হাজার বছর ধরে – জহির রায়হান

দুই

ধপাস ধপাস ঢেঁকির শব্দে গমগম শিকদার বাড়ি।

ঘুমে ঢুলু ঢুলু বউ দুটোর গা বেয়ে দরদর ঘাম নামে। এতক্ষণে রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেছে ওরা। অ্যাঁচলটা কাঁধের ওপর থেকে নামিয়ে নিয়ে, সামনে হাত রাখার বাঁশের ওপরে গুটিয়ে রেখেছে দুজনে। মাঝে মাঝে তুলে নিয়ে বুক আর গলার ঘাম মুছে নিচ্ছে। ঘামে কাপড়টা চপ চপ করছে ওদের।

সেদিকে খেয়াল নেই মকবুলের। ও ভাবছে অন্য কথা।

বাড়ির ওপরের জমিটাতে লাঙ্গল না দিলে নয়। অথচ হাল যে একটা ধার পাবে সে সম্ভাবনা নেই। লাঙ্গল অবশ্য যা হোক একটা আছে ওর। অভাব হলো গরুর। গরু না হলে লাঙ্গল টানবে কিসে। আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়। মকবুল ভাবলো, বউ দুটোকে লাঙ্গলে জুড়ে দিয়ে, দূর এটা ঠিক হবে না। লোকে গালাগাল দেবে ওকে। বলবে, দেহ বউ দুইড্যা দিয়া লাঙ্গল টানায়। তার চেয়ে এক কাজ করলে কি ভালো হয় না? না। বউদের দিয়েই লাঙ্গল টানাবে সে। দিনে নয়, রাতে। বাইরের কোন লোকে দেখবার কোন ভয় থাকবে না তখন। বউরা অবশ্য আপত্তি করতে পারে। কিন্তু ওসব পরোয়া করে না মকবুল। মুফত বিয়ে করে নি সে। পুরো চার চারটে টাকা মোহরানা দিয়ে এক একটা বিয়ে করেছে। হুঁ।

ভাবছিলো আর সোনারঙ ধানগুলো ঢেঁকির নিচে ঠেলে দিচ্ছিলো মকবুল। হঠাৎ একটা তীব্র আর্তনাদ করে হাতটা চেপে ধরলে সে। অসতর্ক মুহূর্তে ঢেঁকিটা হাতের ওপর এসে পড়েছে ওর। আল্লারে বলে মুখ বিকৃত করলো মকবুল।

টুনি আর আমেনা এতক্ষণে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ঢেঁকির উপর। ঘোর কাটতে ছুটে নেমে এলো ওরা। ওদের কাছে এগিয়ে আসতে দেখে ওদের গায়ের ওপরে থুতু ছিটিয়ে দিল মকবুল, দূর-হ দূর-ই আমার কাছ থাইকা। বলতে গিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চাপালো মকবুল।

আমেনা বললো, দেহ কারবার, নিজের দোষে নিজে দুঃখ পাইল আর এহন আমাগোরে গালি দেয়। আমরা কি করছি।

তোরা আমার সঙ্গে শতামি করছল। বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললো মকবুল। তোরা দুই সতীনে ইচ্ছা কইরা আমার হাতে ঢেঁকি ফালাইছল। তোরা আমার দুশমন।

হ্যাঁ দুশমনই তো। দুশমন ছাড়া আর কি। কাপড়ের অ্যাঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলো আমেনা।

টুনি এগিয়ে গেলো ওর ফুলো হাতে একটা ভিজে ন্যাড়া বেঁধে দেয়ার জন্যে। লাফিয়ে তিন হাত পিছিয়ে গেলো মকবুল। দরকার নাই, দরকার নাই। অত সোয়াগের দরকার নাই। বলে একখানা সরু কাঠের টুকরো নিয়ে ওর দিকে ছুঁড়ে মারলো মকবুল।

বিষ উঠছে নাহি বুড়ার? এমন করতাছে ক্যান। চাপা রোষে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো টুনি। খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়াতে ঠাণ্ডা বাতাসে দেহটা জুড়িয়ে গেলো ওর। হঠাৎ মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। উঠোন থেকে মন্তুর ঘরের দিকে তাকালো ও। একটা পিদিম জ্বলছে সেখানে। একবার চারপাশে দেখে নিয়ে মন্তুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো টুনি।

মাচাঙের ওপর থেকে কথা বালিশ নামিয়ে নিয়ে শোবার আয়োজন করছিলো মন্তু।

টুনি দোরগোড়া থেকে বলে, বাহ, বারে।

মন্তু মুখ তুলে তাকায় ওর দিকে। বলে, ক্যান কি অইছে?

টুনি ফিসফিসিয়ে বলে, আজ যাইবা না?

মন্তু অবাক হয়, কই যামু?

টুনি মুখ কালো করে চুপ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, ক্যান ভুইলা গেছ বুঝি?

মন্তুর হঠাৎ মনে পড়ে যায়। বেড়ার সঙ্গে ঝােলান মাছ ধরার জালটার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে, অ- মাছ ধরতে।

যাইবা না? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে টুনি।

মন্তু হেসে বলে, যা যামু। কিন্তু পরক্ষণে চিন্তিত হয়ে পড়ে সে, বুড়ো যদি টের পায় তাইলে কিন্তুক জানে মাইরা ফালাইবো।

হঠাৎ ফিক করে হেসে দেয় টুনি। মারেরে ডরাও নাকি?

মন্তু সে কথার জবাব না দিয়ে টুনি বলে, ভাত আইছ?

না। তুমি খাইছ?

হুঁ। তুমি গিয়া খাইয়া আস যাও। জলদি কইরা আইসো। বিছানাটা আবার গুটিয়ে রেখে। বেড়ার সঙ্গে ঝােলান জালটা মাটিতে নামিয়ে নেয় মন্তু।

ও ঘর থেকে আমের ডাক শোনা যায়, টুনি বিবি কই গেলা, খাইতে আহ!

আহি, বলে সেখান থেকে চলে যায় টুনি।

আজকাল রাতের বেলা আমেনার ঘরে শোয় মকবুল। টুনি থাকে পাশের ঘরে। আগে, ফাতেমা আর ও দুজনে এক সঙ্গে থাকতো। মাসখানেক হলো ফাতেমা বাপের বাড়ি গেছে। এখন টুনি একা। রাতের বেলা ইচ্ছেমত যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ালেও ধরবার উপায় নেই। রাত জেগে মাছ ধরাটা ইদানীং একটা নেশা হয়ে গেছে ওদের। ঘুঘুটে অন্ধকার রাতে গ্রামের এ পুকুর থেকে অন্য পুকুরে জাল মেরে বেড়ায় ওরা। হাতে একটা টুকড়ি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে থাকে টুনি। জালে ওঠা মাছগুলো ওর মধ্যে ভরে রাখে।

পর পুকুরের মাছ ধরতে গিয়ে সমস্ত সময় সজাগ থাকতে হয় ওদের। চারপাশে দৃষ্টি রাখতে হয়। একদিন প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলো দুজনে। জমীর মুন্সির বড় পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিলো সেদিন। আকাশে চাঁদ ছিলো কিন্তু চাদনী ছিলো না। কালো মেঘে ছেয়ে ছিলো পুরো আকাশটা।

এক হাঁটু পানিতে নেমে জালটাকে সন্তর্পণে ছুঁড়ে দিয়েছিলো সে। পুকুরের মাঝখানটাতে। শব্দ হয় নি মোটেও। কিন্তু পুকুর পাড় থেকে জোর গলায় আওয়াজ শোনা গেল, কে, কে জাল মারে পুকুরে?

এক হাঁটু পানি থেকে নীরবে এক গলা পানিতে নেমে গেলো মন্তু। টুনি ততক্ষণে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে।

জমীর মুন্সির হাতের টর্চটা বিদ্যুদ্বেগে ছুটে গেল পুকুরের এপার থেকে ওপারে। মনে মনে বার বার খোদাকে ডাকছিলো মন্তু, খোদা তুমিই সব।

একটু পরে পাড়ের ওপর থেকে টুনির চাপা গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো, এই উইঠা আহ। মুন্সি চইলা গেছে। বলে খিল খিল করে হেসে উঠে সে। ওর হাসির শব্দে রাগে সমস্ত দেহটা জ্বালা করে উঠেছে মন্তুর। এমন সময়ে মানুষ হাসতে পারে?

তারপর থেকে আরো সাবধান হয়ে গেছে মন্তু। গনু মোল্লার কাছ থেকে তিন আনা পয়সা খরচ করে একটা জোরদার তাবিজ নিয়েছে সে। রাতে বিরাতে গাঁয়ের পুকুরে মাছ ধরে বেড়ানো, বিপদ আপদ কখন কি ঘটে কিছুতো বলা যায় না। আগে থেকে সাবধান হয়ে যাওয়া ভালো। সগন শেখের পুকুর পাড়ে এসে, বাজুর ওপরে বাঁধা তাবিজটাকে আর একবার ভাল করে দেখে নিলো মন্তু। তারপর বুনো লতার ঝোপটাকে দুহাতে সরিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেলো সে। টুনি পেছন থেকে বললো, বারে, অত জোরে হাঁটলে আমি চলি কি কইরা? মন্তু জালটাকে গুছিয়ে নিতে নিতে বললো, আস্তে আহ, তাড়া কিসের? টুনি বলে বারে, আমার বুঝি ডর ভয় কিছুই নাই। যদি সাপে কামড়ায়? সাপের কথা বলতে না বলতেই হঠাৎ একটা অ্যাঁধি সাপ ফোঁস করে উঠে সরে যায় সামনে থেকে। অ্যাঁতকে উঠে দুহাত পিছিয়ে আসে মন্তু। ভয় কেটে গেলে থুতু করে বুকের মধ্যে একরাশ থুতু ছিটিয়ে দেয় সে। পেছনে টুনির দিকে তাকিয়ে বলে, বুকে থুক দাও তাইলে কিছু অইবো না। কোন রকম বিতর্কে না এসে নীরবে ওর কথা মেনে নেয় টুনি। কপালটা আজ মন্দ ওদের। অনেক পুকুর ঘুরেও কিছু চিংড়ি গুঁড়ো ছাড়া আর কিছু জুটল না। মাছগুলো কেমন যেন সেয়ানা হয়ে গেছে। পুকুরের ধারে কাছে থাকে না। থাকে গিয়ে একেবারে মাঝখানটিতে, এতদূর জাল উড়িয়ে নেয়া যায় না। টুনি বলে থাক, আইজ থাউক, চলো বাড়ি ফিইরা যাই। জালটাকে ধুয়ে নিয়ে মন্তু আস্তে বলে, চলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফুলো হাতটা কোলে নিয়ে বসে বসে আবুল আর হালিমার ঝগড়া দেখছিলো মকবুল।

অনেকক্ষণ কি একটা বিষয় নিয়ে তর্ক চলছে ওদের মধ্যে। দাওয়ায় বসে বসে যা মুখে আসছে ওকে বলে যাচ্ছে আবুল। হালিমাও একেবারে চুপ করে নেই। উঠানে একটা লাউয়ের মাচা বাধতে বাঁধতে দুএকটা জবাবও দিচ্ছে সে মাঝে মাঝে।

মকবুল হাতের ব্যথায় মৃদু কাতরাচ্ছিলো আর পিটপিট চোখে তাকাচ্ছিলো ওদের দিকে। হঠাৎ দাওয়া থেকে ছুটে এসে মূহুর্তে হালিমার চুলের গোছাটা চেপে ধরলো আবুল। তারপর কোন চিন্তা না করে সজোরে একটা লাখি বসিয়ে দিলো তলপেটে। উঃ মাগো, বলে পেটটা দুহাতে চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়লো হালিমা। রাগে তখন ফোপাচ্ছে আবুল, আমার ঘরের ভাত ধ্বংস কইরা রাস্তার মানুষের লগে পিরীত। জানে খতম কইরা দিমু না তোরে। কাইটা রাস্তায় ভাসায় ডিমু না। বলে আবার ওর চুলের গোছাতে হাত দিতে যাচ্ছিলো আবুল, বুড়ো মকবুল চিৎকার করে উঠলো, খবরদার আবুইল্যা, তুই যদি বউ-এর গায়ে আরেকবার হাত তুলছস তাইলে ভালো অইবো না কিন্তুক।

আমার ঘরণীর গায়ে আমি হাত তুলি কি যা ইচ্ছা তাই করি, তুমি কইবার কে, অ্যাঁ? পরক্ষণে আবুল জবাব দিলো, তুমি যখন তোমার ঘরণীরে তুলা পেড়া কর তহন কি আমরা বাধা দেই?

অমন কোণঠাসা উত্তরের পর আর কিছু বলার থাকে না মকবুলের। শুধু জুলন্ত দৃষ্টিতে এক নজর ওর দিকে তাকালো মকবুল। আবুল তখন ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে চলেছে হালিমাকে। ভেতরে নিয়ে ঝাঁপি বন্ধ করে মনের সুখে মারবে। ওর ইচ্ছে হয়তো বুঝতে পেরেছিলো হালিমা। তাই মাটি অ্যাঁকড়ে ধরে গোঙাতে লাগলো সে, ওগো তোমার পায়ে পড়ি। আর মাইরো না, মইরা যামু।

চুপ, চুপ, তীব্র গলায় ওকে শাসিয়ে ঝাঁপিটা বন্ধ করে দেয় আবুল। হেঁচকা টানে ওর পরনের হেঁড়া ময়লা শাড়িটা খুলে নিয়ে ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সে। তালি দেয়া পুরান ব্লাউজটা অ্যাঁটসাঁট করে বাঁধা ছিলো টেনে সেটাও খুলে ফেলে আবুল। তারপর দু’পায়ে ওর নগ্ন দেহটাকে প্রচণ্ডভাবে মাড়াতে থাকে সে।

বেড়ার সঙ্গে পুরান একটা ছড়ি ঝোলান ছিলো। সেটা এনে হালিমার নরম তুলতুলে কপালে কয়েকটা অ্যাঁচড় টেনে দেয় আবুল। এইবার পিরীত কর। আরো পিরীত কর। রাস্তার মানুষের লগে।

আহারে। এর মাইয়াডারে মাইরা ফালাইস না। ওরে ও পাষাইন্যা, দরজা খোল মারিস আর মারিস না, জাহান্নামে যাইবি, মারিস না। বাইরে থেকে দু’হাতে ঝাঁপিটাকে ঠেলছে ফকিরের মা। অবুল একবার তাকালো সেদিকে কিন্তু ঝাঁপি খুললো না।

বউ মারায় একটা পৈচাশিক আনন্দ পায় আবুল। পান বিডির মত এও যেন একটা নেশা হয়ে গেছে ওর। মেরে মেরে এর আগে দু’দুটো বউকে প্রাণে শেষ করে দিয়েছে সে।

প্রথম বউটা ছিলো এ গাঁয়েরই মেয়ে। আয়েশা। একটু বেঁটে একটু মোটা আর রঙের দিক থেকে শ্যামলা। অপূর্ব সংযম ছিলো মেয়েটির। অপূর্ব শান্তি স্বভাব। কত মেরেছে ওকে আবুল। কোনদিন একটু শব্দও করে নি। পিঠটা বিছিয়ে দিয়ে উপুর হয়ে চুপচাপ বসে থাকতো। কিল, চাপড়, ঘুষি ইচ্ছেমত মারতো আবুল।

একটা সামান্য প্রতিবাদ নেই।

প্রতিরোধ নেই।

শুধু আড়ালে নীরবে চোখের পানি ফেলতো মেয়েটা।

তারপর একদিন ভীষণভাবে রক্তবমি শুরু হলো ওর। জমাট বাঁধা কালো কালো রক্ত। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে মারা গেলো আয়েশা।



আয়েশা টিকেছিলো বছর তিনেক। তার পরেরটা কিন্তু ওর চাইতেও কম। মাত্র দুবছর।

অবশ্য জমিলার মাত্র দুবছর টিকে থাকার পেছনে একটা কারণও আছে। ও মেয়েটা ছিলো একটা বাচাল গোছের আর একটু রুক্ষ মেজাজের। সহজে আবুলের কিল চাপড়গুলো গ্রহণ করতে রাজি হতো না সে। মারতে এলে কোমরে অ্যাঁচল বেঁধে রুখে দাঁড়াতো।

হাজার হোক মেয়েতো। পুরুষের সঙ্গে পারবে কেন? বাধা দিতে গিয়ে পরিণামে আরো বেশি মার খেতো জমিলা। ও যখন মারা গেল আর ওর মৃত দেহটা যখন গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করছিলো সবাই তখন ওর সাদা ধবধবে পিঠের ওপর সাপের মত অ্যাঁকাবাকা ফুলে ওঠা রেখাগুলো দেখে শিউরে উঠেছিলো অনেকে। ওরে পাষাইন্যারে এমন দুধের মত মাইয়াটারে শেষ করলি তুই।

আয়েশা মারা যাবার পর অবশ্য ভীষণ কেঁদেছিলো আবুল। গড়িয়ে গড়িয়ে কেঁদেছিলো সারা উঠোনে। পাড়াপড়শীদের বলেছিলে, আহা বড় ভালো বউ আছিলো আয়েশা। আমি পাষাইন্যা তার কদর বুঝলাম না। আহারে এমন বউ আর পামু না জীবনে।

আয়েশার শোকে তিনদিন এক ফোঁটা দানাপানিও মুখে পোরে নি আবুল। তিন রাত কাটিয়েছে ওর কবরের পাশে বসে আর শুয়ে। পাড়াপড়শীরা ভেবেছিলো ওর চরিত্রে বুঝি পরিবর্তন এলো এবার। এবার ভালো দেখে একটা বিয়ে শাদি করিয়ে দিলে সুখে শান্তিতে ঘর-সংসার করবে আবুল।

কিন্তু জমিলার সঙ্গেও সেই একই ব্যবহার করেছে আবুল। একই পরিণাম ঘটেছে জমিলার জীবনেও।

দ্বিতীয় বউ-এর মৃত্যুতে আবুলের গড়াগড়ি দিয়ে কান্নার কোন মূল্য দেয় নি পড়শীরা। মুখে বিরক্তি এনে বলেছে, আর অত ঢঙ করিস না আবুইল্যা। তোর ঢঙ দেইখলে গা জ্বালা করে।

আমার বউ-এর দুঃখে আমি কাঁদি, তোমাগো গো জ্বালা করে ক্যান? ওদের কথা শুনে ক্ষেপে উঠে আবুল। কপালে এক মুঠো ধুলো ছুঁইয়া সহসা একটা প্রতিজ্ঞা করে বসে সে, এই তৌবা করলাম বিয়া শাদি আর করমু না খোদা, আমারে আর বিয়ার মুখ দেখাইও না। খোদা, আমার শত্রুরা আরামে থাহুক। বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে আবুল।

পড়শীরা গালে হাত দিয়ে বলেছে, ইয়া আল্লা, এই কেমনতর কথা। বউ মারলি তুই, সেই কথা বইলা কি শতামি করলাম নাকি আমরা। সাচা কথা কইলেই তো মানুষ শত্রু হয়।

ঠিক কইছ বঁইচির মা, সাচা কথা কইলেই এমন হয়। তা, আমাগো কইবারও বা দরকার কি। ওর বউরে মারুক কি কাটুক কি নদীতে ভাসায়া দিক, আমাগো কি আছে তাতে।

সেদিন থেকে আবুলের সাতে পাঁচে আর কেউ নেই ওরা।

আজকাল হালিমাকে যখন প্রহর অন্তর একবার করে মারে আবুল তখন কেউ কিছু বলে। চুপ করে থাকে। মাঝে মাঝে বুড়ো মকবুল এক-আধটু বাধা দেবার চেষ্টা করে। আবুইল্যা তোর কি মানুষের পরান না, এমন কইরা যে মারছ বউডারে তোর মনে একটুও চোট লাগে না আবুইল্যা? বউদের অবশ্য মকবুলও মারে। তাই বলে আবুলের মত অত নির্দয় হওয়াটা মোটেই পছন্দ করে না সে। মারবি তো মার; একটুখানি সইয়া মার। অপরাধের গুরুত্ব দেইখা সেই পরিমাণ মার। এ হলো মকবুলের নিজস্ব অভিমত। অপরাধ, এমন কোন সাংঘাতিক করে নি হালিমা। পাশের বাড়ির নুরুর সঙ্গে কি একটা কথা বলতে গিয়ে হেসেছিলো জোরে। দূর থেকে সেটা দেখে গা জ্বালা করে উঠেছে আবুলের। একটা গভীর সন্দেহে ভরে উঠেছে মন।

এমন মন খোলা হাসিতো আবুলের সঙ্গে কোনদিন হাসে নি হালিমা।

বেহুঁশ হালিমাকে ভেতরে ফেলে রেখে আবুল যখন বাইরে বেরিয়ে এলো তখন সর্বাঙ্গে ঘামের স্রোত নেমেছে ওর। পরনের লুঙ্গি দিয়ে গায়ের ঘামটা মুছে নিয়ে দাওয়ার ওপর দম ধরে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিলো আবুল। মাটির কোটাকে নেড়েচেড়ে কি যেন দেখলো, তারপর কলকেটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।

রশীদের বউ সালেহা উঠোনে বসে চাটাই বুনছিলো। আবুলকে এদিকে আসতে দেখে মুখ টিপে হেসে বললো, বউ-এর পিরীত বুঝি আর সইলো না মিয়ার।

আর সইব, বহুত সইছি। মুখ বিকৃত করে পুরনো কথাটাই আবার বলে গেলো আবুল, আমার ঘরের ভাত খাইয়া রাস্তার মানুষের সঙ্গে পিরীত। তুমি কও ভাবী, এইডা কি সহ্য করন যায়।

হ্যাঁ তাতো খাঁটি কথাই কইছ। সালেহা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ঘরনী যদি মনের মত না হয় তাইলে কি তারে নিয়ে আর সুখে ঘর করন যায়? আর ভাবী দুনিয়াদারী আর ভাল লাগে না। ইচ্ছা করে দুই চোখ যেই দিকে যায় চইল্যা যাই। বলে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে আবুল। তারপর সালেহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, চুলায় আগুন আছে? একটু আগুন দাও।

এই দিই, বলে কলকেটা হাতে নিয়ে ঘরের ভিতরে চলে গেলো সালেহা। একটু পরেই আবার বেরিয়ে এলো সে। ও কাছে আসতে গলার স্বরটা একেবারে খাদে নামিয়ে এনে আবুল বললো, আইজ আর ছাড়ি নাই ভাবী। যতক্ষণ পারছি মারছি। তুমি একটু তেল গরম কইরা মালিশ কইরা দিও ওর গায়ে। হাড্ডি না দুই একখান ভাইঙ্গা গেছে কে জানে। তাইলে তো বড় বিপদ অইবো। কাম কাজ কত পইর‍্যা রইছে। সব কিছু বন্ধ অইয়া যাইবো।

সেই কথা আগে খেয়াল আছিলো না মিয়ার? সালেহা মুখ বাঁকালো। কাম কাজের যখন ক্ষতি অইবো জান, তহন না মারলেই পাইরতা। মালা ক্যান।

উহু, আবুল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, মারছি ঠিক করছি, না মারলে আস্কারা পাইয়া যাইতো।

আর আস্কারা কি এমনে কম পাইছে। চারদিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে চাপা স্বরে সালেহা বললো, নূরুর সঙ্গে কি আজকা কথা কইছে? ওতো রোজ রোজ কথা কয়।

কি? চোখ জোড়া আবার ধপ করে জ্বলে উঠলো আবুলের। আমারে এতদিন কও নাই ক্যান?

সালেহা বললো, কি দরকার বাপু আমাগো মিছামিছি শত্রু বইনা। কইম গেলে তো অনেক কথাই কইতে অয়। তাকি আর একদিনে শেষ করা যায়।

কি কথা কও ভাবী। খোদার কসম ঠিক কইরা কও। তামাক খাওয়াটা একবারে ভুলে গেলো আবুল।

সালেহা আস্তে করে বললো, যাই কও বাপু কারো বদনাম করার অভ্যাসই আমার নাই। কিন্তুক কই কি এই বউডা তোমার বড় ভালো হয় নাই। আমরা তো আয়শারেও দেখছি, জমিলারেও দেখছি। ওরাতো আমাগো হাতের ওপর দিয়েই গেছে। চরিত্রে ওগো তুলনা আছিলো না। কিন্তু হালিমার স্বভাব চরিত্র বাপু আমার বড় ভালো লাগে না। বলতে গিয়ে বার কয়েক কাশলো সালেহা। কাশটা গিলে নিয়ে আবার সে বললো, ইয়ে মানে, বাইরের মানুষের সঙ্গে হাসাহাসি আর ঢলাঢলি। একটুহানি লজ্জা শরমও তো থাকা চাই। কথা শেষে আবুলের রক্তলাল চোখ জোড়া দিকে দৃষ্টি পড়তে রীতিমত ভয় পেয়ে গেলো সাহেলা। একটু ধমকের সুরে বললো, দেইখো বাপু, তুমি মাইয়াডারে মারতা শুরু কইরো না। এমনিতেই বহুত মারছ। এতে যদি শিক্ষা না হয় তাইলে আর জন্মেও হইবো না। সালেহার কথাটা শেষ হবার আগেই সেখান থেলে চলে গেছে আবুল। কল্‌কেটা নিয়া যেতে ভুলে গেছে সে। একটু পরে আবার হালিমার কান্নার শব্দ শোনা গেলো ঘর থেকে। আবুল আবার মারছে তাকে।

পোস্টটি শেয়ার করুন