হাজার বছর ধরে – জহির রায়হান

চার

খড়ম জোড়া তুলে নিয়ে হাত পা ঘোয়ার জন্যে পুকুর ঘাটে চলে যায় মন্তু। অজু করে এসে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বে আজ।

মাঝি বাড়ি থেকে ধপাস ধপাস ঢেঁকির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

রাত জেগে আজও ধান ভানছে আম্বিয়া। বড় মিহি কণ্ঠস্বর ওর, বড় সুন্দর গান গায় সে।

ভাটুইরে না দিয়ো শাড়ি,
ভাটুই যাব বাপের বাড়ি।
সর্ব লক্ষণ কাম চিক্কণ,
পঞ্চ রঙের ভাটুইরে।

পুকুর ঘাট থেকে ফেরার পথে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো মন্তু। ছোট পুকুরের পূর্ব পাড় থেকে কে যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম পাড়ের দিকে। আবছা আলোতে সব কিছু স্পষ্ট না দেখলেও মেয়েটিকে চিনতে ভুল হলো না মন্তুর। আবুলের বউ হালিমা। এত রাতে একা একা কোথায় যাচ্ছে সে। পশ্চিম পাড়ের লম্বা পেয়ারা গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটা। চারপাশে বার কয়েক ফিরে তাকালো সে। তারপর ধীরে ধীরে পরনের ছেঁড়া কাপড়টা খুলে ফেললো সে।

মন্ত্রমুগ্ধের মত ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মন্তু। হাত-পাগুলো কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে ওর।

পরনের কাপড় খুলে তার একটা প্রান্ত পেয়ারা গাছের মোটা ডালটার সঙ্গে বাঁধলো হালিমা। আরেকটা প্রান্ত নিজের গলার সঙ্গে পেঁচিয়ে কি যেন পরখ করলো সে।

মন্তুর আর বুঝতে বাকি রইলো না, গলায় ফাঁস দিয়ে মরতে চায় হালিমা।

এ দুনিয়াটা বোধ হয় অসহ্য হয়ে উঠেছে ওর কাছে। তাই আর বাঁচতে চায় না ও।

মন্তু এ মুহূর্তে কি করবে ভেবে উঠতে পারছিলো না।

হঠাৎ ওকে অবাক করে দিয়ে গলার ফাঁসটা খুলে ফেলে আপন মনে কেঁদে উঠলো হালিমা। পেয়ারা। গাছটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো সে।

হয়তো, বাবা-মার কথা মনে পড়েছে ওর। কিম্বা, দুনিয়াটা অতি নির্মম হলেও ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না হয়তো।



এর মধ্যে বার চারেক গলায় ফাঁস পরেছে আর খুলেছে হালিমা। ওর অবস্থা দেখে অতি দুঃখে হাসি পেলো মন্তুর। ধীরে ধীরে ওর খুব কাছে এগিয়ে গেলো সে। তারপর অকস্মাৎ ওর একখানা হাত চেপে ধরলো মন্তু।

একটা করুণ উক্তির সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো হালিমা। বড় বিষণ্ণ চাহনি ওর। অনেকক্ষণ কারো মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুলী না। বোবার মত দাঁড়িয়ে রইলো দু’জন। ঈষৎ চাদের আলোয় মন্তু দেখলো, হালিগ্রার নাক আর চোখ দুটো অসম্ভব রকম ফুলে গেছে। এত মার মেরেছে ওকে আবুল।

মন্তু শিউরে উঠলো। তারপর কি বলতে যাচ্ছিলো সে।

হঠাৎ এক ঝটকায় ওর মুঠো থেকে হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে একটা চাপা কান্নার সঙ্গে সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে গেলো হালিমা। বোবা দৃষ্টি মেলে সেদিকে তাকিয়ে রইলো মন্তু।

পুকুর পাড় থেকে ফিরে এসে উঠোন পেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো সে।

চেয়ে দেখে, ঘরের দাওয়ায় বসে পুঁথির কথাগুলো গুন্‌গুন্ করছে টুনি।

দাওয়া থেকে নেমে এসে টুনি শুধালো, কোথায় গিছলা মিয়া। তোমারে আমি খুঁইজা মরি।

শোবার ঘর থেকে মকবুল আর আমেনার গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। রশীদ আর সালেহাও বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি নিয়ে যেন আলাপ করছে নিজেদের মধ্যে।

সুরত আলীর ঘরের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

আবুল আর হালিমার ঘরেও কোন বাতি নেই।

মন্তু সহসা টুনির কথার কোন জবাব দিলো না।

টুনি আরো কাছে এগিয়ে এসে বললো, এহনি ঘুমাইবা বুঝি?

মন্তু বললো, হুঁ। শরীরটা আইজ ভালো নাই।

ক্যান, কি অইছে? টুনির কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা। জুর হয় নাই তো? মন্তু বললো, না এমনি খারাপ লাগতাছে।

মন্তু বললো, আজ থাক, কালকা যামু।

টুনি কি যেন ভাবলো। ভেবে বললো, পরশু দিনকা আমি বাপের বাড়ি চইলা যামু।

তাই নাহি?

হুঁ। বাপজানের অসুখ, তাই।

অসুখের কথা কার কাছ থাইকা শুনলা? ওর মুখের দিকে তাকালো মন্তু।

টুনি আস্তে করে বললো, বাপজান লোক পাঠাইছিলো।

অ। উঠোনের মাঝখানে দুজন কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। একটু পরে মন্তু নীরবতা ভাঙলো, পরশু থাইকা আমিও নাও বাইতে যাইতাছি।

কোনহানে যাইবা? টুনি সোৎসাহে তাকালো ওর দিকে।

মন্তু বললো, কোনহানে যাই ঠিক নাই। করিম শেখের নাও। সে যেই হানে নিয়া যায় সেই হানেই যামু। টুনি বললো, তোমার নায়ে আমারে বাপের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিবা? বলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো টুনি।

সহসা কোন জবাব দিতে পারে না মন্তু। তারপর ইতস্তত করে বলে, অনেক রাত অইছে এইবার ঘুমাও গিয়া। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায় মন্তু।

পরদিন অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙলো মন্তুর।

বাইরের উঠোনে তখন কি একটা বিষয় নিয়ে প্রচণ্ড ঝগড়া বাঁধিয়েছে আমেনা আর সালেহা। অকথ্য ভাষায় পরস্পরকে গলাগলি দিচ্ছে ওরা। গনু মোল্লার ঘরের সামনে একটা বড় রকমের ভীড়।

গ্রামের অনেক ছেলে বুড়ো এসে জমায়েত হয়েছে সেখানে। ব্যাপারটা কি প্রথমে বুঝতে পারলো না মন্তু। পরে বুড়ো মকবুলের মেয়ে হিরনীর কাছ থেকে শুনলো সব।

মজু ব্যাপারীর মেয়েটাকে ভূতে পেয়েছে। ভূত তাড়াবার জন্য ওকে গনু মোল্লার কাছে নিয়ে এসেছে সবাই। ব্যাপারীর ছোট ভাইকে সামনে পেয়ে মন্তু শুধালো, কি মিয়া ভূতে পাইল কহন অ্যাঁ?

ব্যাপারীর ভাই আদ্যন্ত জানালো সব।

কাল ভোর সকালে পরীর দীঘির পাড়ে শুকনো ডাল পাতা কুড়াতে গিয়েছিলো মেয়েটা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো মেয়ে আর ফিরে না। ওদিকে মেয়ের মা তো ভেবেই আকুল। বয়স্কা মেয়ে, কে জানে আবার কোন বিপদে পড়লো। প্রথমে ওকে দেখলো কাজী বাড়ির গুরথুরে বুড়িটা। লম্বা তেতুঁল গাছের মগডালে উঠে দুপা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে টেনে টেনে দিব্যি গান গাইছে মেয়েটা। বুড়ি তো অবাক, বলি লজ্জা শরমের কি মাথা খাইছ? দিন দুপুরে গাছে উইঠা পিরীতের গীত গাইবার লাগছ। ও মাইয়্যা, বলি লজ্জা শরম কি সব উইঠা গেছে নাহি দুনিয়ার উপর থাইক্যা?

বুড়ি যত চিৎকার করে মরে, মেয়ে তত শব্দ করে হাসে। সে এক অদ্ভুত হাসি। যেন ফুরোতেই চায় না।

খবর শুনে মঞ্জু ব্যাপারী নিজে ছুটে এলো দীঘির পাড়ে। নিচে থেকে মেয়েকে নাম ধরে বারবার ডাকলো সে। সখিনা, মা আমার নাক-কান কাটিছ না মা, নাইম্যা আয়।

বাবাকে দেখে ওর গায়ের ওপরে থুথু ছিটিয়ে দিলো সখিনা। তারপর খিলখিল শব্দে হেসে উঠে বললো, আর যামু না আমি। এইহানে থাকুম।

ওমা কয় কি। মাইয়্যা আমার এই কি কথা কয়? মেয়ের কথা শুনে চোখ উল্টে গেলো মজু ব্যাপারীর।

থুরথুরে বুড়ি এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। সহসা বিজ্ঞের মত ঘাড় নাড়লো সে, লক্ষণ বড় ভালো না ব্যাপারী। মাইয়ারে তোমার ভূতে পাইছে।

খবরদার বুড়ি বাজে কথা কইস না। উপর থেকে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানালো সখিনা।

বেশি বক বক করলে ঘাড় মটকাইয়া দিমু।

এ কথার পরে কারো সন্দেহের আর অবকাশ রইলো না।

বুড়ি বললো, এ বড় ভালো লক্ষণ নয়, জলদি কইরা লোকজন ডাহ।

লোকজন ডাকার কোন প্রয়োজন ছিলো না। কারণ হক-ডাক শুনে ততক্ষণে গ্রামের অনেক লোক এসে জড়ো হয়ে গেছে সেখানে। বুড়ো ছমির মিয়া বললো, দাঁড়ায়া তামাশা দেখতাছ ক্যান মিয়ারা, একজন উইঠা যাও না উপরে। কে উঠবে, কে উঠবে না তাই নিয়ে বসা হলো কিছুক্ষণ। কারণ যে কেউ তো আর উঠতে পারে না। এমন একজনকে উপরে উঠতে হবে, মেয়ের গায়ে হাত ছোঁয়াবার অধিকার আছে যার। অবশেষে ঠিক হলো তকু ব্যাপারীই উঠবে উপরে। মেয়ের আপন চাচা হয় সে। সুতরাং অধিকারের প্রশ্ন আসে না।

তকু ব্যাপারীকে উপরে উঠতে দেখে ক্ষেপে গেলো সখিনা। চিৎকার করে ওকে শাসাতে লাগলো সে, খবরদার, খবরদার ব্যাপারী, জানে খতম কইরা দিমু। বলে ছোট ছোট ডাল পাতা ছিড়ে ছিড়ে ওর ঘাড়ের ওপরে ছুঁড়ে মারতে লাগলো সে। তারপর অকস্মাৎ এক লাফে দীঘির জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো মেয়েটা। অনেক কষ্টে দীঘির পানি থেকে পাড়ে তুলে আনা হলো তাকে।

কলসি কলসি পানি ঢালা হলো মাথার ওপর। তারপর যখন জ্ঞান ফিরে এলো সখিনার তখন সে একেবারে চুপ হয়ে গেছে। তারপর থেকে একটা কথাও বলে নি সখিনা। একটা প্রশ্নের জবাব দেয়নি সে। তাই আজ সকালে গনু মোল্লার কাছে নিয়ে এসেছে ওকে, যদি ভূতটাকে কোন মতে তাড়ানো যায়। নইলে মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব হবে। ব্যাপারীর ভাইয়ের কাছ থেকে সব কিছু শুনলো মন্তু। গনু মোল্লার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটা সাদা কাপড়কে সরষের তেলের মধ্যে ডুবিয়ে নিয়ে তার মধ্যে আগুন ধরিয়ে সেই কাপড়টাকে সখিনার নাকের ওপর গনু মোল্লা ধরেছে আর চিৎকার করে বলছে, কোনহানে থাইকা আইছ শীগগীর কইরা ক, নইলে কিন্তুক ছাড়মু না আমি। ক শীগগীর। সখিনা নীরব।



তার ঘাড়ের ওপর চেপে থাকা ভূতটা কোন কথাই বলছে না।

মন্তু আর দাঁড়ালো না সেখানে। ঘরের পিছন থেকে একটা নিমের ডাল ভেঙ্গে নিয়ে দাঁতন করতে করতে পুকুর ঘাটে চলে গেলে সে। পুকুর পাড়ের পেয়ারা গাছের নিচে লাউ গাছগুলোর জন্য একটা মাচা বাঁধছে হালিমা। এখন দেখলে কে বলবে যে ওই মেয়েটা এই গতকাল রাতে ওই পেয়ারা গাছটার ডালে গলায় কাপড় বেধে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলো। ওর দিকে চোখ পড়তেই, কিছুক্ষণ এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে তারপর আবার মাচা বাঁধতে লাগল হালিমা।

পোস্টটি শেয়ার করুন