হৈমন্তী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হৈম বাবার হাত ধরিয়া তাঁহাকে শােবার ঘরে লইয়া গেল৷ অনেক কথা যে জিজ্ঞাসা করিবার আছে৷ তাহার বাবারও যে শরীর ভালাে দেখাইতেছে না।

বাবা জিজ্ঞাসা করিলেন, “বুড়ি, আমার সঙ্গে যাবি ?” হৈম কাঙালের মতাে বলিয়া উঠিল, “যাব।” বাপ বলিলেন, “আচ্ছা,সব ঠিক করিতেছি।”

শ্বশুর যদি অত্যন্ত উদবিগ্ন হইয়া না থাকিতেন তাহা হইলে এ-বাড়িতে ঢুকিয়াই বুঝিতে পারিতেন, এখানে তাঁহার আর সেদিন নাই৷ হঠাৎ তাঁহার আবির্ভাবকে উপদ্রব মনে করিয়া বাবা তাে ভালাে করিয়া কথাই কহিলেন না৷ আমার শ্বশুরের মনে ছিল তাঁহার বেহাই একদা তাঁহাকে বার বার করিয়া আশ্বাস দিয়াছিলেন যে, যখন তাঁহার খুশি মেয়েকে তিনি বাড়ি লইয়া যাইতে পারিবেন৷ এ সত্যের অন্যথা হইতে পারে সে কথা তিনি মনেও আনিতে পারেন নাই৷

বাবা তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন, “বেহাই, আমি তাে কিছু বলিতে পারি না, একবার তা হলে বাড়ির মধ্যে– | বাড়ির-মধ্যের উপর বরাত দেওয়ার অর্থ কী আমার জানা ছিল৷ বুঝিলাম, কিছু হইবে না৷ কিছু হইলও না৷

বউমার শরীর ভালাে নাই! এত বড়াে অন্যায় অপবাদ!

শ্বশুরমশায় স্বয়ং একজন ভালাে ডাক্তার আনিয়া পরীক্ষা করাইলেন৷ ডাক্তার বলিলেন,“বায়ু-পরিবর্তন আবশ্যক, নহিলে হঠাৎ একটা শক্ত ব্যামাে হইতে পারে।”

বাবা হাসিয়া কহিলেন,“হঠাৎ একটা শক্ত ব্যামাে তাে সকলেরই হইতে পারে। এটা কি আবার একটা কথা

আমার শ্বশুর কহিলেন, “জানেন তাে, উনি একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার, উহার কথাটা কি–”।

বাবা কহিলেন, “অমন ঢের ডাক্তার দেখিয়াছি৷ দক্ষিণার জোরে সকল পণ্ডিতেরই কাছে সব বিধান মেলে এবং সকল ডাক্তারেরই কাছে সব রােগের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়!” এই কথাটা শুনিয়া আমার শ্বশুর একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেলেন৷ হৈম বুঝিল, তাহার বাবার প্রস্তাব অপমানের সহিত অগ্রাহ্য হইয়াছে। তাহার মন একেবারে কাঠ হইয়া গেল৷

আমি আর সহিতে পরিলাম না৷ বাবার কাছে গিয়া বলিলাম, “হৈমকে আমি লইয়া যাইব।”

বাবা গর্জিয়া উঠিলেন, “বটে রে– ইত্যাদি ইত্যাদি৷

বন্ধুরা কেহ কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, যাহা বলিলাম তাহা করিলাম না কেন৷ স্ত্রীকে লইয়া জোর করিয়া বাহির হইয়া গেলেই তাে হইত৷ গেলাম না কেন ? কেন! যদি লােকধর্মের কাছে সত্যধর্মকে না ঠেলিব, যদি ঘরের কাছে ঘরের মানুষকে বলি দিতে না পারিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে বহুযুগের যে শিক্ষা তাহা কী করিতে আছে৷ জান তােমরা ? যেদিন অযােধ্যার লােকেরা সীতাকে বিসর্জন দিবার দাবি করিয়াছিল তাহার মধ্যে আমিও যে ছিলাম৷ আর সেই বিসর্জনের গৌরবের কথা যুগে যুগে যাহারা গান করিয়া আসিয়াছে আমিও যে তাহাদের মধ্যে একজন৷ আর, আমিই তাে সেদিন লােকরঞ্জনের জন্য স্ত্রীপরিত্যাগের গুণবর্ণনা করিয়া মাসিকপত্রে প্রবন্ধ লিখিয়াছি৷ বুকের রক্ত দিয়া আমাকে যে একদিন দ্বিতীয় সীতাবিসর্জনের কাহিনী লিখিতে হইবে, সে কথা কে জানিত৷

পিতায় কন্যায় আর-একবার বিদায়ের ক্ষণ উপস্থিত হইল৷ এইবারেও দুইজনেরই মুখে হাসি৷ কন্যা হাসিতে হাসিতেই ভৎসনা করিয়া বলিল, “বাবা, আর যদি কখনাে তুমি আমাকে দেখিবার জন্য এমন ছুটাছুটি করিয়া এ বাড়িতে আস তবে আমি ঘরে কপাট দিব।”

বাপ হাসিতে হাসিতেই বলিলেন,“ফের যদি আসি তবে সিধকাটি সঙ্গে করিয়াই আসিব।”

ইহার পরে হৈমর মুখে তাহার চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও দেখি নাই৷৷

তাহারও পরে কী হইল সে কথা আর বলিতে পারিব না৷

শুনিতেছি মা পাত্রী সন্ধান করিতেছেন৷ হয়তাে একদিন মার অনুরােধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না, হইও সম্ভব হইতে পারে। কারণ– থাক আর কাজ কী!

 

জ্যৈষ্ঠ, ১৩২১


পোস্টটি শেয়ার করুন