলাপ করতে করতে সঙ্গিনী ও ছানা দুটোর কত কথাই না ইনিয়ে বিনিয়ে বলে যায়। 

নিঃসঙ্গ এক চড়ুই পাখিকে প্রায়ই দেখা যায় জানালার ধারে, রেলিং-এর ওপর। ঘৃণার স্বরে সে ডেকে যায়,

ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

এ ছিঃ ছিঃ কিসের জন্য? এ ধিক্কার কাদের জন্য? এ নিশ্চয় তাদের জন্য যারা ডিম্ববতী মহাপতঙ্গিনীর পেটে চড়ে উড়ে বেড়ায়, আর অশান্তি ডেকে আনে। 


পোস্টটি শেয়ার করুন